কুরআন কেন আমাদের কাঁদায় না? পবিত্র মহাগ্রন্থ কুরআন নাজিল হয়েছিল আজ থেকে ১৪-শ বছর আগে। নাজিল হয়েছিল শ্রেষ্ঠ মহামানব, মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের ওপর। তিনি কুরআনের আলোকে বদলে দিয়েছিলেন পুরো এক প্রজন্মকে। দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রজন্মটি – যে প্রজন্মের সবাই ব্যস্ত ছিল মূর্তিপূজা ও নফসের কামনা-বাসনা পূরণের চর্চায় – সেই প্রজন্মকেই তিনি নিয়ে যান অসীম এক উচ্চতার স্থানে। তারা হয়ে যায় মানবেতিহাসের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম প্রজন্ম। তারাই আমাদের সাহাবাগণ।
কুরআন কেন আমাদের কাঁদায় না?
কুরআন কেন আমাদের কাঁদায় না? সাহাবারা তো নিজেদের জীবন বদলে ফেলতে পেরেছিলেন। কিন্তু কোন জিনিসটা তাদেরকে নিজেদের বদলাতে সাহায্য করেছিল? কুরআন। কুরআনের রঙ্গে তারা নিজেকে রাঙ্গিয়েছিলেন। তাদের কথা ছিল কুরআনের মতো, তাদের আখলাক ছিল কুরআন মোতাবেক। মোটকথা, কুরআন আর সাহাবিগণ যেন ছিলেন পরস্পরের প্রতিবিম্ব।
সেই একই কুরআন আজ আমাদের মধ্যেও বিদ্যমান। ১৪শত বছর আগে নাজিলকৃত কুরআনের একটা হরফও আজও পরিবর্তিত হয়নি। অথচ আমাদের উম্মাতের কি নিদারুণ বেহাল দশা। কুরআন কেন আমাদের কাঁদায় না? অধিকাংশ মুসলিমদের মধ্যে ইমানের ছিটেফোঁটাও দেখা যায় না। কুরআন তো পালটায়নি। সাহাবাগণ যে কুরআন পড়েছিলেন, আমরাও তো সেই একই কুরআনই পড়ি। সাহাবাগণের ওপর কুরআন যে প্রভাব ফেলত তা কি আমাদের ওপর পড়ে? ধারেকাছেও না। কুরআন পড়ে তারা কাঁদতেন, কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসাতেন। কিন্তু আজ কুরআন আমাদের ভ্রূক্ষেপও করাতে পারে না।
শুধুমাত্র কুরআনের তিলাওয়াতই কত সাহাবাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে।
উমর ইবনুল খাত্তাব রা. ইসলামে ফেরার আগে ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তবে যখন তিনি সুরা ত্বহার আয়াতের তিলাওয়াত করতে শুনলেন, তখন তিনি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হলেন। তিনি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। উমরের ইসলামে প্রত্যাবর্তন তখনকার মুসলিম সমাজের ওপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছিল। কারণ তিনি ছিলেন শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
আল কুরআনের গুরুত্ব ও মর্যাদা
বিলাল ইবনু রাবাহ রা. ছিলেন এক হাবশী ক্রীতদাস। ইসলাম গ্রহণ করার জন্য তার মালিক তাকে নির্যাতন করত। প্রচণ্ড অত্যাচার সত্ত্বেও বিলাল তার ইমানে অবিচল ছিলেন। কুরআন কেন আমাদের কাঁদায় না? একদিন, যখন তাকে নির্যাতন করা হচ্ছিল, তিনি সুরা আল-ইখলাস থেকে “আহাদ” (অর্থাৎ “এক”) শব্দটি পুনরাবৃত্তি করছিলেন। আল্লাহর একত্বের এই স্বীকৃতি তাকে শক্তিপ্রদান করে। তার হৃদয়কে সান্ত্বনা দেয়। কেন তিনি এই কষ্ট করছেন সেটা তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
কুরআন দ্বারা সাহাবিদের প্রভাবিত হওয়ার এমন অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যাবে। কিন্তু সাহাবিদের সাথে আমাদের পার্থক্যটা কোথায়? কেন দুই জায়গায় দুই রকম ফলাফল দেখা যাচ্ছে?
এর মূল্য রহস্য লুকিয়ে আছে আমাদের মন-মানসিকতায় ও নিয়তে। সাহাবিরা যে মানস নিয়ে, নিয়ত নিয়ে, ইখলাস নিয়ে কুরআনের কাছে যেতেন আমরাও কি সেভাবে যাই? যে কারণে তারা কুরআন পড়তেন আমরা কি সে কারণে কুরআন পড়ি?
কুরআন আল্লাহর প্রজ্ঞাপূর্ণ কিতাব। এখানে আল্লাহর হিকমাহপূর্ণ অনেক আয়াত রয়েছে। ফলে সাহাবিরাও উৎসুক হয়ে কুরআন পড়তেন এটা জানার জন্য যে আল্লাহ তাদের কোনো নির্দেশ দিচ্ছেন কী না। কুরআন কেন আমাদের কাঁদায় না? সৈন্যরা যেমন তাদের কমান্ডারের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে, নির্দেশ পাওয়া মাত্র হুকুম পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনি সাহাবিরাও কুরআনের প্রতি চাতক পাখির মতো উৎসুক হয়ে থাকতেন। আল্লাহর আদেশপালনে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য বা অবহেলা তারা করতেন না। তারা কুরআনের প্রতি এ মনোভাব লালন করতেন আল্লাহর প্রতি তাদের ভালোবাসা, আল্লাহর রহমত লাভ করা এবং আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করার কারণে। কারণ আল্লাহর আদেশ লঙ্ঘন করার পরিণতি তারা জানতেন।
وَ مَا کَانَ لِمُؤۡمِنٍ وَّ لَا مُؤۡمِنَۃٍ اِذَا قَضَی اللّٰهُ وَ رَسُوۡلُهٗۤ اَمۡرًا اَنۡ یَّکُوۡنَ لَهُمُ الۡخِیَرَۃُ مِنۡ اَمۡرِهِمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِیۡنًا ﴿ؕ۳۶﴾
আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে। [সুরা আহজাব : ৪৬]
মনে হলে আল্লাহর আদেশ মানলাম, আর মনে না হলে মানলাম না – তাদের কাছে বিষয়টা এরকম ঐচ্ছিক ছিল না। কুরআনের আলোকে তারা নুর মনে করতেন। তারা ছিলেন অন্ধকারে ডুবে। তাই তাদেরকে অন্ধকার থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র পথ ছিল কুরআনের অনুসরণ। তাই আলোর দেখা পেতে অধীর আগ্রহেই তারা অপেক্ষা করতেন।
তীব্র খরায় শুষ্ক মাটি যেভাবে বৃষ্টির পানির জন্য অপেক্ষা করে, সেভাবে তারাও আল্লাহর কালামের জন্য প্রতীক্ষা করতেন। আর তাই যে ইমানের বীজ তারা নিজেদের অন্তরে বপন করেছিলেন, সেই বীজ ছিল উৎকৃষ্ট মানের। তাই যে ফসল আসত, তা গুণেমাণে ছিল সেরা। তাদের চিন্তাভাবনা তো কেবল একটা জিনিসকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খেত – কিভাবে আপন রবের সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়?
এরকম মনোভাব নিয়ে কেউ কুরআনের কাছে গেলে কিভাবে সে কুরআন দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে থাকতে পারে? কুরআনের তিলাওয়াত শুনলে তার তো তাকওয়া বৃদ্ধি হবেই, হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার প্রবল জোয়ার উঠবেই। চোখ বেয়ে নেমে আসবে অনুতপ্ত অশ্রুর নীরব ফল্গুধারা। সাহাবিদের কুরআনের সাথে আচরণ ছিল এমনই।
কিন্তু আমাদের অবস্থাটা আসলে কেমন?
আসুন একটু যাচাই করে দেখি আমরা।
কুরআন নিয়ে বসলেই আমাদের ভেতরে অলসতা জেঁকে বসে। কুরআন পড়তে বসলেই মনে হয় কখন আমি তিলাওয়াত ছেড়ে উঠে যাব। তিলাওয়াতের সময়ও মন থাকে দুনিয়াবি দিকে। কেমন যেন এক নিষ্ক্রিয়তার মনোভাব নিয়ে আমরা কুরআন পড়ি। অনেক সময় শুধু তিলাওয়াতের জন্যই তিলাওয়াত করি আমরা।কুরআন কেন আমাদের কাঁদায় না? মানার কোনো ইচ্ছা বা আগ্রহ হয়তো থাকে না। এ জন্য আজ লক্ষ লক্ষ হাফিজে কুরআন থাকলেও কুরআন মানার মতো লোকের বড্ড অভাব।
অবশ্যই তিলাওয়াতের সাওয়াবকে খাটো করে দেখা হচ্ছে না। তবে কুরআনকে শুধু শেলফে ফেলে রাখার জন্য বা তিলাওয়াত করার জন্য পাঠানো হয়নি। পৃথিবীর সবাই যদি কুরআন তিলাওয়াত করে কিন্তু কুরআনের বিধান বাস্তবায়ন না করে, তাহলে কখনই কুরআনের হক আদায় হবে না।
আল কোরআনের ফজিলত
কুরআন অনুসরণের বদলে কুরআন থেকে যেন পালাতে চাই আমরা। দুনিয়ার ক্ষণিকের প্রবৃত্তির অনুসরণই হয়ে গিয়েছে আমাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। কুরআন কেন আমাদের কাঁদায় না? আজ আমরা সস্তা সুখ আর খেলতামাশায় নিজেদের প্রতিটা মূহুর্ত ডুবিয়ে রেখেছি।
কুরআনের আয়াত না মানার জন্য কত অজুহাতই না খুঁজি আমরা। বিশেষ করে যখন আয়াতটা আমাদের খেয়ালখুশি কিংবা কামনা-বাসিনার চাহিদার বিরুদ্ধে যায়। কুরআনের আয়াত নফসের সাথে গেলে সেটা পালন করা আসলে এক প্রকারের নফসেরর অনুসরণ।
আমরা যে রকম অজুহাত তুলে ধরিঃ
“হয়তো এই আয়াতের ব্যাখ্যা ভিন্ন’,
‘হয়তো এই আয়াতে যে অর্থটাকে অর্থ বলে মনে হচ্ছে আল্লাহ তার চেয়ে ভিন্ন কিছু বুঝিয়েছেন’,
‘আরে এটা নিয়ে তো আলিমদের মধ্যে ইখতিলাফ আছে’,
‘এই বিধান কি এই যুগে চলে? আমরা তো সাহাবিদের যুগে নেই,’
আমরা এভাবে একের পর এক অজুহাত তুলে ধরি। ফলে ইমানের নাগালের বাইরে থেকে যাই আমরা। কিন্তু আল্লাহর আদেশ কি এত সহজেই উপেক্ষা করা যায় যখন আমাদেরকে আল্লাহকে মানার ফিতরাতের ওপরই সৃষ্টি করা হয়েছে?
এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর আমাদের সতর্ক করে দেয়ঃ
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اسۡتَجِیۡبُوۡا لِلّٰهِ وَ لِلرَّسُوۡلِ اِذَا دَعَاکُمۡ لِمَا یُحۡیِیۡکُمۡ ۚ وَ اعۡلَمُوۡۤا اَنَّ اللّٰهَ یَحُوۡلُ بَیۡنَ الۡمَرۡءِ وَ قَلۡبِهٖ وَ اَنَّهٗۤ اِلَیۡهِ تُحۡشَرُوۡنَ ﴿۲۴﴾
হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের ডাকে সাড়া দাও; যখন সে তোমাদেরকে আহবান করে তার প্রতি, যা তোমাদেরকে জীবন দান করে। জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ মানুষ ও তার হৃদয়ের মাঝে অন্তরায় হন। আর নিশ্চয় তাঁর নিকট তোমাদেরকে সমবেত করা হবে। [সুরা আনফাল : ২৪]
এই আয়াত আমাদের দ্বিধায় ফেলে। এক অপরাধবোধ আমাদের মনে জেঁকে বসে। কিন্তু এই অনুভূতি বেশিক্ষণ বজায় থাকে না। শয়তানের ধোকায় আবার আমরা আগের অনুভূতিতে, আগের জগতে ফিরে যাই। কুরআন কেন আমাদের কাঁদায় না? কুরআনের নির্দেশনা পড়ে থাকে অবহেলিত, উপেক্ষিত হয়ে। তাহলে কিভাবে সাহাবাদের মতো কুরআনের ইফেক্ট পড়বে আমাদের হৃদয়ে?
আপনি কি চান আপনিও সাহাবাদের মতোই কুরআন থেকে উপকৃত হোন? তাহলে একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনাকে। মেনে নিতে হবে যে, আল্লাহর হুকুম পালন কোনো ঐচ্ছিক বিষয় না। কুরআন কেন আমাদের কাঁদায় না? আল্লাহর হুকুম আপনার জন্য মেনে চলা ফরজ। একে এড়িয়ে যাওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই আপনার। আল্লাহ যা আদেশ দেন, যেভাবে পালনের আদেশ দেন এক্স্যাক্টলি সেভাবেই করতে হবে আপনাকে।
এই সিদ্ধান্ত নেওয়া আপনার জন্য সহজ হবে না। তবে আপনাকে হতে হবে দৃঢ়প্রত্যয়ী। আল্লাহর আদেশ পালনে যত বাধাই আসুক না কেন, আপনি কখনই আপনার জায়গা থেকে পিছু টলবেন না এমন মনোভাব সর্বদা অন্তরে লালন করতে হবে। মনে রাখবেন, আল্লাহ আপনার ওপর এমন কিছু চাপিয়ে দেবেন না যা আপনার সাধ্যাতিত, যা আপনার ক্ষতিসাধন করে। তাহলে কেন আল্লাহর আদেশ পালন থেকে বিরত থাকছেন?
وَ مَا کَانَ لِمُؤۡمِنٍ وَّ لَا مُؤۡمِنَۃٍ اِذَا قَضَی اللّٰهُ وَ رَسُوۡلُهٗۤ اَمۡرًا اَنۡ یَّکُوۡنَ لَهُمُ الۡخِیَرَۃُ مِنۡ اَمۡرِهِمۡ ؕ وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًا مُّبِیۡنًا ﴿ؕ۳۶﴾
আর আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোন নির্দেশ দিলে কোন মুমিন পুরুষ ও নারীর জন্য নিজদের ব্যাপারে অন্য কিছু এখতিয়ার করার অধিকার থাকে না; আর যে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অমান্য করল সে স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হবে। [সুরা আহজাব : ৪৬]