ইসলামের শুরু থেকে একদল মহান ব্যক্তি মানুষকে আলোর পথে, দীন ইসলামের পথে অনবরত সকল বাধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও আহ্বান করে গিয়েছেন। কোনো কিছুই তাদেরকে দমাতে পারেনি। এই মহান ব্যক্তিরা, এই দীনের ঝাণ্ডাধারীরা উলামা-মাশায়েখ নামে পরিচিত। তারা তাদের জীবনকে ইলম অর্জন ও ইলম বিতরণের জন্য উৎসর্গ করে দেন। উলামাগন লাইটহাউজের মতো। শত শত পথহারা মুসলিমকে তারা আলোর পথে, সঠিক পথে নিয়ে আসেন। ইসলামের হিফাজতে তারা কাজ করেন, এর প্রজ্ঞা ছড়িয়ে দেন দ্বার থেকে দ্বারে।
কুরআন, সুন্নাহ ও হাদিসে উলামাদের মহান মর্যাদা এবং ইলম অর্জনের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
হজরত আবু দারদা রা. থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘নিশ্চয় আলিমের ফজিলত সাধারণ আবিদের তুলনায় তারকারাজির মধ্যে চতুর্দশী চাঁদের মতো। অবশ্যই আলিমগণ নবিগণের উত্তরসূরি। আর নবিগণ দিনার- দিরহামের (সম্পদের) কোনো উত্তরাধিকার রেখে যাননি; বরং ইলমের উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। যে তা (ইলম) অর্জন করল, সে অনেক বড় হিসসা অর্জন করল। অর্থাৎ, সে অনেক বড় সৌভাগ্যবান।’
হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘দীনি জ্ঞানার্জন থেকে উত্তম কোনো ইবাদাত নেই। নিঃসন্দেহে একজন ফকিহ (শরিয়তের ওপর বিশেষজ্ঞ) শয়তানের মোকাবিলার হাজার সাধারণ আবিদ থেকে অধিক দৃঢ়। প্রত্যেক বিষয়েরই স্তম্ভ আছে। দীন ইসলামের স্তম্ভ হলো—শরিয়তের জ্ঞান ও সঠিক বুঝ।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘একজন ফকিহ ইবলিসের মোকাবিলায় হাজার আবিদ থেকে অধিক দৃঢ়।’
হজরত মুজাহিদ রাহ. বলেন, একবার আমরা (হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা.-এর ছাত্ররা) মসজিদের দরসে বসা ছিলাম। এঁদের মধ্যে হজরত তাউস, সাইদ ইবনু জুবায়ের এবং ইকরিমা রা.-ও ছিলেন। এ সময় হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. নামাজ পড়ছিলেন। এ সময় হঠাৎ এক ব্যক্তি এসে বলতে লাগল, ‘আপনাদের মধ্যে কেউ মুফতি আছেন?’
আমরা বললাম, ‘আপনি কোনো মাসআলা জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করুন।’
সে বলতে লাগল, “আমি প্রস্রাব করার পর আমার লজ্জাস্থান থেকে কিছু সাদা তরল পদার্থ বের হয়।”
আমরা বললাম, ‘সেই তরল পদার্থ কি বীর্যের মতো; যা দ্বারা সন্তান জন্ম হয়?”
সে বলল, ‘জি হ্যাঁ।’
আমরা বললাম, ‘এমন তরল পদার্থ বের হলে আপনার উপর গোসল ওয়াজিব হবে।’
আমাদের জবাব শুনে এই ব্যক্তি ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলতে বলতে প্রস্থান করল। তখন হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. তাড়াতাড়ি নামাজ শেষ করে হজরত ইকরিমা রাহ.-কে বললেন –
“এই ব্যক্তিকে আমার কাছে নিয়ে এসো।”
এ কথা বলে আমাদের দিকে ফিরে বলতে লাগলেন-
‘তোমরা কি মনে করো, এই ব্যক্তিকে যে ফাতওয়া দিয়েছ, তা কিতাবুল্লাহ থেকে দিয়েছ?’
আমরা বললাম, “জি না।”
তিনি বললেন, “তাহলে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর হাদিসসমূহ থেকে দিয়েছ?’
আবারও বললাম, ‘জি না।’
বললেন, “তাহলে কি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সাহাবিগণের বাণী থেকে দিয়েছ?’
আমরা বললাম, ‘জি না।’
বললেন, ‘তাহলে তোমরা কিসের ভিত্তিতে ফাতওয়া দিলে?’
আমরা বললাম, “আমাদের গবেষণা থেকে দিয়েছি।’
তিনি বলতে লাগলেন, এ জন্যই রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “একজন ফকিহ অভিশপ্ত শয়তানের মোকাবিলায় হাজার আবিদ থেকে অধিক দৃঢ়।”
এমন সময় ওই ব্যক্তি উপস্থিত হলো। তার দিকে ফিরে হজরত আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস রা. জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি বলো, যখন এই তরল পদার্থ তোমার থেকে বের হয়, তখন কি তোমার প্রজননতন্ত্রে উত্তেজনা অনুভব করো?”
সে বলল, “জি না।”
আবার বললেন, “তাহলে তোমার দেহে কি কোনো আনন্দ অনুভব করো?”
সে বলল, “জি না।”
ওই ব্যক্তির সব কথা শোনার পর হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বললেন, ‘এই তরল পানি পেটের ঠাণ্ডাজনিত রোগের কারণে বের হয়। এতে তোমার জন্য ওজুই যথেষ্ট।” (গোসলের প্রয়োজন নেই)।
প্রকৃত আলিমগণ এমনই হয়ে থাকেন, যাদের মর্যাদা সম্পর্কে নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দীনের পাণ্ডিত্য (শরিয়তের জ্ঞান) দান করেন।’
হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া বলেন,
“আল্লাহ যার কল্যান চান, তাকে দীনের পাণ্ডিত্য শরিয়তের জ্ঞান) দান করেন।”
হজরত হুমাইদ ইবনে আবদুর রহমান রাহ. থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি হজরত মুআবিয়া রা.-কে খুতবার মধ্যে বলতে শুনেছি, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি: “আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দীনের পাণ্ডিত্য দান করেন।”
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান, তাকে দীনের পাণ্ডিত্য দান করেন।’
আল্লাহ তাআলা যখন আলিমগণের কল্যাণ চান, তখন তাদেরকে দীনের জ্ঞান দান করেন এবং কিতাবুল্লাহ ও হিকমাহর জ্ঞান দান করেন, যা তাঁরা আল্লাহর বান্দাদের জন্য আলোকবর্তিকা, পৃথিবীবাসীর জন্য পথপ্রদর্শক এবং জাতির জন্য মাইলফলক হন।
হজরত আনাস ইবনে মালিক রা.-এর ভাষ্য; নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেন,
“জমিনে আলিমগণের উদাহরণ আকাশের তারকারাজির মতো। যা দ্বারা জলে-স্থলে পথ প্রদর্শিত হয়। যখন তারাকারাজির আলো শেষ হয়ে যায় তখন মুসাফিরের বিপথগামী হওয়ার আশঙ্কা হয়।”
হজরত আবু দারদা রা. বলেন,
“মানুষের মধ্যে আলিমগণের উদাহরণ আকাশের তারকারাজির মতো; যা দ্বারা পথপ্রাপ্ত হওয়া যায়।”
মুসা ইবনে ইয়াসার রাহ. বলেন, আমাদের কাছে সংবাদ পৌঁছল যে, হজরত সালমান ফারসি রা. হজরত আবু দারদা রা.-কে চিঠি লিখলেন—-
“নিঃসন্দেহে দীনের উদাহরণ ওই ঝরনার মতো, যা লোকেরা বেষ্টন করে রেখেছে এবং যা থেকে তারা পালাক্রমে পানি উত্তোলন করছে। এই ঝরনার দ্বারা আল্লাহ অনেক লোককে উপকৃত করেন। যে সমস্ত হিকমাতের কথা (জ্ঞানের কথা) অন্যকে শিক্ষা দেওয়া হয় না, তা নিষ্প্রাণ দেহের মতো। তেমনি যে ইলম অন্যের নিকট পৌঁছানো হয় না, তা এই গচ্ছিত ভান্ডারের মতো; যা থেকে ব্যয় করা হয় না। শিক্ষকের উদাহরণ ওই ব্যক্তির মতো, যে আঁধারাচ্ছন্ন রাতে আলো জ্বালিয়েছে। সব পথিক ওই আলো দ্বারা উপকৃত হয়ে তার জন্য কল্যাণের দুআ করছে।”
আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি রহম করুন। ওই রাস্তার ব্যাপারে আপনার ধারণা কী—যার মধ্যে অনেক কাঁটা ও বাধা রয়েছে এবং অন্ধকার রাতে লোকেরা সেদিকে চলাফেরা করে? এমন অন্ধকার রাস্তায় যদি আলোর ব্যবস্থা করা না হয়, তবে পথিকের কী পরিমাণ পেরেশানি হবে? তাই আল্লাহ তাআলা মানুষের চলাচলের জন্য বাতির ব্যবস্থা করে দেন। ফলে লোকেরা নিরাপদে চলাচল করতে থাকে। তারপর দ্বিতীয় আরেক দল এসে সেই রাস্তায় চলতে লাগল। এমন সময় আলো নিভে গেল; ফলে লোকেরা আঁধারে আচ্ছাদিত হয়ে পড়ল। এমন পরিস্থিতিতে পতিত লোকদের ব্যাপারে আপনার ধারণা কী?
সামাজিক জীবনে আলিমগণের অবস্থান এমনই। বহু লোক ফরজ বিধিবিধান পালন আর হারাম থেকে বেঁচে থাকার ব্যাপারে অজ্ঞ। আল্লাহর ইবাদাতের মৌলিক ও শাখাগত বিষয়াদি, যা বান্দাদের জন্য জরুরি; তা থেকে একদম বেখবর। এ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির জ্ঞান কেবল উলামায়ে কিরামের মাধ্যমেই জানা সম্ভব। (তা তাদের বয়ান ও দারস-তাদরিসের মাধ্যমে হোক কিংবা তাদের রচিত বই-পুস্তক থেকে অর্জিত হোক।) তাই যখন আল্লাহওয়ালা আলিমগণের মৃত্যু হয়, তখন লোকেরা পেরেশানির সম্মুখীন হয়। তাদের মৃত্যুতে ইলম-শূন্যতা দেখা দেয়, মূর্খতা ব্যাপক হয়। (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।) বাস্তবতা হলো— এটা মুসলমানদের জন্য কতই-না বড় মুসিবাত!