এক দশকেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলার কূলকিনারা হয়নি। হত্যায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার বা শনাক্ত করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা। তদন্তেও নেই অগ্রগতি। কবে রহস্য উদ্ঘাটন হবে এ হত্যার কেউ বলতে পারছেন না।
শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এই সময়ে একাধিক সংস্থার হাত বদলেও দাখিল হয়নি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন। বরং প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৮৫ বার সময় নিয়েছে তদন্তকারী সংস্থাগুলো।
দীর্ঘ সময়েও তদন্ত শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন সাগর-রুনির পরিবার। সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘১০ বছর হয়ে গেল। এখনও সন্তান হত্যার বিচার পেলাম না। মামলার তারিখ আসে আর যায়। কোনো কাজ হয় না।
প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘মুজিববর্ষে অনেক কিছু হচ্ছে। মুজিববর্ষে সাগর-রুনি হত্যার সুরাহা করতে পারলে এটা মাইলফলক হয়ে থাকবে’।
তিনি বলেন, ‘সন্তান হত্যার বিচার পেলাম না। কবরের পাশে গিয়ে কী বলব, বিচার হচ্ছে না। তবে বিচার একদিন হবেই। আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, আমার শেষ নিঃশ্বাস থাকা পর্যন্ত আমি সাগর-রুনি হত্যার বিচার চেয়ে যাব। দুনিয়ার বিচার না হলেও ওপরে যিনি আছেন তিনি অবশ্যই বিচার করবেন’।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি খুন হন। ১২ ফেব্রুয়ারি রুনির ভাই নওশের আলী রোমান বাদী হয়ে শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন।
প্রথমে মামলাটির তদন্ত করে শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ। পরে তদন্তভার পড়ে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ওপর। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিনের মাথায় হাইকোর্টে ব্যর্থতা স্বীকার করে ডিবি। এরপর আদালত র্যাবকে মামলার তদন্তের নির্দেশ দেয়। সেই থেকে র্যাব মামলাটি তদন্ত করছে।
তদন্তভার পেয়েই ভিসেরা পরীক্ষার জন্য কবর থেকে সাগর-রুনির লাশ উত্তোলন করে র্যাব। ভিসেরা পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, তাদের মৃত্যুর আগে কোন প্রকার বিষাক্ত বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করা হয়নি। ছুরিকাঘাতে রক্তক্ষরণ ও আঘাতের কারণে তাদের মৃত্যু হয়েছে।
তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব সদর দপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) শফিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হয়।
তিনি বলেন, এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। মিডিয়া উইংয়ে জানতে বলেন তিনি। কেউ শনাক্ত হয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি ফের বলেন, সরি, কিছু বলতে পারব না।
বহুল আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের পর মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় তদন্ত শেষ করার আশ্বাস দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। তবে ১০ বছর পেরিয়ে একাধিক সংস্থার হাত বদলেও দাখিল হয়নি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে এরইমধ্যে আদালত থেকে ৮৫ বার সময় নেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৪ জানুয়ারি এই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি র্যাব। বরং আবারও সময় চেয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
শুনানি নিয়ে আদালত আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নতুন দিন ধার্য করে দেন। এইদিন প্রতিবেদন দাখিল করা হবে কি না, সেটিও নিশ্চিত নন তদন্ত কর্মকর্তা। মামলাটির তদন্ত শেষ করতে বিলম্ব করায় এর আগে দুটি পৃথক আদালত অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
পুলিশের আগের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাগর-রুনি হত্যাকান্ডের ঘটনায় দুইজন অপরিচিত ব্যক্তি জড়িত ছিল। সাগরের হাতে বাঁধা চাদর এবং রুনির টি-শার্টে ওই দুই ব্যক্তির ডিএনএর প্রমাণ মিলেছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীদের শনাক্ত করতে ডিএনএ রিপোর্ট প্রস্তুতকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটি ল্যাবে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। প্রতিষ্ঠান দুটি ডিএনএর মাধ্যমে অপরাধীর ছবি বা অবয়ব প্রস্তুতের কাজ করে যাচ্ছে। চুরি হওয়া ল্যাপটপ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এ ঘটনায় গ্রেপ্তার আটজনের মধ্যে ছয়জন কারাগারে আছে। অন্য দুজন জামিনে আছেন।
হত্যাকাণ্ডের পরপরই জড়িত সন্দেহে রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান ওরফে অরুন, আবু সাঈদ, দুজন নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও এনামুল হক এবং সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তীতে তানভীর ও পলাশ জামিনে মুক্ত হয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। বাকিরা এখনও কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে সাংবাদিক সমাজ ও নিহতদের স্বজনরা অপেক্ষায় আছেন তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল হলেই হয়তো তার ভিত্তিতে শুরু হতে পারে এই চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার বিচার কাজ, এমনটাই মনে করছেন তারা।
প্রতিবারের মতো এবারও নানান কর্মসূচি পালন করবে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ)। তিন দিনব্যাপী কর্মসূচির প্রথম দিন বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টায় ডিআরই চত্বরে মোমবাতি প্রজ্বলন করা হয়।