ইসলামে স্বামী–স্ত্রীর মাঝে সুসম্পর্ক রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম আমাদের শেখায় কিভাবে আমাদের স্বামী বা স্ত্রীর সাথে সদয় ও সম্মানের সাথে আচরণ করতে হয়। কুরআন এবং নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা অনুসরণ করে আমরা আমাদের সম্পর্ককে উন্নত করতে এবং আরও শক্তিশালী করতে পারি। এই লেখায় আমরা স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে বন্ধন দৃঢ় করার কিছু সহজ উপায় সম্পর্কে জানব।
১. সম্মানজনক ও সদয় আচরণ করা
ইসলাম আমাদের শেখায় স্বামী–স্ত্রীর প্রতি সদয় ও শ্রদ্ধাশীল হতে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা স্বামী–স্ত্রীকে সৃষ্টি করেছেন শান্তি ও ভালোবাসায় একসাথে থাকার জন্য। আমাদের উচিত সদয় আচরণ করা; সঙ্গী–সঙ্গীনিরর অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কথা বলা এড়িয়ে চলা উচিত। একে অপরের সাথে সম্মানের সাথে আচরণ করা মানে একে অপরের কথা শোনা এবং একে অপরের মতামত ও অনুভূতিকে মূল্যায়ন করা।
وَ مِنۡ اٰیٰتِهٖۤ اَنۡ خَلَقَ لَکُمۡ مِّنۡ اَنۡفُسِکُمۡ اَزۡوَاجًا لِّتَسۡکُنُوۡۤا اِلَیۡهَا وَ جَعَلَ بَیۡنَکُمۡ مَّوَدَّۃً وَّ رَحۡمَۃً ؕ اِنَّ فِیۡ ذٰلِکَ لَاٰیٰتٍ لِّقَوۡمٍ یَّتَفَکَّرُوۡنَ ﴿۲۱﴾
আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে। [সুরা রুমঃ ২১]
২. পারস্পরিক বোঝাপড়া
বিয়েতে পারস্পরিক কথাবার্তা অর্থাৎ কমিউনিকেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের একে অপরের সাথে কথা বলা এবং শোনা উচিত। যখন স্ত্রী কথা বলবে তখন স্বামীদের উচিত তাদের কথায় মনোযোগ দেওয়া, কথায় বাধা দেওয়া উচিত নয়। আমরা একে অপরের সাথে আমাদের চিন্তাভাবনা ও অনুভূতি শেয়ার করতে পারি। কথা বলা এবং শোনার মাধ্যমে, আমরা একে অপরকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারব এবং একসাথে সমস্যার সমাধান করতে পারব। মহান আল্লাহ স্বামী–স্ত্রীদের একে অপরকে সন্দেহ পোষণ করা থেকে বিরত থাকতে বলেছেন। আল্লাহ কুরআনের সুরা হুজুরাতে বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اجۡتَنِبُوۡا کَثِیۡرًا مِّنَ الظَّنِّ ۫ اِنَّ بَعۡضَ الظَّنِّ اِثۡمٌ وَّ لَا تَجَسَّسُوۡا وَ لَا یَغۡتَبۡ بَّعۡضُکُمۡ بَعۡضًا
হে মুমিনগণ, তোমরা অধিক অনুমান থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোন কোন অনুমান তো পাপ। আর তোমরা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের গীবত করো না। [সুরা হুজুরাতঃ ১২]
তাই আমাদের উচিত নয় একে অপরকে অযথা সন্দেহ করা। একটা সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে উভয়কেই অবদান রাখতে হবে।
৩. ক্ষমা ও ধৈর্যশীলতা
ইসলাম আমাদের একে অপরের প্রতি ধৈর্যশীল এবং ক্ষমাশীল হতে শেখায়। কেউই নিখুঁত নয়। আমরা সবাই ভুল করি। মনমালিন্য হলে স্বামী–স্ত্রী উভয়কেই ধৈর্য্য ধারণ করা উচিত। এ সময় আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে এবং নবি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ অনুসরণ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা সুরা আলে ইমরানে (৩:১৩৪) বলেন,
الَّذِیۡنَ یُنۡفِقُوۡنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الۡکٰظِمِیۡنَ الۡغَیۡظَ وَ الۡعَافِیۡنَ عَنِ النَّاسِ ؕ وَ اللّٰهُ یُحِبُّ الۡمُحۡسِنِیۡنَ ﴿۱۳۴﴾ۚ
যারা সুসময়ে ও দুঃসময়ে ব্যয় করে এবং ক্রোধ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন। [সুরা আলে ইমরান: ১৩৪]
বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে ক্ষমা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একে অপরের ভুল এবং ত্রুটিগুলি ক্ষমা করার মাধ্যমে, স্বামী–স্ত্রীর মাঝে পারস্পারিক সম্পর্ক ও ভালবাসা বৃদ্ধি পেতে পারে।
৪. একসাথে সুন্দর সময় কাটানো
একসঙ্গে কুয়ালিটি সময় কাটানো স্বামী–স্ত্রীর বন্ধনকে শক্তিশালী করার এক দারুণ উপায়। ইসলাম দম্পতিদের একে অপরের সঙ্গ উপভোগ করতে এবং আনন্দ ও সুখ নিয়ে আসে এমন কার্যকলাপে জড়িত হতে উত্সাহিত করে। স্বামী–স্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা এর মাধ্যমে বৃদ্ধি পায়, মানসিক ঘনিষ্ঠতাও শক্তিশালী হয়। প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“তোমাদের মধ্যে সে–ই উত্তম যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম এবং আমি আমার স্ত্রীদের কাছে তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম।“
নানাভাবেই কোয়ালিটি সময় কাটানো যায়। যেমন, এক সাথে হাঁটাহাঁটি করা, রোমান্টিক কথোপকথন করা বা একসাথে রিল্যাক্স করা ইত্যাদি। একে অপরের প্রতি সময় এবং মনোযোগ দেওয়ার মাধ্যমে দম্পতিরা একতার বোধ গড়ে তোলে এবং তাদের বৈবাহিক বন্ধনকে শক্তিশালী করে।
৫. একে–অপরকে সহায়তা করা এবং সাপোর্ট দেওয়া
ইসলাম স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সমর্থন ও সহযোগিতার গুরুত্বের ওপর জোর দেয়। স্বামী ও স্ত্রীর একে অপরের পাশে থাকা উচিত, প্রয়োজনের সময় একে অপরকে সাহায্য করা এবং সাপোর্ট দেওয়া উচিত। এই সাপোর্ট শারীরিক, মানসিক বা আধ্যাত্মিক হতে পারে। আমাদের প্রিয় নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
“সবচেয়ে নিখুঁত ঈমানের পরিচয় দেয় তারাই, যাদের আচার–আচরণ সবচেয়ে ভালো এবং তোমাদের মধ্যে তারাই উত্তম যারা তাদের স্ত্রীদের প্রতি সর্বোত্তম।“
একে অপরকে সাপোর্ট দেওয়া মানে পরিবারের দায়িত্বে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা, একে–অপরের কাজগুলো ভাগ করে নেওয়া এবং পরস্পরকে উৎসাহ প্রদান করা। এটি চ্যালেঞ্জিং ও কঠিন সময়ে স্বামী–স্ত্রী উভয়কেই মানসিক শক্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করে। স্বামী–স্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে একটি সহায়ক ও সহযোগিতার পরিবেশ লালন করার দ্বারা বিশ্বাস, দলবদ্ধ কাজ এবং সাহচর্যের ভিত্তি তৈরি করে।
৬. একসাথে আল্লাহর ইবাদত করা
স্বামী–স্ত্রীর একসাথে ইবাদত করা আল্লাহর সাথে এবং একই সাথে একে–অপরের সাথে সম্পর্ককে শক্তিশালী করার একটি সুন্দর উপায়। দৈনিকের সালাত এবং দুআ একত্রে করলে সেটা স্বামী–স্ত্রীর মধ্যে একটি আধ্যাত্মিক বন্ধন তৈরি করে। এ সময় তারা দুজন আল্লাহর কাছে পরিবারের জন্য আল্লাহর আশীর্বাদ, নির্দেশনা এবং সুরক্ষা চায়। আল্লাহ সুরা আন–নুরে (২৪:৩৭) বলেন,
رِجَالٌ ۙ لَّا تُلۡهِیۡهِمۡ تِجَارَۃٌ وَّ لَا بَیۡعٌ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰهِ وَ اِقَامِ الصَّلٰوۃِ وَ اِیۡتَآءِ الزَّکٰوۃِ ۪ۙ یَخَافُوۡنَ یَوۡمًا تَتَقَلَّبُ فِیۡهِ الۡقُلُوۡبُ وَ الۡاَبۡصَارُ ﴿٭ۙ۳۷﴾
ঐ সব লোকের দ্বারা ব্যবসায় ও ক্রয়–বিক্রয় যাদেরকে তাঁর স্মরণ হতে বিচ্যুত করতে পারে না, আর নামায প্রতিষ্ঠা ও যাকাত প্রদান থেকেও না। তাদের ভয় করে (কেবল) সেদিনের যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ উল্টে যাবে। [সুরা নুরঃ ৩৭]
যখন দম্পতিরা এক যোগে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, তখন সেই দুআ আল্লাহর কাছে কবুলের সম্ভাবনাও অনেক বেশি বেড়ে যায়। এ জন্য স্বামী–স্ত্রীকে আল্লাহর কাছে একসাথে তার রহমত ও বারাকাহ চেয়ে দুআ করতে হবে। এটি নম্রতা, কৃতজ্ঞতা এবং আল্লাহর উপর নির্ভরতা বৃদ্ধি করে। একসাথে ইবাদত করাকে নিজেদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বানানোর মাধ্যমে দম্পতিরা তাদের ইমানকে শক্তিশালী করে। তারা উভয়ে আল্লাহর আরো নৈকট্যশীল হয়।
স্বামী–স্ত্রীর সম্পর্ক কিভাবে উন্নত করা যায় সে বিষয়ে মূল্যবান নির্দেশনা প্রদান করে ইসলাম। তাই নিজেদের জীবনে কুরআনের শিক্ষাগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটাতে হবে। রাসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহর অনুসরণ করতে হবে। এতে স্বামী–স্ত্রীর মধ্যেকার মনোমালিন্য কেটে যাবে, সম্পর্ক হবে আরো অনেক সুন্দর। বর্তমানে তালাকের হার অনেক বেড়ে গিয়েছে। আমরা যদি নিজেদের জীবনে ইসলামের শিক্ষাগুলোকে ব্যবহার করতে পারি, কাজে লাগাতে পারি তাহলে সকল ক্ষেত্রেই সফল হতে পারব। এর মাধ্যমে দম্পতিরা দয়া, সম্মান, যোগাযোগ, ধৈর্য, ক্ষমা, কুয়ালিটি সময় দেওয়া, সাপোর্ট দেওয়া এবং সালাত ও ইবাদতের উপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী এবং প্রেমময় বন্ধন তৈরি করতে পারে। এই ইসলামি নীতিগুলো দম্পতিদের তাদের বিয়ের মধ্যে প্রেম, সম্প্রীতি এবং প্রশান্তি গড়ে তোলার জন্য একটি উপায় খুলে দেয়। আল্লাহ সকল বিবাহিত দম্পতিদের ওপর রহমত নাজিল করুন এবং তাদের সম্পর্কে সুখ ও সাফল্য দান করুন।