টেকনাফ পৌরসভার ওপরেই বাজার। দুপুর ১২টার কাছাকাছি। আল মদিনা চা-দোকানে ১৩ থেকে ১৪ জন ক্রেতা।কেউ চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। কেউ ফরমাশ দিয়ে চাসহ অন্য খাবারের অপেক্ষায়বাজারের মাছ বিক্রেতা সাহাব উদ্দিন (৩৫) চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘দোষ বেশি গল্ল্যি ধরা খাইবু। হেতল্লাই পদীবুরও এই দশা অইয়্যিদে। পাপ বাপরেও ন ছাড়ে।’ (অপরাধের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে ধরা পড়বেই। প্রদীপেরও এই দশা হয়েছে। পাপ বাপকেও ছাড়ে না)।সাহাব উদ্দিনের কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে পাশে থাকা শুক্কুর আলী (৩০) বললেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রদীপের ফাঁসির রায় হয়েছে। টেকনাফের মানুষ এ রায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাঁর আতঙ্কে টেকনাফের মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল, কখন কাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে!
শুক্কুর আলীর পাশে থাকা হোটেল কর্মচারী সেলিম (২৮) বলে ওঠেন, এখন দ্রুত রায় কার্যকর হলেই হয়।সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার রায় কক্সবাজার আদালতের ঘোষণার দুই দিন পর টেকনাফের মানুষের আড্ডা-আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু এই থানার বরখাস্ত হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ। গত বুধবার টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া যায়।৩১ জানুয়ারি ঘোষিত রায়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড দেন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। এ ছাড়া রায়ে ছয়জনকে দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
ক্ষোভের সঙ্গে জাহাঙ্গীর বলেন, ২০২০ সালের জুনে তাঁর বাবার দুই চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দেন ওসি প্রদীপ। বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বাসস্টেশনে সড়কের ওপর গাড়ির ইঞ্জিনের কাজ করছিলেন। সেই থেকে তাঁর বাবা চোখে কম দেখেন। তাই এখন তাঁকে বাধ্য হয়ে চশমা পরতে হয়।প্রায় আধঘণ্টা ওই দোকানে বসে দেখা গেল, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অন্তত ৩০ জন লোক প্রদীপের অতীত কর্মকাণ্ড ও ফাঁসির রায় নিয়ে আলোচনা করেছেন।শুধু ওই চা-দোকানই নয়, টেকনাফের বিভিন্ন বাজার, বাসস্টেশন, টমটম স্টেশন—যেখানেই মানুষের জমায়েত, সেখানেই ঘুরেফিরে প্রদীপকে নিয়ে আলোচনা।রায়ের পর টেকনাফ মডেল থানা, মেরিন ড্রাইভ সড়কসহ টেকনাফের অন্তত ২০টি জায়গায় গিয়ে একইভাবে শোনা যায় প্রদীপ–সম্পর্কিত কথাবার্তা।আড্ডা-আলোচনায় লোকজনের মনোভাব হলো, প্রদীপসহ দুই আসামির ফাঁসির আদেশ হওয়ায় তাঁরা খুশি। এই রায় দ্রুত কার্যকর চান তাঁরা। তা না হলে টেকনাফবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসবে না।
ওসি হিসেবে প্রদীপ টেকনাফ মডেল থানায় যোগ দেন ২০১৮ সালের ২০ অক্টোবর। থানায় তাঁর যোগ দেওয়ার চার দিনের মাথায় টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মফিজ আলম নামের এক ব্যক্তি নিহত হসিনহা হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগপর্যন্ত প্রায় দুই বছর টেকনাফে প্রদীপের কর্মকালে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন মোট ১৪৪ জন।ওসি প্রদীপ দুই চোখে আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে আহত করা টেকনাফ পৌরসভার জালিয়াপাড়ার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব মো. সাদেকের সঙ্গে কথা হয়। নির্মাণশ্রমিক জাহাঙ্গীরের বাবা সাদেক টেকনাফ বাসস্টেশন এলাকার একটি গ্যারেজে কাজ করেন। তিনি বলেন, ভয়ে এত দিন মামলা করেননি। এখন তিনি প্রদীপের বিচার চান।টেকনাফ পৌরসভার শাপলা চত্বরে টমটম ও দোয়েল কারস্ট্যান্ড। সেখানে গিয়েও চালক-যাত্রীদের মুখে শোনা যায় প্রদীপের নানা অপকর্মের কথা। টমটমচালক সুজন বড়ুয়া বলেন, প্রদীপের নির্যাতনের শিকার হওয়া অনেক ব্যক্তি তাঁর গাড়ির যাত্রী ছিলেন। তাঁদের মুখে তিনি প্রদীপের অনেক নৃশংসতার কথা শুনেছেন।
বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টেকনাফ মডেল থানার সামনে কথা হয় সাবরাং ইউনিয়ন থেকে আসা কুলছুমা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর এক প্রতিবেশী জমি দখল নিয়ে তাঁকে নির্যাতন করে আসছেন। প্রদীপ ওসি থাকাকালে ভয়ে তিনি থানায় অভিযোগ জানাতে আসেননি। এখন ভয় কেটে গেছে, তাই এসেছেন।
একই সময় নানা অভিযোগ নিয়ে টেকনাফ থানায় আসা আরও অন্তত পাঁচ ব্যক্তি জানিয়েছেন, ভয়ভীতি কেটে যাওয়ায় এখন তাঁরা থানায় প্রতিকার চাইতে এসেছেন।থানায় ঢুকে দেখা যায়, কর্তব্যরত কর্মকর্তার কক্ষে দর্শনার্থীদের ভিড়। তাঁদেরও প্রায় একই কথা, প্রদীপ থাকাকালে তাঁরা থানায় ঢুকতে সাহস পাননি।
জানতে চাইলে কর্তব্যরত কর্মকর্তা টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রোকসানা মোজাফফর বলেন, লোকজনের থানায় আসতে কোনো বাধা নেই।
ভয়ভীতিরও কোনো কারণ নেই।থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবদুল আলীমকে পাওয়া যায় তাঁর কক্ষে। প্রদীপের ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা জনসমক্ষে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন কি না, এ বিষয়ে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।থানার সামনে ২৫ বছর ধরে নারকেল ও ঝুড়ি বিক্রি করে আসছেন বৃদ্ধ আবদুল গফুর। তিনিবলেন, প্রদীপ থানায় যোগ দেওয়ার পর পা দিয়ে মুড়িয়ে তাঁর দোকানের সব জিনিস নষ্ট করে দেন। তখন ভয়ে তিনি দোকান ছেড়ে চলে যান। সিনহা হত্যায় প্রদীপ গ্রেপ্তারের পর তিনি আবার দোকান শুরু করেছেন।
আবদুল গফুর বলেন, প্রদীপ থাকার সময় বন্দুকযুদ্ধে নিহত ব্যক্তি ও নির্যাতিত লোকজনের স্বজনেরা থানার সামনে এসে অসহায়ের মতো কান্না করতেন। এমন অনেক ঘটনা দেখেছেন তিনি। কিন্তু এখন আর থানার সামনে এ ধরনের দৃশ্য চোখে পড়ে না।