সাকিব আল হাসানের সবকিছুই বড় খবর। সেই খবরের উৎস কখনো মাঠের পারফরম্যান্স, কখনো মাঠের বাইরের কোনো ঘটনা, কখনো বা সাকিবের কোনো কথা।সাকিবের নিয়মিতই এমন খবর হয়ে ওঠার মধ্যে সাংবৎসরিক বলে ধরা যায় আইপিএলকে। বলতে গেলে প্রতিটি আইপিএলের আগেই রুটিনমাফিক বাংলাদেশে বড় একটা বিতর্ক শুরু হয়। সাকিব দেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন, না আইপিএল?যেটি তুঙ্গ ছুঁয়েছিল গত বছর। আইপিএলে খেলবেন বলে শ্রীলঙ্কায় টেস্ট সিরিজ থেকে ছুটি নেওয়া নিয়ে সেই বিতর্ক আপনার ভুলে যাওয়ার কথা নয়। বোর্ডের কাছে ছুটি চেয়ে দেওয়া সাকিবের ওই চিঠি নিয়ে পুরো দেশেই তো তখন মহা তোলপাড়। যাতে ঘৃতাহুতি দেওয়ার কাজটা করেছিল সাকিবের অকপট সাক্ষাৎকার। এরপর যা হয়…সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড়, টেলিভিশনে টক শো, সাকিবময় সংবাদমাধ্যম…এবারও আইপিএলের কারণেই আবার সাকিবকে নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা।
ব্যতিক্রমী বলতে ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট না আইপিএল’—এই বিতর্ক এবার শুরুই হতে পারেনি। এর আগেই চিত্রনাট্যে অপ্রত্যাশিত মোচড়। এই প্রথম আইপিএলের নিলামে উঠেও কোনো দল পাননি সাকিব। দু–দুবার আইপিএলের বাজারে তোলার পরও কোনো দলই তাঁর প্রতি আগ্রহ দেখায়নি। অথচ আইপিএলের প্রথম অর্ধেকটা খেলবেন বলে দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সিরিজ থেকে ছুটি নিয়ে রেখেছিলেন সাকিব।ফেসবুককে যদি বাংলাদেশের জনমানসের দর্পণ ধরা হয়, তা থেকে সাকিবের অবিক্রীত থাকার প্রতিক্রিয়ায় মূলত দুটি ধারার সন্ধান মিলছে। এক দল ‘অহংকারী’ সাকিবের উপযুক্ত শিক্ষা হয়েছে ভেবে বিমলানন্দ অনুভব করছে। আরেক দল এটাকে নিয়েছে ‘জাতীয় অপমান’ হিসেবে। আইপিএল বর্জনের কথা বলে হ্যাশট্যাগ আন্দোলনের ডাক পর্যন্ত দিয়েছেন জাত্যভিমানী কেউ কেউ। দুটিই চরমভাবাপন্ন। ভিন্ন একটা দেশের ঘরোয়া ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে দল পাওয়া না পাওয়াকে জাতির মান-অপমানের সমার্থক বানিয়ে ফেলা বোধ হয় শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব।আইপিএলের নিলামে উঠেও দল পাননি—এমন ক্রিকেটারদের তালিকায় বড় বড় আরও অনেক নাম আছে। তিন মাস আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চকে কেউ দলে নেয়নি।
বিশ্বকাপ জয়ই ফিঞ্চের সিভিতে একমাত্র জ্বলজ্বলে অধ্যায় নয়, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের ইনিংস ফিঞ্চের। তৃতীয় সর্বোচ্চও ইনিংসটিও। ইংল্যান্ডের টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক এউইন মরগানের গায়েও এবার লেগেছে ‘আনসোল্ড’-এর তকমা। অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ডের কেউ এটিকে জাতির অপমানের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেছেন বলে শোনা যায়নি।ফিঞ্চ-মরগানের বাইরেও তো নিলামে বিফল আরও কত বড় বড় নাম—স্টিভ স্মিথ, মার্টিন গাপটিল, ইমরান তাহির, ইশান্ত শর্মা, সুরেশ রায়না…। ইএসপিএন-ক্রিকইনফো তো এঁদের অনেককে নিয়ে একটা ‘আনসোল্ড ইলেভেন’-ও বানিয়ে ফেলেছে। যাতে অলরাউন্ডার হিসেবে রাখা হয়েছে সাকিব আল হাসানকেও। আইপিএলে কোনো ক্রিকেটারের দল পাওয়া না পাওয়ার ক্রিকেটীয় কারণই যেখানে খুঁজছে বাকি বিশ্ব, বাংলাদেশ সম্ভবত সেখানে একমাত্র ব্যতিক্রম। গত আইপিএলে বাজে পারফরম্যান্সই (৮ ম্যাচে ৪৭ রান ও ৪ উইকেট) যে সাকিবের ব্যাপারে অনাগ্রহের কারণ হতে পারে, কারণ হতে পারে সাকিবকে পুরো টুর্নামেন্টে না পাওয়া…এসব তাই পড়ে যাচ্ছে আড়ালে।
আইপিএলে সাকিবের এত বছর টানা খেলে যাওয়া অবশ্যই তাঁর ক্রিকেটীয় দক্ষতার কারণে। তবে এটাও কিন্তু সত্যি, আইপিএলে সাকিবকে সাকিবের রূপে দেখা গেছে খুবই কম। বিপিএল বাদই দিন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনায়ও সাকিবের আইপিএল-ক্যারিয়ার বড় বেশি বিবর্ণ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকিব যেখানে ব্যাটিং-বোলিংয়ে সমান ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে সত্যিকার এক অলরাউন্ডার, আইপিএলে অনেক দিনই তাঁর পরিচয়—বাঁহাতি স্পিনার, যে ব্যাটিং করতে পারে। যেটির প্রমাণ এই পরিসংখানেও—৭১ ম্যাচে মাত্র দুটি ফিফটি, সর্বশেষটি সেই ২০১৬ সালে (২০১৪ সালে অন্যটি)।আমজনতা আবেগে ভেসে যাওয়ার আগে এত সব হিসাব-নিকাশ করার প্রয়োজন বোধ করে না। কিন্তু বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটাররাও দেখছি, একই রোগে আক্রান্ত। নইলে রুবেল হোসেন কেন ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখবেন, ‘সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্র্যান্ড। ছোট্ট একটি দেশ হতে পারে, কিন্তু সাকিব আল হাসান এ দেশের সবচেয়ে বড় তারকা…গর্বের ও ভালোবাসার একটি নাম। পারলে তৈরি করুক একটা সাকিব আল হাসান।’
এক দল ‘অহংকারী’ সাকিবের উপযুক্ত শিক্ষা হয়েছে ভেবে বিমলানন্দ অনুভব করছে। আরেক দল এটাকে নিয়েছে ‘জাতীয় অপমান’ হিসেবে। আইপিএল বর্জনের ডাক দিয়ে হ্যাশট্যাগ আন্দোলনের ডাক পর্যন্ত দিয়েছেন জাত্যভিমানী কেউ কেউ। দুটিই চরমভাবাপন্ন।আইপিএলের নিলামে বিক্রি হওয়া না হওয়ার সঙ্গে ছোট্ট দেশ-বড় দেশ টেনে আনাটাই তো হাস্যকর। আরও হাস্যকর শেষ কথাটা। যেখানে ভারতকে (উল্লেখ না করলেও যা বুঝতে সমস্যা নেই) একটা সাকিব আল হাসান তৈরি করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের ফাস্ট বোলার। রুবেল স্ট্যাটাস দেওয়ার ঘণ্টাখানেক আগেই মোসাদ্দেক হোসেন তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘যোগ্যরা সব সময় যোগ্য স্থানে থাকবে। দুই-এক বছরে সাকিব আল হাসান নামটি আসে নাই, সাকিব নামটির সাথে এ দেশের ক্রিকেটের অনেক আবেগ–ভালোবাসা জড়িত। সাকিব কিন্তু যুগে যুগে একটাই আসে…।’
সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেটের ব্র্যান্ড, সাকিব নামটির সঙ্গে অনেক আবেগ–ভালোবাসা জড়িত—এই কথাগুলো নিয়ে কোনো তর্ক নেই। তবে আইপিএলে দল না পাওয়ার পর এসব মনে করিয়ে দেওয়ার মানে কী? রুবেল-মোসাদ্দেকের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের সঙ্গে বেমানান অপরিণত চিন্তাভাবনার প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই নয়। বেশ কিছুদিন ধরে সাকিবের ক্রিকেটীয় মুখপাত্র হয়ে ওঠা তাঁর স্ত্রী কোনো স্ট্যাটাস দেন কি না, এ নিয়ে কৌতূহল ছিল অনেকের।সাকিব উম্মে আল হাসান শিশির হতাশ করেননি। ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি দাবি করেছেন, পুরো মৌসুম খেলতে পারবেন কি না, জানতে চেয়ে দুটি দল আগেই যোগাযোগ করেছিল সাকিবের সঙ্গে। শ্রীলঙ্কা সিরিজটা খেলবেন বলেই যা পারছেন না সাকিব। দল না পাওয়ার কারণও এটাই।এখানেই পৃথিবীর শেষ নয়, পরের বছর বলে একটা ব্যাপার সব সময়ই আছে…এসব ভালো ভালো কথা বলার পর শিশির নিন্দুকদের একটা খোঁচা দিয়েছেন। শ্রীলঙ্কা-সিরিজ বাদ দিলেই সাকিব আইপিএলে দল পেতেন দাবি করে প্রশ্ন করেছেন, তখন কি তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলা হতো না?
চাইলে সবকিছুরই নাকি একটা ভালো দিক খুঁজে পাওয়া যায়। এখানে তো তা খুব একটা খুঁজতেও হচ্ছে না। আইপিএল-উপেক্ষায় সাকিবের কিছুটা আর্থিক ক্ষতি তো হয়েছেই, তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য তা বড় একটা লাভও হতে পারে। একটা আইপিএলে একাদশে সুযোগ না পাওয়ার রাগ-জেদ থেকে ২০১৯ বিশ্বকাপে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন সাকিব, এবারও তো সামনে আরেকটি বিশ্বকাপ। সেটি আবার আইপিএলের মতোই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের। সাকিবকে চিনলে এটা অনুমান করায় কোনোই ঝুঁকি নেই যে সেই বিশ্বকাপের জন্য সাকিব দিন গুনতে শুরু করেছেন।বিশ্বকাপ তো এখনো মাস আটেক দূরে। আইপিএলে যখন খেলছেনই না, আগামী মাসের দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজটাই বা কেন বাদ দেবেন সাকিব? প্রায় ১৪ বছর আগে একবারই দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সিরিজ খেলেছেন। পরপর দুই টেস্টে, আসলে পরপর দুই ইনিংসে ৫ ও ৬ উইকেট…এখনো যেটিকে বোলার হিসেবে তাঁর সেরা পারফরম্যান্স বলে মানেন সাকিব। সেই সুখস্মৃতি ফিরিয়ে আনার সুযোগটা কেন নেবেন না সাকিব?