ঢাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশে যাওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দেড় শতাধিক বাংলাদেশি শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে কলেরা ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ পাওয়া গেছে। কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—দুই দেশে ইতিমধ্যেই ১৮০ জন অসুস্থ হওয়ার কথা জানা গেছে। কয়েকজন যাত্রী বলছেন, যাত্রার আগে বিমানবন্দরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে। বিমানবন্দরের ভেতরের রেস্তোরাঁয় দাম বেশি হওয়ায় খরচ বাঁচাতে বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকার খাবার খেয়ে তাঁরা অসুস্থ হচ্ছেন। দীর্ঘ সময় অপেক্ষার কারণে বাসা থেকে আনা খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রবাসী ব্যক্তিদের অসুস্থতার বিষয়টি বেড়ে যাওয়ায় সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার দূতাবাস বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে রওনা দেওয়া শ্রমিকেরা ডায়রিয়া, পেটব্যথা, বমি ও কলেরাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কয়েকজন শ্রমিক উড়োজাহাজের মধ্যেই অসুস্থ হয়েছেন। গন্তব্যস্থলের বিমানবন্দরে বা কাজে যোগ দেওয়ার পরও অসুস্থ হচ্ছেন অনেকে।গত বুধবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বলেন, প্রবাসী শ্রমিকদের অসুস্থ হওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে তিনি জেনেছেন। তবে এটি খুব বড় আকারের নয়। তিনি বলেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১২০ জন ও কাতারে ৬০ জন অসুস্থ হওয়ার কথা জানা গেছে। সরকার বলছে, বিমানবন্দর ও এর আশপাশের এলাকার রেস্তোরাঁগুলোতে পানি ও খাবারের মান যাচাই করার উদ্যোগ শিগগিরই নেওয়া হবে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনালের সংস্কারকাজের কারণে যাত্রীদের আসতে হচ্ছে যাত্রার পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা আগে। আর সংযুক্ত আরব আমিরাতগামী ব্যক্তিদের করোনা পরীক্ষার জন্য বিমানবন্দরে আসতে হচ্ছে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা আগে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা যাত্রীদের বিমানবন্দরে থাকতে হচ্ছে ১২ ঘণ্টার বেশি। এই দীর্ঘ সময়ে যাত্রীদের বাধ্য হয়ে বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকার খাবার ও পানীয় খেতে হচ্ছে। এসব খেয়ে প্রবাসে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলে মনে করছেন যাত্রীরা।
খরচ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার খাচ্ছেন প্রবাসী শ্রমিকেরা
বিমানবন্দরের ভেতরের রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের দাম অনেক বেশি। কয়েকজন প্রবাসী শ্রমিক বলেন, খরচ বাঁচাতে বাধ্য হয়েই অস্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হচ্ছে তাঁদের।নারায়ণগঞ্জের বন্দর থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সকালে এসেছেন মো. লিটন। আমিরাতগামী এই যাত্রীর ফ্লাইট রাত ৯টা ২০ মিনিটে। তিনি দুপুরে বিমানবন্দরের বহুতল কার পার্কিং ভবনের ছাদে বসে বাসা থেকে আনা খিচুড়ি খাচ্ছিলেন। লিটন বলেন, ‘আমিরাতে যেতে হলে বিমানবন্দরে করোনা পরীক্ষা লাগে। এ জন্য এত আগে বিমানবন্দরে এসেছি। খাবারটা একটু গন্ধ লাগছে। ভেতরে খাবারের অনেক দাম। এ কারণে গন্ধ লাগলেও খেয়েছি।’লিটন আরও বলেন, ‘খবরে দেখলাম শ্রমিকেরা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমি ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছি। রাতে ফ্লাইট। পৌঁছাব কাল। এই দুই দিনে শরীর ক্লান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কোনো উপায় তো নেই, বাধ্য হয়ে খাচ্ছি।’কুমিল্লা থেকে ভোরে বিমানবন্দরে এসেছেন আবদুল হামিদ। তিনিও দুবাইগামী যাত্রী। ফ্লাইট রাতে। বেলা তিনটার দিকে বিমানবন্দর গোলচত্বর থেকে কিনে আনা বিরিয়ানি খাচ্ছিলেন তিনি। আবদুল হামিদ বলেন, ‘প্রবাসীদের এত কষ্ট, এটা বলার বাইরে। এই তৈলাক্ত খাবারে পেটের সমস্যা হতে পারে জানি। কিন্তু করার তো কিছুই নেই। স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের উদ্যোগ নেওয়া হলে ভালো হতো।’
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে ‘কম দামি খাবার খাবেন না’
শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বিমানবন্দরের বহুতল কার পার্কিংয়ের দোতলায় করোনা পরীক্ষাগারে যাত্রীদের সুবিধার জন্য চারটি খাবারের দোকান আছে। এ ছাড়া বিমানবন্দরের ভেতরেও কিছু খাবারের দোকান আছে। এসব দোকানের খাবার নিয়মিত তদারক করা হয়।শাহজালাল বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ এইচ এম তৌহিদ-উল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিমানবন্দরে ভেতরে যেসব রেস্তোরাঁ আছে, সেগুলো আমরা নিয়মিত চেক করছি। স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের আলাদা শাখা আছে এগুলো দেখভালের জন্য। পাশাপাশি পিসিআর পরীক্ষাগারে যে চারটি খাবারের দোকান আছে, সেগুলোও তদারকির মধ্যে আছে।’বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক বলেন, এসব রেস্তোরাঁয় কোনো পচা-বাসি খাবার খাওয়ানো হয় না। বিমানবন্দরের আশপাশের রেস্তোরাঁর কোনো খাবার নিতে দেওয়া হচ্ছে না বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, যাত্রীরা যেন কম দামে খারাপ খাবার না খান, এ বিষয়ে সচেতনতা দরকার। বিমানবন্দরে অবশ্য বেশিক্ষণ না খেয়েও থাকা যাবে না। স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন থেকে যাত্রীদের গুণগত খাবার খেতে হবে।
সরকারি পদক্ষেপ
সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ বিদেশগামী বাংলাদেশিদের কলেরা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ রোধে ব্যবস্থা নিতে আন্তমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব এশিয়া) মাশফি বিনতে শামস বলেন, মূলত বিমানবন্দর ও আশকোনা এলাকার পানি পান করার কারণেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শ্রমিকেরা। তবে এ নিয়ে গভীর উদ্বেগের কিছু নেই।গতকাল বেলা ১১টার দিকে শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। অভিযানে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়া দই বিক্রির অপরাধে এয়ারপোর্ট রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। তবে এয়ারপোর্ট রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপক গাজী আহমেদ উল্লাহ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, রেস্তোরাঁটির রান্নাঘরে মাছ পরিষ্কার করার জন্য মোটা দানার লবণ রাখায় তাঁদের জরিমানা করা হয়েছে। এ ছাড়া চকলেট, কেক, চিপস পণ্য ছাড়পত্র সনদ ছাড়াই বিক্রয়ের অপরাধে এয়ারপোর্ট স্ম্যাকসকে ১ লাখ টাকা, শীতল পাটি লাউঞ্জকে ১ লাখ টাকা, শর্মা হাউসকে ৫০ হাজার টাকা ও ফারুক স্টোরকে ২৪ হাজার টাকা জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।এ ছাড়া বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং পরিদর্শন করে তাঁদের বিভিন্ন বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ অভিযানে হজ ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় প্রায় ১০০ অবৈধ পানির জার ধ্বংস করা হয়।