শয়তানের ওয়াসওয়াসায় অনেক সময় আমরা সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়ি। মনের মাঝে বদখেয়াল আসে যে, মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলাকে দেখা যায় না, তার কথা শোনা যায় না, তাহলে কীভাবে তাকে বিশ্বাস করব যে, তিনি আছেন? এসব বদখেয়াল দূর করার জন্য অবশ্যই ইলম ও পর্যবেক্ষণের দক্ষতা থাকতে হবে। এগুলো থাকলেই কেবল এসব খারাপ চিন্তা দূর করা সম্ভব। নতুবা এসব প্রশ্ন মনের ভেতর থেকেই যাবে। কিন্তু কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না। মহান আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বলেন-
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنۡ کُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّنَ الۡبَعۡثِ فَاِنَّا خَلَقۡنٰکُمۡ مِّنۡ تُرَابٍ ثُمَّ مِنۡ نُّطۡفَۃٍ ثُمَّ مِنۡ عَلَقَۃٍ ثُمَّ مِنۡ مُّضۡغَۃٍ مُّخَلَّقَۃٍ وَّ غَیۡرِ مُخَلَّقَۃٍ لِّنُبَیِّنَ لَکُمۡ ؕ وَ نُقِرُّ فِی الۡاَرۡحَامِ مَا نَشَآءُ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی ثُمَّ نُخۡرِجُکُمۡ طِفۡلًا ثُمَّ لِتَبۡلُغُوۡۤا اَشُدَّکُمۡ ۚ وَ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّتَوَفّٰی وَ مِنۡکُمۡ مَّنۡ یُّرَدُّ اِلٰۤی اَرۡذَلِ الۡعُمُرِ لِکَیۡلَا یَعۡلَمَ مِنۡۢ بَعۡدِ عِلۡمٍ شَیۡئًا ؕ وَ تَرَی الۡاَرۡضَ هَامِدَۃً فَاِذَاۤ اَنۡزَلۡنَا عَلَیۡهَا الۡمَآءَ اهۡتَزَّتۡ وَ رَبَتۡ وَ اَنۡۢبَتَتۡ مِنۡ کُلِّ زَوۡجٍۭ بَهِیۡجٍ ﴿۵﴾
হে মানুষ! পুনরুত্থানের ব্যাপারে যদি তোমরা সন্দিহান হও, তাহলে (চিন্তা করে দেখ) আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, অতঃপর শুক্র হতে, অতঃপর জমাট রক্ত থেকে, অতঃপর মাংসপিন্ড হতে পূর্ণ আকৃতিবিশিষ্ট বা অপূর্ণ আকৃতিবিশিষ্ট অবস্থায় (আমার শক্তি-ক্ষমতা) তোমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্য। আর আমি যাকে ইচ্ছে করি তাকে একটা নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত মাতৃগর্ভে রাখি, অতঃপর তোমাদেরকে বের করে আনি শিশুরূপে, অতঃপর (লালন পালন) করি যাতে তোমরা তোমাদের পূর্ণ শক্তির বয়সে পৌঁছতে পার। তোমাদের কারো কারো মৃত্যু ঘটাই, আর কতককে ফিরিয়ে দেয়া হয় নিস্ক্রিয় বার্ধক্যে যাতে (অনেক) জ্ঞান লাভের পরেও তাদের আর কোন জ্ঞান থাকে না। অতঃপর (আরো) তোমরা ভূমিকে দেখ শুষ্ক, মৃত; অতঃপর আমি যখন তাতে পানি বর্ষণ করি তখন তাতে প্রাণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়, তা আন্দোলিত ও স্ফীত হয়, আর তা উদগত করে সকল প্রকার নয়নজুড়ানো উদ্ভিদ (জোড়ায় জোড়ায়)। [সুরা হজঃ ৫]
এই আঘাত নিয়ে সামান্য চিন্তা করলেই পূর্বে আরোপিত প্রশ্ন ও বদখেয়াল দূর হয়ে যাবে। কে রক্ত সৃষ্টি করল? আর কে এ রক্তকে বীর্যে পরিণত করল? এরপর এ সাধারণ পচা দুর্গন্ধবিশিষ্ট অপবিত্র বীর্য হতে সুন্দর হৃষ্টপুষ্ট মানুষ কে বানালো?
সাধারণ একটা টেবিল নিজে নিজে হতে পারে না। তার জন্য মিস্ত্রীর প্রয়োজন হয়। তাহলে এত সুন্দর অবয়বে মানুষকে কে বানালো? তার জন্য কি একজন মিস্ত্রীর প্রয়োজন নেই? তাহলে সেই মিস্ত্রী কে? পৃথিবীতে লক্ষ কোটি মানুষ; অথচ সকলের গঠন একই ধরনের। প্রত্যেকের হাতে পাঁচ আঙ্গুল। সকলের চেহারা এক রকম নয়, একজনের চেহারা আরেকজনের চেহারার সাথে মিল নেই—কে এগুলো করল? এসব কি আপনাআপনি ঘটে যাওয়া সম্ভব? তাহলে এসব সৃষ্টির পেছনে সে মহান সত্তা কে? এসব নিয়ে চিন্তা করলেই বুঝে আসবে যে, আল্লাহকে দেখা না গেলেও তার সত্তা বাস্তব ও অনস্বীকার্য।
তেমনি সূর্যকে নিয়ে যদি চিন্তা করা হয়, তাহলেও তাওহিদ তথা আল্লাহ পাকের সত্ত্বা বুঝে আসবে। কে সে মহান সত্তা যে সূর্যকে (যার আয়তন পৃথিবী থেকে তের লক্ষ গুণ বড়) পরিভ্রমণ করাচ্ছে? যার পরিভ্রমণে কোনো বিরতি নেই। সূর্য প্রতিদিন একই কক্ষপথে ঘুরছে। সৌরজগতের প্রতিটি জিনিস তার আপন কক্ষপথে ঘুরছে। এ ধরণের যুক্তির সামনে বাঘা (!!) নাস্তিকেরাও পরাজিত হতে বাধ্য হয়। ঠিক তেমনই এক ঘটনা ঘটেছিল ইমাম আবু হানিফার সাথে এক নাস্তিকের।
একবার খলিফা হারুনুর রশিদের নিকট এক নাস্তিক এসে বলল— ‘আপনার সাম্রাজ্যে এমন কোনো জ্ঞানী ব্যক্তিকে ডাকুন, আমি তাকে তর্ক করে প্রমাণ করে দিবো যে, এই পৃথিবীর কোনো স্রষ্টা নেই। এগুলো নিজে নিজে সৃষ্টি হয়েছে এবং আপনা থেকেই চলে।”
খলিফা হারুনুর রশিদ কিছুক্ষণ ভেবে চিরকুট মারফত ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহকে ডাকলেন এবং এই নাস্তিকের সাথে বিতর্কে অংশ নিতে অনুরোধ করলেন।
ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ খবর পাঠালেন, তিনি আগামীকাল জোহরের সময় আসবেন, খলিফার প্রাসাদে নামাজ পড়ে তারপর বির্তকে অংশ নেবেন। পর দিন জোহরের নামাযের সময় খলিফা, তার সভাসদবর্গ ও নাস্তিকটি অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু যোহরের নামাজ তো দূরের কথা, আসর শেষ হয়ে গেল। অথচ তার আসার কোনো খবর নেই।
খলিফা চিন্তিত হয়ে পড়লেন। দরবারের লোকজন পেরেশান। ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ ওয়াদা করে আসলেন না। রাত হতে চলেছে। তার আসার কোনো নাম নেই। এরপর তিনি আসলেন। সকলেই তার সম্মানে দাঁড়িয়ে গেল। খলিফা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন, হজরত এত দেরি করলেন কেন?
ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ বললেন, আমি পথিমধ্যে এক বিস্ময়কর ঘটনার সম্মুখীন হওয়ায় আমার আসতে একটু বিলম্ব হয়েছে। আমি সারাজীবনে এমন অদ্ভূত কাণ্ড আর কখনো দেখিনি।
খলিফা জিজ্ঞেস করলেন, হজরত ঘটনা কী?
এবার ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ বললেন, আমি দজলা নদীর ওপারে বাস করি। আমি খলিফার দাওয়াত পেয়ে নদীতে এসে দেখি কোনো নৌকা নেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো নৌকা পেলাম না। সহসা আমি দেখলাম, একটি গাছ আপনা-আপনি উপড়ে পড়ল। এরপর সেটি নিজ থেকেই তক্তায় পরিণত হলো। তারপর এটি নিজে নিজে একটি নৌকায় রুপাস্তর হলো। এরপর আমি এটায় চড়ে আসলাম। নৌকাটি নিজে নিজে চলতে চলতে আমাকে এপারে পৌঁছিয়ে দিলো।
নাস্তিকটি আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহর এ কথা শুনে হো হো করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, আমি জানতাম আপনি একজন বড় আলেম, পণ্ডিত ও জ্ঞানী ব্যক্তি। কিন্তু আপনি তো কথা বলছেন কচি শিশুর মতো। এটা কী করে সম্ভব যে, আপনা-আপনি গাছ ফেড়ে নৌকা হয়ে গেল? আপনি কি আমাকে বোকা পেয়েছেন যে, আমি এমন আজগুবি গল্প বিশ্বাস করব? একটা গাছ আপনা-আপনি নৌকায় পরিণত হবে—এটা কী করে সম্ভব?
ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ তখন বললেন, শুনুন! একটা গাছ যদি আপনা থেকে নৌকায় পরিণত না হতে পারে এবং নদী পারাপার না হতে পারে, তাহলে কীভাবে এই বিশাল আকাশ, চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্র আপনা-আপনি তৈরি হতে এবং চালু থাকতে পারে?
নাস্তিকটি লাজওয়াব হয়ে মুখ কাচুমাচু করে বিদায় নিলো। খলিফা হারুনুর রশিদ তার অভূতপূর্ব কৌশলী জবাবে মুগ্ধ হয়ে ইমাম আজমকে সসম্মানে বিদায় দিলেন।
ইমাম ফাখরুদ্দিন রাজি রাহিমাহুল্লাহ তার তাফসির গ্রন্থে লিখেছেন যে, ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ নাস্তিকদের জন্য ছিলেন তলোয়ারস্বরূপ এবং নাস্তিকরাও তাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। একদিন ইমাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ তার মসজিদে বসা ছিলেন। হঠাৎ একদল নাস্তিক তাকে হত্যা করার জন্য নাঙ্গা তরবারি নিয়ে তার কাছে হাজির হলো।
তিনি তাদেরকে বললেন, তোমরা প্রথমে আমার একটি কথার জবাব দাও। তারপর তোমরা যা চাও, করতে পারো। তারা বলল, হ্যাঁ, ঠিক আছে। তিনি বললেন, তোমরা সেই ব্যক্তির ব্যাপারে কী বলবে, যে তোমাদের এ কথা বলে যে, আমি সমুদ্রে একটি জাহাজ দেখেছি। যার মধ্যে রকমারি মাল বোঝাই রয়েছে। সমুদ্রে ঝড়ো হাওয়া এদিক ওদিক বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাহাজটিকে একটুও এদিকে সেদিকে করতে পারছে না; বরং জাহাজটি সর্বদা সোজা চলছে। অথচ ওর কোনো চালক নেই এবং দেখাশোনাকারীও কেউ নেই। এ ব্যাপারটা কতটুকু সঠিক?
তখন তারা সবাই বলল, এ ব্যাপারটা অন্তত সাধারণ বিবেক গ্রহণ করে না। এরপর ইনাম আবু হানিফা রাহিমাহুল্লাহ বললেন, কী আশ্চর্যের ব্যাপার যে, সমুদ্রের বিনা নাবিকে একটি জাহাজের আপনাআপনি সোজা চলে যাওয়াকে বিবেক বুদ্ধি গ্রহণ করতে পারে না। অথচ এই বিশাল পৃথিবী বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও একজন তদারকদারি ছাড়া কী করে চলেছে? তখন তারা সবাই কেঁদে ফেলল এবং বলতে বাধ্য হলো যে আপনি সত্যিই বলেছেন। এরপর তারা নাস্তিকতা থেকে তওবা করল। পরে তারা তার হাতে ইসলাম কবুল করল।