দেশের শীর্ষ দুই ব্যবসায়ী গ্রুপ একে অপরের ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা নিয়েছে। যার অনাপত্তি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আরও অনেক গ্রুপ নিজেদের সুদ মওকুফ করে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এর সবই বেসরকারি ব্যাংকের ঋণ।
এমন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা জারি করে বলেছে, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো আয় খাত বিকলন করে সুদ মওকুফ করতে পারবে না। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলো আগের আয় থেকে সুদ মওকুফ করতে পারবে। ফলে সুদ মওকুফ সুবিধা নিতে কয়েকটি গ্রুপ যে অপতৎপরতা শুরু করেছে, তাদের সুবিধা করে দিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ব্যাংকের পরিচালক, তাঁদের পরিবারের সদস্য ও পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে।
ব্যাংক পরিচালকদের অশুভ জোট
ব্যাংক পরিচালকেরা আগে নিজের ব্যাংক থেকে ইচ্ছেমতো ঋণ নিতেন। পরে আইনি বাধার কারণে সেই সুযোগ কমে যায়। এরপর শুরু হয় এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের আঁতাতের মাধ্যমে সীমার বেশি ঋণ নেওয়া। যার মাধ্যমে উভয় ব্যাংকের পরিচালকদের মধ্যে গড়ে ওঠে অশুভ জোট। এখন সেই পরিচালকেরা ‘অশুভ আঁতাত’–এর মাধ্যমে একে অপরের ঋণের পুরো সুদ মওকুফ করে নিচ্ছেন।
সম্প্রতি চট্টগ্রামভিত্তিক একটি গ্রুপের সব ঋণের সুদ মওকুফ করে দিয়েছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। আবার রাজধানীর একটি গ্রুপের ঋণের সুদ মওকুফ করে দিয়েছে ইসলামী ধারার ফার্স্ট সিকিউরিটি, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো পড়ছে ঝুঁকিতে। আর সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে পড়েছে জনগণের আমানত।
কারণ, ব্যাংকগুলো যেসব সুদ মওকুফ করছে, তা বেশ আগের। এসব সুদ ব্যাংকগুলো আয় খাতে নিয়ে মুনাফা করেছে, এর বিপরীতে সরকারকে করও দিয়েছে। আবার এই মুনাফা থেকে শেয়ারধারীদের লভ্যাংশও দিয়েছে। ফলে ব্যাংকগুলো কোন হিসাব থেকে এই মওকুফ সুদ সমন্বয় করবে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক এসব জেনে কোনো ব্যবস্থা তো নিচ্ছেই না, উল্টো নীরব সমর্থন দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে অনুমোদনও দিচ্ছে।
কার কত সুদ মওকুফ
সংকটে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংক চট্টগ্রামের একটি গ্রুপের ৭ গ্রাহকের ২ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা টাকার সুদ মওকুফ করেছে। ফলে এই ৭ প্রতিষ্ঠানের থাকা ৪ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা শোধ করতে হবে। ইতিমধ্যে মূল ঋণ শোধ করে করে ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বের হয়ে গেছে গ্রুপটি।
এর আগে বিভিন্ন শর্ত দিয়ে এক দিনেই সাত গ্রাহকের সুদ মওকুফ করার বিষয়ে অনাপত্তি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এসব সুদ গত ১০ বছরে আরোপ করা হয়েছিল। ন্যাশনাল ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার গুলশান শাখা ২০০৩ সাল থেকে বিভিন্ন সময় এই সাত প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়।
আর ফার্স্ট সিকিউরিটি, গ্লোবাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক মিলে এক পরিবারের দুই হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ করেছে। এর বড় অংশ বিদ্যুৎ খাতের ঋণের সুদ। এর মধ্যে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক একাই সুদ মওকুফ করেছে ১ হাজার ৪২৯ কোটি টাকা। ফলে মূল ঋণ রয়েছে ৫২০ কোটি টাকা। এ কারণে এই ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
সাধারণত ব্যাংকের ঋণ ও সুদকে আলাদা করে হিসাব করা হয় না। এখন মওকুফ করার জন্য সুদের আলাদা হিসাব বের করে মওকুফ করছে ব্যাংকগুলো।
সুবিধা পেল প্রভাবশালী গোষ্ঠী
এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নূরুল আমিন ৪০ বছর ব্যাংকিং পেশা শেষে অবসরে গেছেন। একসময় ন্যাশনাল ব্যাংকেও ছিলেন। ব্যাংক ও গ্রাহকের নাম না জানিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা হলে তিনি বলেন, এটা নৈতিকভাবে ও বাস্তবে সম্ভব না। এভাবে ১০ বছরের সুদ মওকুফ করার কোনো নজিরও নেই। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, মালিক চালাতে না পারে বা মারা যায়, তাহলে সুদ মওকুফ করা যায়। তবে পুরোটা না। যে সুদ ব্যাংক আয় হিসেবে নিয়েছে, এর বিপরীতে সরকারকে কর দিয়েছে ও শেয়ারধারীদের লভ্যাংশ দিয়েছে, তা মওকুফের কোনো সুযোগ নেই। এর পেছনে বড় কোনো প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও বড় স্বার্থ জড়িত রয়েছে, এ জন্যই এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে।