কুরআনে মেঘের বিজ্ঞানময় বিবরণ
মেঘ তৈরি হয় যখন বায়ুতে জলীয় বাষ্প ধুলো বা ধোঁয়ার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার চারপাশে ঘনীভূত হয়। জলীয় বাষ্প অদৃশ্য। কিন্তু যে পানির ফোঁটাগুলো মেঘ তৈরি করে তা দেখা যায়। মেঘ বিভিন্ন আকার এবং প্রকারের হয়।
মেঘ মূলত তিন প্রধান ধরনের: কিউমুলাস, স্ট্র্যাটাস এবং সাইরাস। কিউমুলাস মেঘ দেখতে সাদা তুলোর বলের মত দেখায়। স্ট্র্যাটাস মেঘ সমতল এবং ধূসর। এ ধরনের মেঘ প্রায় গোটা আকাশ ঢেকে দেয়। সাইরাস মেঘ বেশ পাতলা। দেখতে চুলের মতো দেখায়।
পানিচক্রে মেঘ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেঘগুলো গোটা পৃথিবীতে পানি সরবরাহ করতে সাহায্য করে এবং গাছপালা ও প্রাণীদের জন্য আর্দ্রতার উৎস হিসেবে কাজ করে। মেঘ পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতেও সাহায্য করে। যে সব মাধ্যমে মেঘ সৃষ্টি হতে পারে তা হলঃ
বাষ্পীভবন: সূর্য যখন পৃথিবীর পৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে, তখন পানি বায়ুতে বাষ্পীভূত হয়।
ঘনীভবন: যখন বাতাসে জলীয় বাষ্প শীতল হয়, তখন এটা বাতাসের ক্ষুদ্র কণাগুলোর চারপাশে ঘনীভূত হয় এবং মেঘ তৈরি করে।
লিফটিং: যখন বায়ুর উষ্মতা বেড়ে যায়, তখন তা শীতল ও ঘনীভূত হয়ে মেঘ তৈরি করে।
ফ্রন্টস: যখন ভিন্ন তাপমাত্রার দুটি বায়ুভর মিলিত হয়, তখন তারা মেঘ তৈরি করতে পারে।
আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত: আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্প ছেড়ে দিতে পারে, যার ফলে মেঘ তৈরি হয়।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন ধরনের মেঘের প্রকৃতির উপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছেন যে বৃষ্টির জন্য যে মেঘ দায়ী তা সৃষ্টি হওয়া এবং আকৃতি লাভের পেছনে নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। বৃষ্টির মেঘের একটি ধরণ হচ্ছে পুঁজমেঘ। আবহাওয়াবিদরা গবেষণা করেছেন কিভাবে পুঁজমেঘ গঠিত হয় এবং কিভাবে দ্বারা বৃষ্টি ও বজ্র সৃষ্টি করে।
তারা দেখেছেন পুঁজমেঘ নিম্নোক্ত ধাপের ভেতর দিয়ে যেয়ে বৃষ্টি তৈরী করেঃ
১) বায়ু কর্তৃক মেঘমন্ডলকে ধাক্কাঃ পুঁজমেঘ গঠিত হতে শুরু করে যখন বায়ু টুকরো টুকরো মেঘকে এমন দিকে ঠেলে দেয় যেখানে মেঘ অভিসৃত হয়। (চিত্র ১ দেখুন)
চিত্র ১: স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা যাচ্ছে মেঘ B,C,D এরিয়ায় অভিসৃত হচ্ছে। তীর দ্বারা বায়ুর প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে। (The Use of Satellite Pictures in Weather Analysis and Forecasting, Anderson and others, p. 188.)
চিত্র ২ঃ দিগন্তে পুঞ্জীভূত মেঘগুলো ছোট ছোট মেঘের আকারে অভিসৃত হচ্ছে যেখানে বিশাল মেঘের সৃষ্টি হয়েছে। (Clouds and Storms, Ludlam, plate 7.4.)
২) যুক্ত হওয়াঃ এরপরে ছোট ছোট মেঘের টুকরোগুলো একত্রিত হয়ে বিশালাকার মেঘ গঠন করে২৯। (চিত্র ১৮ এবং ১৯ দেখুন)
চিত্র ১৯ঃ (A) বিচ্ছিন্ন টুকরো মেঘ (পুঞ্জীভূত মেঘ) (B) যখন ছোট ছোট মেঘ একত্রিত হয়, তখন উপরের দিকে টান বেড়ে যায় এবং মেঘগুলো স্তুপীকৃত হয়। (The Atmosphere, Anthes and others, p. 269.)
৩) পুঞ্জীভূত করাঃ যখন ছোট ছোট মেঘ একীভূত হয়, তখন বড় মেঘে তাদের নিচ থেকে চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই চাপ মেঘের কেন্দ্রে তাদের পার্শ্বের তুলনায় বেশী হয়৩০। এই চাপের কারণে মেঘের পরিমাণ উলম্বভাবে বাড়তে থাকে, এবং এভাবেই মেঘ পুঞ্জিভূত হয়। (চিত্র ১৯,২০,২১ দেখুন)। এই উলম্ববৃদ্ধির কারণে মেঘদেহ বায়ুমন্ডলের শীতল অংশের দিকে ধাবিত হয় এবং সেখানে পানির ফোঁটা ও শিলা বড় হতে থাকে। যখন পানির ফোঁটা ও শিলা এই উপরের দিকে চাপের চাইতেও বেশী হয় তখন এই চাপ পানির ফোঁটা ও শিলাকে ধরে রাখতে পারে না, আর তখনই তারা মেঘ থেকে বৃষ্টি, শিলা ইত্যাদি আকারে জমিনে পড়ে৩১।
চিত্র ২০ঃ একটি সুগঠিত মেঘ। মেঘ স্তুপীকৃত হয়ার পর, বৃষ্টি নেমে পড়ে। (Weather and Climate, Bodin, p.123.)
আল্লাহ কুরআনে বলেনঃ
اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰهَ یُزۡجِیۡ سَحَابًا ثُمَّ یُؤَلِّفُ بَیۡنَهٗ ثُمَّ یَجۡعَلُهٗ رُکَامًا فَتَرَی الۡوَدۡقَ یَخۡرُجُ مِنۡ خِلٰلِهٖ ۚ وَ یُنَزِّلُ مِنَ السَّمَآءِ مِنۡ جِبَالٍ فِیۡهَا مِنۡۢ بَرَدٍ فَیُصِیۡبُ بِهٖ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَصۡرِفُهٗ عَنۡ مَّنۡ یَّشَآءُ ؕ یَکَادُ سَنَا بَرۡقِهٖ یَذۡهَبُ بِالۡاَبۡصَارِ ﴿ؕ۴۳﴾
তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহ মেঘমালাকে পরিচালিত করেন, তারপর তিনি সেগুলোকে একত্রে জুড়ে দেন, তারপর সেগুলো স্তুপীকৃত করেন, তারপর তুমি দেখতে পাও তার মধ্য থেকে বৃষ্টির বের হয়। আর তিনি আকাশে স্থিত মেঘমালার পাহাড় থেকে শিলা বর্ষণ করেন। তারপর তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন। আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা সরিয়ে দেন। এর বিদ্যুতের ঝলক দৃষ্টিশক্তি প্রায় কেড়ে নেয়। (সূরা আন নূর ২৪:৪৩)
আবহাওয়াবিদরা এসব সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছেন বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন প্লেন, স্যাটেলাইট, কম্পিউটার, বেলুন ইত্যাদি দিয়ে। এসবের সাহায্যে বায়ু এবং তার দিক, আর্দ্রতা এবং এর ভ্যারিয়েশন, এবং বায়ুর চাপ মাপা হয়৩২।
চিত্র ২১ঃ একটি পুঞ্জীভূত মেঘ (A Colour Guide to Clouds, Scorer and Wexler, p. 23.)
এই আয়াতের পরবর্তীতে মেঘ এবং বৃষ্টি সম্পর্কে বলার পর শিলা ও বজ্রের উল্লেখ এসেছেঃ
اَلَمۡ تَرَ اَنَّ اللّٰهَ یُزۡجِیۡ سَحَابًا ثُمَّ یُؤَلِّفُ بَیۡنَهٗ ثُمَّ یَجۡعَلُهٗ رُکَامًا فَتَرَی الۡوَدۡقَ یَخۡرُجُ مِنۡ خِلٰلِهٖ ۚ وَ یُنَزِّلُ مِنَ السَّمَآءِ مِنۡ جِبَالٍ فِیۡهَا مِنۡۢ بَرَدٍ فَیُصِیۡبُ بِهٖ مَنۡ یَّشَآءُ وَ یَصۡرِفُهٗ عَنۡ مَّنۡ یَّشَآءُ ؕ یَکَادُ سَنَا بَرۡقِهٖ یَذۡهَبُ بِالۡاَبۡصَارِ ﴿ؕ۴۳﴾
তুমি কি দেখনি যে, আল্লাহ মেঘমালাকে পরিচালিত করেন, তারপর তিনি সেগুলোকে একত্রে জুড়ে দেন, তারপর সেগুলো স্তুপীকৃত করেন, তারপর তুমি দেখতে পাও তার মধ্য থেকে বৃষ্টির বের হয়। আর তিনি আকাশে স্থিত মেঘমালার পাহাড় থেকে শিলা বর্ষণ করেন। তারপর তা দ্বারা যাকে ইচ্ছা আঘাত করেন। আর যার কাছ থেকে ইচ্ছা তা সরিয়ে দেন। এর বিদ্যুতের ঝলক দৃষ্টিশক্তি প্রায় কেড়ে নেয়। (সূরা আন নূর ২৪:৪৩)
আবহাওয়াবিদরা দেখেছেন পুঁজমেঘ, শিলাবৃষ্টি এগুলি প্রায় ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০ ফিট উচ্চতায় (৪.৭ মাইল থেকে ৫.৭ মাইল)৩৩ থাকে যা পাহাড়ের সমান। কুরআন বলছেঃ “আর তিনি আকাশে স্থিত মেঘমালার পাহাড় থেকে শিলা বর্ষণ করেন।” (চিত্র ২১ দেখুন)
এই আয়াত একটি প্রশ্ন তুলতে পারে। কেন এখানে “এর বিদ্যুতের ঝলক বা তার বজ্র” এর কথা বলা হচ্ছে শিলার কথা বলার সময়? এর মানে কি বজ্র সৃষ্টির পেছনে শিলার ভূমিকা রয়েছে? দেখা যাক মিটিওরোলজি টুডে বইটি কি বলে এ ব্যাপারে। মেঘ চার্জিত হয়ে যায় যখন শিলা বরফের ক্রিস্টাল ও অতিশীতল পানির ফোঁটার মেঘের ভেতর দিয়ে পড়তে থাকে। যখন তরল ফোঁটার সাথে শিলাখন্ডের সংঘর্ষ হয় তখন তারা স্পর্শের সাথে সাথেই জমে যায় এবং সুপ্ততাপ নির্গত করে। এরফলে শিলাখন্ডের পৃষ্ঠ তার পরিপার্শ্বের বরফের ক্রিস্টালের চেয়ে উষ্ণ থাকে। যখন শিলাখন্ড বরফের ক্রিস্টালের সংস্পর্শে আসে, তখন একটি গুরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে; ইলেকট্রন শীতল বস্তু থেকে উষ্ণ বস্তুর দিকে ধাবিত হয়। এরফলে, শিলাখন্ড ঋণাত্মক চার্জ বিশিষ্ট হয়। একই ব্যাপার ঘটে যখন অতিশীতল পানির ফোঁটা শিলাখন্ডের সংস্পর্শে আসে এবং এর ফলে ক্ষুদ্র ধনাত্মক শিলাকণা শিলাখন্ড থেকে ভেঙ্গে যায়। এই হাল্কা ধনাত্মক চার্জগুলো নিচ হতে প্রয়োগকৃত চাপ/উপর হতে টানার ফলে মেঘের উপরের দিকে উঠে যায়। এর ফলে শিলাখন্ডে কেবল ঋণাত্মক চার্জ অবশিষ্ট থাকে যা মেঘের নিচের দিকে অবস্থান করে। এর ফলে মেঘের নিম্নাংশ হয়ে যায় ঋণাত্মক চার্জবিশিষ্ট। এই ঋণাত্মক চার্জগুলো বজ্রপাতের মাধ্যমে পৃথিবীতে পতিত হয়ে মেঘতে ঋণাত্মক চার্জমুক্ত করে৩৪। তাই এখান থেকে আমরা বলতে পারি, বজ্র্য সৃষ্টির পিছনে শিলার ভূমিকা রয়েছে।
বজ্রপাতের উপর এসকল তথ্য সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অ্যারিস্টটল এর আইডিয়াই প্রচলিত ছিল যা সেসময় ভুল প্রমাণিত হয়। ১৪০০ বছর আগেও এই ধারণারই চল ছিল যদিও কুরআনের সাথে তার মিল নেই।