ইউক্রেন যুদ্ধের এক মাস পূর্ণ হতে চলছে। এই যুদ্ধে রাশিয়ার কতজন সেনা এখন পর্যন্ত হতাহত হয়েছেন, তা নিয়ে একধরনের ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে।চলমান এই যুদ্ধের এক পক্ষ ইউক্রেন। তারা রুশ সেনাদের হতাহতের যে হিসাব দিচ্ছে, তাকে অনেকটা অতিরঞ্জিত মনে করছেন পশ্চিমা গোয়েন্দারা।ইউক্রেনে রুশ সেনাদের হতাহতের বিষয়ে মস্কো খুব কম কথাই বলছে। তারা রুশ সেনাদের হতাহতের যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, তা প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে অনেক কম বলা মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, পশ্চিমারা রুশ সেনাদের হতাহতের বিষয়ে যে তথ্য দিচ্ছে, তাকেও একদম নিশ্চিত বলে ধরে নেওয়ার উপায় নেই। খোদ পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোই এ ক্ষেত্রে বলছে, তারা এই তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারেনি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশের পরই ইউক্রেনে সর্বাত্মক হামলা শুরু করেন রুশ সেনারা।খুব সহজেই কিয়েভ দখল করা যাবে বলে ভেবেছিলেন পুতিন। কিন্তু তাঁর এমন ভাবনা মারাত্মক ধাক্কা খেয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর অগ্রগতি আশানুরূপ নয়। তারা ইউক্রেনে তীব্র প্রতিরোধের মুখোমুখি হচ্ছে। সেই সঙ্গে ব্যাপক শক্তিক্ষয় হচ্ছে।
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার কতজন সেনা নিহত ও আহত হয়েছেন, সে সম্পর্কে প্রায় তিন সপ্তাহ আগে তথ্য দিয়েছিল মস্কো। চলতি মাসের শুরুর দিকে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছিল, ইউক্রেনে ৪৯৮ জন রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন ১ হাজার ৫০০ সেনা। তারপর আর এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি রাশিয়া।নিজেদের সেনাদের হতাহতের বিষয়ে রাশিয়ার সরকারি পরিসংখ্যানকে সন্দেহের চোখে দেখছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। তা সত্ত্বেও তাঁরা বলছেন, যুদ্ধ শুরুর মাত্র ১০ দিনে যত সেনা হতাহত হয়েছেন বলে মস্কো প্রকাশ্যে স্বীকার করেছে, সেটাও রাশিয়ার জন্য বড় ক্ষতি।
ক্রেমলিন রুশ সেনাদের হতাহতের হালনাগাদ তথ্য না দেওয়ায় দেশটিতে ‘তথ্যগত শূন্যতা’ তৈরি হয়েছে। রুশ সেনাদের হতাহতের বিষয়ে রাশিয়ায় গুজব ছড়িয়ে পড়ছে। শত শত বা হাজার হাজার সেনা ইউক্রেনে নিহত হয়েছেন বলে রাশিয়ায় কানাঘুষা চলছে।প্রেসিডেন্ট পুতিন গত সপ্তাহের শেষ দিকে অভিযোগ করে বলেছিলেন, পশ্চিমারা সম্মিলিতভাবে রুশ সমাজকে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে। তারা সামরিক ক্ষয়ক্ষতি, নিষেধাজ্ঞার আর্থসামাজিক পরিণতি সম্পর্কে গুজব ও জল্পনা ছড়িয়ে রুশ নাগরিকদের মধ্যে বিদ্রোহ উসকে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। রাশিয়াকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে পশ্চিমারা ‘ফিফথ কলাম’ ব্যবহার করছে।রুশ সংবাদমাধ্যমেও দেশটির সেনাদের হতাহতের বিষয়ে তেমন একটা তথ্য আসছে না। এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য রাশিয়ার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলে, তাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করছেন দেশটির কর্মকর্তারা। তা ছাড়া ক্রেমলিনের রোষে পড়ার ভয়ে রুশ সংবাদমাধ্যমগুলো রাশিয়ার সেনাদের হতাহতের তথ্য প্রচার কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে গত সোমবার রাশিয়ান ট্যাবলয়েড ‘কমসোমলস্কায়া প্রাভদা’ একটি প্রতিবেদন অনলাইনে প্রকাশ করে। ক্রেমলিনপন্থী প্রতিবেদন প্রচারের জন্য পরিচিত ট্যাবলয়েডটি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যের বরাত দিয়ে জানায়, ইউক্রেনে ৯ হাজার ৮৬১ রুশ সেনা নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১৬ হাজার ১৫৩ জন।প্রতিবেদনটি অনলাইনে প্রকাশের কয়েক মিনিটের মধ্যেই রুশ সেনাদের হতাহতের তথ্য মুছে দেওয়া হয়। তবে এই প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়ে যায়।
পরে পত্রিকাটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, তাদের ওয়েবসাইট হ্যাক করে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ অভিযান সম্পর্কে একটি ভুয়া তথ্য পোস্ট করা হয়েছিল। তারা দ্রুত সেই তথ্য মুছে ফেলেছে।রাশিয়ার অন্য কোনো সংবাদমাধ্যম ‘কমসোমলস্কায়া প্রাভদা’ ট্যাবলয়েডে প্রকাশিত রুশ সেনাদের হতাহতের তথ্যের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি।বেশ কিছু রুশ সামরিক বিশ্লেষকও কমসোমলস্কায়া প্রাভদার প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা ক্রেমলিনের দিক থেকে শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাশিয়ার এক সামরিক ভাষ্যকার বলেন, ‘এটি একটি রাষ্ট্রীয় গোপনীয় বিষয়। কত সেনা মারা গেছেন, তার সঠিক সংখ্যা আমরা জানি না। তার চেয়ে বরং অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করা ভালো।’গত মঙ্গলবার ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, হতাহতের পরিসংখ্যান প্রকাশ করাটা রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একচেটিয়া বিশেষাধিকার। তারা প্রথম থেকেই বলে আসছে যে, ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানে রুশ সেনাদের হতাহতের বিষয়ে কথা বলার এখতিয়ার তাদের নেই।ইউক্রেন যুদ্ধে সেনা হতাহতের বিষয়ে মস্কো যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, প্রকৃত সংখ্যা তার ১০, ২০ বা ৩০ গুণ বেশি বলে দাবি কিয়েভের। ইউক্রেনের কর্মকর্তারা গত সোমবার সন্ধ্যায় দাবি করেন, যুদ্ধে ১৫ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছেন।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে রেডিও ফ্রি ইউরোপ এক প্রতিবেদনে দাবি করে, মাত্র কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে প্রতিবেশী বেলারুশের হাসপাতালগুলোর মর্গ রুশ সেনাদের লাশে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। প্রতিবেদনটিতে বেলারুশের একটি আঞ্চলিক হাসপাতালের এক কর্মচারীকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। যাঁর ভাষ্য, ১৩ মার্চ পর্যন্ত বেলারুশের এই অঞ্চল থেকে ২ হাজার ৫০০ জনের বেশি রুশ সেনার লাশ রাশিয়ায় পাঠানো হয়েছে।বিবিসি রাশিয়া গত সোমবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, তারা ৫৫৭ রুশ সেনার মৃত্যুর বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছে।
ন্যাটোর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিসি নিউজকে বলেছেন, সর্বশেষ গোয়েন্দা তথ্য মূল্যায়নের ভিত্তিতে এই সামরিক জোট ধারণা করছে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম মাসে ৪০ হাজার পর্যন্ত রুশ সেনা নিহত, আহত, বন্দী বা নিখোঁজ হয়েছেন। এর মধ্যে ৭ থেকে ১৫ হাজার রুশ সেনা নিহত হয়েছেন।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউক্রেন যুদ্ধে ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি রুশ সেনা যুক্ত আছেন। ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যত সেনা নিহত হয়েছেন, তার চেয়ে বেশি সেনা চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে হারিয়েছে রাশিয়া। এই সংখ্যা ৭ হাজারের বেশি। আহত হয়েছেন ১৪ থেকে ২১ হাজার রুশ সেনা।
ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ সেনাদের লাশের মিছিল বেড়েই চলছে বলে এক প্রতিবেদনে জানায় সিএনএন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এই যুদ্ধে প্রাণহানির প্রকৃত সংখ্যা গোপন করছে ক্রেমলিন। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কর্মকর্তারা সিএনএনকে বলেছেন, যুদ্ধে রুশ সেনাদের হতাহতের সংখ্যা ৩ থেকে ১০ হাজারের মধ্যে হবে। অবশ্য ইউক্রেনের কর্মকর্তাদের মতে, এই সংখ্যা আরও বেশি হবে এবং তা ১৫ হাজারের বেশি। তবে এসব তথ্য যাচাই করতে পারেনি সিএনএন।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ সেনাদের নিহত হওয়া–সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করতে অস্বীকার করেছে। দেশটির এক জ্যেষ্ঠ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ইউক্রেনের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সেনা নেই। তাই সেখানে হতাহতের বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া পেন্টাগনের পক্ষে কঠিন।ইউক্রেন যুদ্ধে রুশ সেনাদের হতাহতের বিষয়ে মস্কো, কিয়েভ, ন্যাটোসহ বিভিন্ন পক্ষের দাবির বিষয়ে সতর্ক মন্তব্য করার পক্ষপাতি নিরপেক্ষ সামরিক বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ওপর জোর দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। অন্যদিকে, রাশিয়া তার সেনাদের হতাহতের তথ্য চাপিয়ে রাখার পাশাপাশি কমিয়ে দেখাতে সচেষ্ট। তাই কোনো পক্ষের দাবিকেই নিশ্চিত বলে ধরা নেওয়ার উপায় নেই।