কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কোলঘেঁষা হোটেল-মোটেল এলাকা কলাতলী। এর মূল সড়কের পাশে পাহাড়ের ঢালে তৈরি করা হয়েছে একটি আবাসন প্রকল্প। দেশের বন আইন ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পাহাড়ি এই বনভূমি আবাসনের জন্য ব্যবহার করার কথা নয়। অথচ সংরক্ষিত বন ঘোষিত এলাকায় প্রকল্পটি কক্সবাজারের জেলা প্রশাসনেরই।
জেলা প্রশাসনের প্রকল্পটি বাতিলের পাশাপাশি ওই বনভূমি এলাকার সব বসতি উচ্ছেদ করতে এক দশক আগে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসককে (ডিসি) নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। তবে এখনো এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।১৯৯৯ সালে কক্সবাজারের কলাতলীসংলগ্ন ঝিলংজা মৌজার ১২৪ একর এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে সরকার। ৫১ একর জমি নিয়ে জেলা প্রশাসনের প্রকল্পটি এই এলাকার মধ্যে পড়েছে। ২০০৩ সালে জেলা প্রশাসকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ওই আবাসন প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়।
সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ রাষ্ট্রের আইন মানা এবং তা বাস্তবায়ন করা। কিন্তু কক্সবাজারে আমরা তার উল্টো অবস্থা দেখি। সেখানকার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকাগুলো একের পর এক সরকারি সংস্থা বরাদ্দের নামে দখল করছে। উচ্চ আদালতের রায় থাকার পরও তারা ওই ৫১ একরের আবাসন প্রকল্পটির উচ্ছেদ করছে না। এতে বেসরকারি খাতের দখলদারেরা আরও আগ্রাসী হয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজারে পাহাড় কাটা বন্ধে ২০০৬ সালে হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করে তারা। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১১ সালের ৮ জুন জেলা প্রশাসনের ওই প্রকল্পের বরাদ্দ বাতিল, পাহাড়ের কোনো অংশ না কাটা, রক্ষিত বন এলাকায় সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করা ও বন ধ্বংস না করার আদেশ দেন।
আদালতের এই রায় বাস্তবায়িত না হওয়ায় পরে ১২ সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করে বেলা। আদালত কক্সবাজারের তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. রুহুল আমিনকে ব্যক্তিগতভাবে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। ২০১৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির হয়ে সময় প্রার্থনা করেন তিনি। এ সময় তিন মাসের মধ্যে সব স্থাপনা উচ্ছেদ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের অঙ্গীকার করেন জেলা প্রশাসক।চারদিকে দেয়ালঘেরা জেলা প্রশাসনের আবাসন প্রকল্পের মূল ফটকের সামনে বিশাল সাইনবোর্ড। লেখা ‘সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা আবাসন, এই ৫১ একর জমি বর্ণিত আবাসনের জন্য সেলামি বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের ওই প্রকল্পে ৫০০টি প্লট রয়েছে। এরই মধ্যে ৩০০টি পরিবার ঘর তুলে বসবাসও করছে। অনেক কর্মকর্তা বরাদ্দ পাওয়া প্লট বিক্রি করে দিয়েছেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের একটি অংশ সেখানে বসবাস করছে। অনেকে ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন। হোটেল-মোটেল এলাকার কাছাকাছি হওয়ায় সেখানে ভাড়াও বেশি।
এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবাসন প্রকল্পের ৫১ একরসহ ঝিলংজা মৌজার জমি নিয়ে উচ্চ আদালতের অনেকগুলো রায় আছে। আমরা সব কটি রায় একত্রে বাস্তবায়ন করে এলাকাটিকে দখলমুক্ত করার পরিকল্পনা করছি। খুব দ্রুত তা বাস্তবায়ন করা হবে।’
ওই আবাসন প্রকল্পের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী সমিতির সভাপতি স্বপন কান্তি পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সেখানে কোনো বড় স্থাপনা করিনি। আমাদের কিছু কর্মচারী টিনের ঘর তুলে থাকেন। জেলা প্রশাসন থেকে আমাদের যে নির্দেশ দেবে, আমরা তা অবশ্যই বাস্তবায়ন করব।’
পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ঝিলংজা মৌজার ওই এলাকাকে ১৯৩৫ সালে রক্ষিত বন এবং ১৯৯৯ সালে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ কারণে এলাকাটির পাহাড়ি বনভূমির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করা ও পাহাড় বা বনভূমির ক্ষতিসাধন করা আইনানুযায়ী সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এসব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জেলা প্রশাসন কাজ শুরু করলে বন বিভাগ প্রতিরোধের চেষ্টা করে, এমনকি আদালতে জেলা কালেক্টরেট কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ পরিষদের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ রাষ্ট্রের আইন মানা ও তা বাস্তবায়ন করা। কিন্তু কক্সবাজারে আমরা তার উল্টো অবস্থা দেখি। সেখানকার সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকাগুলো একের পর এক সরকারি সংস্থা বরাদ্দের নামে দখল করছে। উচ্চ আদালতের রায় থাকার পরও তারা ওই ৫১ একরের আবাসন প্রকল্পটির উচ্ছেদ করছে না। এতে বেসরকারি খাতের দখলদারেরা আরও আগ্রাসী হয়ে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করছে।’