ইলম একটি আরবি শব্দ। এর ব্যাকরণগত অর্থ হল জ্ঞান, জানা, বোঝা, উপলব্ধি করা ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় ইলম হচ্ছে দীনি জ্ঞান। তাই যে কোনো জ্ঞানকেই ইলম বলার সুযোগ নেই। বরং যে জ্ঞানের সাথে দীনের, ধর্মের সম্পর্ক আছে সেটাই ইলম। কেবল এ ধরণের ইলমের ক্ষেত্রেই ইলম অর্জনের ফজিলত প্রযোজ্য হবে।
ইসলাম শব্দের অর্থ আনুগত্য করা এবং আত্মসমর্পণ করা। তাই প্রত্যেক মুসলিম কার আনুগত্য করবে, কীভাবে তারা তাদের জীবনযাপন করবে? কীভাবে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করবে? ইত্যাদি জ্ঞানকেই বলা হয় ইলম।
দীনি জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে নিয়ত ঠিক থাকা অত্যন্ত জরুরী। ফকিহ বুরহানুদ্দিন মারগিনানি রাহ.-এর সাগরের বুরহানুল ইসলাম জারনুঝি রাহ. বলেছেন, ‘অনেক কাজ বাহ্যিক দৃষ্টিতে দুনিয়াবি মনে হলেও নেক নিয়তের কারণে তা আখিরাতে কাজে পরিণত হয়। আবার অনেক আখিরাতের কাজে নিয়তে গলদ থাকার কারণে তা দুনিয়ার কাজ বলে গণ্য হয়।’
ইসলামে ইলমের গুরত্ব অনেক। পবিত্র কুরআন শুরুই হয়েছে ইকরা তথা পড়ো, জ্ঞানার্জন করো দিয়ে।
اِقْرَاْبِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِىْ خَلَقَ
অর্থঃ পড়ুন আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করছেন৷ [সুরা আলাক: ১)।
তাই বলা যায়, ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হচ্ছে ইলম। ইসলামের যে কোনো বিধি-বিধান মানতে এবং খুঁটিনাটি বিষয় জানতে ইলম অর্জন অপরিহার্য। প্রতিটি মুসলিমের ওপর ইলম অর্জন ফরজ ঘোষণা করা হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে ইলম অর্জনের নানা ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। মানুষ অন্যান্য জীবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ কারণ মহান আল্লাহ তার রহমত বর্ষণ করে মানুষকে ইলম অর্জনের তাওফিক প্রদান করেছেন। ইলম শিখিয়েছেন আল্লাহ। আদম আলায়হিস সালামকে বিভিন্ন জিনিসের নাম শেখান তিনি। আসুন, পবিত্র কুরআনে ইলম অর্জনের কি কি ফজিলত বর্ণিত হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
১. ইলম মানুষকে তাকওয়াবান করে
মহান আল্লাহর অনুসারীদের ভেতরে তারাই সবচেয়ে তাকওয়াবান যারা সবচেয়ে বেশী ইলমের অধিকারী ছিলেন। আর ইলমের দিক দিয়ে নবি-রাসুলদের চেয়ে অগ্রবর্তী ছিলেন আর কারা? যেহেতু তারা আল্লাহর ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী জানতেন, তাই আল্লাহকে তারা ভয়ও করতেন বেশী। উলামায়ে কিরামগণও উম্মাহর অগ্রদূত। সাধারণ বান্দাদের চেয়ে উলামাদের মর্যাদা অনেক বেশী।
اِنَّمَا یَخۡشَی اللّٰهَ مِنۡ عِبَادِهِ الۡعُلَمٰٓؤُا
আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে তারাই তাঁকে ভয় করে যারা জ্ঞানী (আলিম)। [সুরা ফাতিরঃ ২৮]
বলা হয়েছে যে, কেবল আলেম ও জ্ঞানীগণই আল্লাহকে ভয় করে। আল্লাহর শক্তিমত্তা, জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বিজ্ঞানময়তা, ক্ৰোধ, পরাক্রম, সার্বভৌম কর্তৃত্ব-ক্ষমতা ও অন্যান্য গুণাবলী সম্পর্কে যে ব্যক্তি যতবেশী জানবে সে ততবেশী তাঁর নাফরমানী করতে ভয় পাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর ব্যাপারে যতবেশী অজ্ঞ হবে সে তাঁর ব্যাপারে তত বেশী নির্ভীক হবে। এ আয়াতে জ্ঞান অর্থ দৰ্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, অংক ইত্যাদি স্কুল-কলেজে পঠিত বিষয়ের জ্ঞান নয়। বরং এখানে জ্ঞান বলতে আল্লাহর গুণাবলীর জ্ঞান বুঝানো হয়েছে। এ জন্য শিক্ষিত ও অশিক্ষিত হবার প্রশ্ন নেই। তাই আয়াতে العلماء বা ‘উলামা’ বলে এমন লোকদের বোঝানো হয়েছে, যারা আল্লাহ তাআলার সত্তা ও গুণাবলী সম্পর্কে সম্যক অবগত এবং পৃথিবীর সৃষ্টবস্তু সামগ্ৰী, তার পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও আল্লাহর দয়া-করুণা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেন।
এখান থেকে বুঝে আসে যে, যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার পরেও তাকওয়া অর্জন করতে পারেনি, আল্লাহকে ভয় করতে শিখেছি, সে আসলে কালো কালির কিছু অক্ষর শিখেছে মাত্র। ইলম তার সিনায় প্রবেশ করতে পারেনি। তাকে কোনোভাবেই প্রকৃত ইলমের অধিকারী বলা যায় না।
২. ইলম মানুষকে দুনিয়া-আখিরাতে সম্মান প্রদান করে
ইলম অর্জন করে যে ব্যক্তি, আল্লাহ তাকে দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জাহানেই সম্মান ও প্রতিপত্তি দান করেন। মহান আল্লাহ নিজেই এই অঙ্গীকার করেছেন কুরআনে,
یَرۡفَعِ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا مِنۡکُمۡ ۙ وَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡعِلۡمَ دَرَجٰتٍ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرٌ ﴿۱۱﴾
তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত। [সুরা মুজাদালাহঃ ১১]
আবুত তোফায়েল আমের ইবনে ওয়াসিলা বলেন, উমর রা. নাফে ইবনে হারেসকে উসফান নামক স্থানে দেখা পেলেন। তিনি তাকে মক্কার গভর্ণর নিযুক্ত করেছিলেন। উমর তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি উপত্যকাবাসী (মক্কা) এর উপর কাকে দায়িত্ব দিয়ে এসেছ? আমের বললেন, আমি ইবনে আবযার উপর তাদের দায়িত্ব দিয়েছি। উমর বললেন, ইবনে আবযা কে? তিনি বললেন, আমাদের এক দাস। উমর বললেন, তাদের উপর তুমি দাসকে দায়িত্বশীল করেছ? তিনি বললেন, হে আমিরুল মুমিনীন! সে আল্লাহর কিতাবের একজন সুপাঠক, ফারায়েজ সম্পর্কে পণ্ডিত ও বিচারক। তখন উমর রা. বললেন, তাহলে শোন, আমি তোমাদের নবীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ এ কুরআন দ্বারা কাউকে উচ্চ মর্যাদায় আসীন করবেন। আর কাউকে অধঃপতন ঘটাবেন।” [মুসলিম: ৮১৭]
৩. আল্লাহ ইলম অর্জনের জন্য উৎসাহিত করেছেন
পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে তার ইলম বৃদ্ধির জন্য বেশী বেশী দুআ করতে বলেছেন।
فَتَعٰلَی اللّٰهُ الۡمَلِکُ الۡحَقُّ ۚ وَ لَا تَعۡجَلۡ بِالۡقُرۡاٰنِ مِنۡ قَبۡلِ اَنۡ یُّقۡضٰۤی اِلَیۡکَ وَحۡیُهٗ ۫ وَ قُلۡ رَّبِّ زِدۡنِیۡ عِلۡمًا ﴿۱۱۴﴾
আল্লাহ সর্বোচ্চ, প্রকৃত অধিপতি, তোমার প্রতি (আল্লাহর) ওয়াহী সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বে তুমি কুরআন বক্ষে ধারণের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করো না। আর বল, ‘হে আমার প্রতিপালক! জ্ঞানে আমায় সমৃদ্ধি দান করুন।’ [সুরা তহাঃ ১১৪]
আল্লামা কুরতুবি রাহ. বলেন, ‘ইলমের চেয়ে অন্য কোনো আমল যদি আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় হত, তাহলে আল্লাহ নবিজিকে সেটাই বেশী বেশী করার তাওফিক চেয়ে দুআ করার নির্দেশ দিতেন। কুরআনে কারিমে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে ইলম ছাড়া অন্য কোনো জিনিস বৃদ্ধির জন্য দুআ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়নি।”
৪. ইলমহীন ব্যক্তি ও ইলমওয়ালা ব্যক্তির অবস্থান এক রকম নয়
মহান আল্লাহ কুরআনে বলেছেন,
اَمَّنۡ هُوَ قَانِتٌ اٰنَآءَ الَّیۡلِ سَاجِدًا وَّ قَآئِمًا یَّحۡذَرُ الۡاٰخِرَۃَ وَ یَرۡجُوۡا رَحۡمَۃَ رَبِّهٖ ؕ قُلۡ هَلۡ یَسۡتَوِی الَّذِیۡنَ یَعۡلَمُوۡنَ وَ الَّذِیۡنَ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ؕ اِنَّمَا یَتَذَکَّرُ اُولُوا الۡاَلۡبَابِ ﴿۹﴾
যে ব্যক্তি রাতের প্রহরে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ করে, আখিরাতকে ভয় করে এবং তার রব-এর রহমত প্রত্যাশা করে (সে কি তার সমান যে এরূপ করে না) বল, ‘যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমান?’ বিবেকবান লোকেরাই কেবল উপদেশ গ্রহণ করে। [সুরা যুমারঃ ৩৯]
সেই ব্যক্তি যে জানে যে, আল্লাহ শান্তি ও শাস্তির যে ওয়াদা করেছেন তা সত্য এবং ঐ ব্যক্তি যে এ কথা জানে না, এরা দুইজন সমান হতে পারে না। একজন বিজ্ঞ এবং অপরজন অজ্ঞ। যেমন শিক্ষা ও মূর্খতা এক নয়, অনুরূপ শিক্ষিত ও মূর্খ সমান নয়। হতে পারে যে, এখানে আলেম ও জাহেলের উদাহরণ দিয়ে এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, যেমন এরা দুইজন সমান নয়, অনুরূপ আল্লাহর বাধ্য ও অবাধ্য বান্দা, দুইজনে সমান হতে পারে না। কেউ কেউ এর অর্থ এই বর্ণনা করেছেন যে, আলেম (জ্ঞানী) বলে ঐ ব্যক্তিকে বুঝানো হয়েছে, যে তার ইলম (জ্ঞান) অনুযায়ী আমল করে। কারণ সেই (প্রকৃত আলেম যে তার) ইলম দ্বারা উপকৃত হয়। আর যে নিজ ইলম অনুযায়ী আমল করে না, সে ঠিক যেন অজ্ঞ। এই অর্থ অনুযায়ী এখানে আমলকারী ও বেআমল ব্যক্তির উদাহরণ দেওয়া হয়েছে যে, এরা দুইজন এক সমান নয়।
৫. আল্লাহ ও ফিরিশতাদের সাথে ইলমের অধিকারীদের নাম উল্লেখ
شَهِدَ اللّٰهُ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ۙ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃُ وَ اُولُوا الۡعِلۡمِ قَآئِمًۢا بِالۡقِسۡطِ ؕ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ الۡعَزِیۡزُ الۡحَکِیۡمُ ﴿ؕ۱۸﴾
আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই, আর ফেরেশতা ও জ্ঞানীগণও। তিনি ন্যায় দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তিনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। [সুরা আলে ইমরানঃ ১৮]