পাকিস্তানে গত এপ্রিলে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের মধ্য দিয়ে পতন হয় ইমরান খান সরকারের। ইমরানের দাবি, তাঁর সরকারকে হটাতে ষড়যন্ত্র করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে ওয়াশিংটন। তবে পাকিস্তানের জনগণের বড় একটি অংশ ঠিকই ওই ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বের’ ওপর বিশ্বাস রেখেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আনা ইমরানের অভিযোগ যে পাকিস্তানিদের মনে ধরেছে, তা যেন অনেকটাই প্রমাণিত হয়েছে গত কয়েক দিনে। রাজধানী ইসলামাবাদে সরকারবিরোধী লংমার্চে ইমরানের পক্ষে রাস্তায় নেমেছেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ইমরানের সমর্থকদের সোচ্চার হতে দেখা গেছে।
লংমার্চেও যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তুলতে ভোলেননি ইমরান। শুধু ইসলামাবাদই নয়, ১০ এপ্রিল গদি হারানোর পর পাকিস্তানজুড়ে ইমরান যেসব সমাবেশ করেছেন সবখানেই ‘ষড়যন্ত্রের’ বিষয়টি ছিল আলোচনার কেন্দ্রে।
‘ইমরান খান তাঁর পক্ষে জনসমর্থন বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন। ইমরান ষড়যন্ত্র নিয়ে কোনো প্রমাণ হাজির না করতে পারলেও তাঁর সমর্থকেরা কিন্তু তা ঠিকই বিশ্বাস করেছেন।’
যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধি
এককালের তারকা ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিতে আসা ইমরানের দাবি সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে পাকিস্তানের তরুণ সমাজকে। এমনিতেই তাঁদের মধ্যে আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব রয়েছে। এর মধ্যেই পাকিস্তানে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে দ্রব্যমূল্যের পারদ চড়েছে। এতে করে আবার চাড়া দিচ্ছে পাকিস্তানের প্রভাবশালী গোষ্ঠীবিরোধী মনোভাব।
যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘে নিযুক্ত পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধি বলেন, ইমরান খান তাঁর পক্ষে জনসমর্থন বাড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাবকে কাজে লাগাতে চাচ্ছেন। ইমরান ষড়যন্ত্র নিয়ে কোনো প্রমাণ হাজির না করতে পারলেও তাঁর সমর্থকেরা কিন্তু তা ঠিকই বিশ্বাস করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইমরানের যে অভিযোগ
ইমরানের অভিযোগের গোড়ায় রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। ইমরান খান বলছেন, গত মার্চে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন ডোনাল্ড লু। তখন যুক্তরাষ্ট্রের এই কর্মকর্তা বলেন, ইমরানকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো উচিত।
সম্প্রতি মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের সঙ্গে আলাপচারিতায়ও এ নিয়ে কথা বলেছেন ইমরান। সেখানে তিনি বলেন, ডোনাল্ড লু পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে নাকি হুমকি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ইমরানকে উৎখাত না করা হলে পাকিস্তানকে এর জন্য পরিণতি ভোগ করতে হবে।
ইমরানের এ দাবির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে সিএনএন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সরাসরি নাকচ করেছেন তিনি। এর আগেও বিষয়টি নিয়ে তিনি একই কথা বলেছিলেন।
সিএনএনের সঙ্গে আলাপচারিতায় ইমরানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ চাওয়া হয়েছিল। এ সময় তিনি বলেন, ডোনাল্ড লুর সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের বৈঠকের সময় দুই পক্ষই নোট নিচ্ছিল। তবে ওই নোট সাধারণ মানুষের সামনে আনার বিষয়ে জানতে চাইলে এড়িয়ে যান ইমরান।
ইমরানের অভিযোগের গোড়ায় রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। ইমরান বলে আসছেন, গত মার্চে ওয়াশিংটনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা করেন ডোনাল্ড লু। তখন যুক্তরাষ্ট্রের ওই কর্মকর্তা বলেন, ইমরানকে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো উচিত।
মার্চের ওই বৈঠকের বিষয়বস্তু নিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত একটি বার্তা পাঠিয়েছিলেন বলে জানান ইমরান খান। ওই বার্তাটি পরে পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার কাছে পাঠানো হয়। পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) এক বৈঠকে ওই বার্তা দেখিয়েছিলেন বলে জানান ইমরান। তবে এর মধ্যে পাকিস্তানে সরকার বদল হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেছেন পিএমএল (এন) নেতা শাহবাজ শরিফ। এরপর গত মাসে এনএসসি ইমরানের খানের অভিযোগ পুরোপুরি নাকচ করেছেন। এ বিষয়ে এনএসসির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বার্তায় ষড়যন্ত্রের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়া। ওই দিনই মস্কো সফরে গিয়েছিলেন ইমরান খান। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা তাঁর ওপর চটতে পারেন বলে মনে করছেন ইমরান। আর যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ জড়িত বলেও দাবি করেছেন তিনি।
পাকিস্তানিরা কেন এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করছেন
রাজনীতি বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইমরান খানের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কেন পাকিস্তানের মানুষ বিশ্বাস করছেন সেটা বুঝতে হলে গত কয়েক দশকের ইতিহাস ঘেঁটে দেখতে হবে। এ সময়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অবিশ্বাস দিন দিন বেড়েছে। এ কারণেই আজকের এই পরিণতি।
২০০১ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আফগানিস্তানে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অভিযান শুরু করেন, তখন মিত্র হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন পাকিস্তানকে। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দুই দেশের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়েছে।
পাকিস্তানিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অবিশ্বাসের বড় কারণ প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তান। সেখানে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে অবস্থান করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। এ সময় পাকিস্তান বহুবার আফগান–সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছে। এসব কিছুর জেরে অনেক পাকিস্তানিই মনে করেন, তাঁদের দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য দায়ী আফগানিস্তানে মার্কিনিদের উপস্থিতি।
২০০১ সালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ আফগানিস্তানে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ অভিযান শুরু করেন, তখন মিত্র হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন পাকিস্তানকে। তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দুই দেশের সরকারের মধ্যে দূরত্ব এসেছে। পাকিস্তানেরর মাটিতে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন হামলা চালিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ করে ইসলামাবাদ।
এ ছাড়া ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে চালানো এক অভিযানে আল–কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেন যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা। তবে ওই অভিযান সম্পর্কে ইসলামাবাদকে আগে থেকে কিছু জানানো হয়নি। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের এ কর্মকাণ্ডকে অপমান হিসেবেই দেখেছিল পাকিস্তান সরকার।
আগুনে আরও ঘি ঢালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের একটি ভুয়া টিকাদান কর্মসূচি। ওই কর্মসূচিতে টিকা দেওয়ার নামে অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছিল। এই কর্মসূচি মার্কিন সরকারের চোখে সফল হিসেবে দেখা হলেও পাকিস্তানিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল।
এখানেই শেষ নয়। ২০১১ সালেই রেমন্ড ডেভিস নামের সিআইএর এক কন্ট্রাক্টর লাহোরে দুই পাকিস্তানিকে হত্যা করেন। ডেভিসের ভাষ্য ছিল, ওই দুই ব্যক্তি বন্দুকের মুখে তাঁকে ছিনতাইয়ের চেষ্টা করেছিলেন। তাতে বাধ্য হয়ে গুলি চালাতে হয়েছিল তাঁকে। তবে একে স্পষ্ট হত্যাকাণ্ড বলেছিল পাকিস্তান সরকার।
ডেভিসকে সে সময় হত্যা ও অবৈধ অস্ত্র সঙ্গে রাখার দায়ে আটক করা হয়। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক সম্পর্কে উত্তেজনা দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র সাফ জানিয়ে দেয়, ডেভিসের মুক্তি না দিলে শত শত কোটি ডলারের মার্কিন সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে। পরে হত্যার শিকার ওই দুই পাকিস্তানির পরিবারকে ২০ লাখ ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয় ডেভিসকে।
এসব ঘটনা দুই দেশের মধ্যকার বিশ্বাসে অপূরণীয় ক্ষতি করেছে বলে মনে করেন ইসলামাবাদভিত্তিক আইনজীবী ও কলাম লেখক হাসান কামাল ওয়াত্তো। তাঁর ভাষ্য, পাকিস্তানিরা এখন মনে করেন তাঁদের দেশের বিরুদ্ধে দূর থেকে ষড়যন্ত্রের ছক কষা হচ্ছে। এ কারণেই ইমরানের অভিযোগকে সত্য বলে ধরে নিচ্ছেন তাঁরা।
বৃহস্পতিবার সকালে জিন্নাহ অ্যাভিনিউতে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিতে সরকারকে ছয় দিনের সময় বেঁধে দেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান
‘অন্ধ বিশ্বাস’
ইমরান খান কেন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী চাল দিয়েছেন, তা ইতিহাস থেকে অনেকটাই বোঝা যায় বলে মন্তব্য করেছেন কয়েকজন রাজনীতি বিশ্লেষক। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ব্রুকিংস ইনস্টটিটিউটের গবেষক মাদিহা আফজালের মতে, ইমরান যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যে অভিযোগ করেছেন তা পাকিস্তানে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ। আর ইমরানের সমর্থকেরা তাঁর বক্তব্যকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করছেন।
মাদিহা আফজাল বলেন, ‘ইমরান দাবি করে আসছেন, পাকিস্তানের সমস্যগুলোর মূলে রয়েছে দেশটির বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় থাকা গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর দুর্নীতি। এই অভিযোগ তাঁর সমর্থকদের মনে ধরেছে।’
পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বিরুদ্ধেও একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তবে সেগুলোর কোনোটারই মীমাংসা হয়নি। একই অভিযোগ কাঁধে নিয়ে ঘুরছেন পাকিস্তানের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও শাহবাজের বড়ভাই নওয়াজ শরিফ।
ইমরানকে প্রধানমন্ত্রীর গদি থেকে সরানোর পর থেকে তিনি পাকিস্তানিদের বড় একটি অংশের কাছ থেকে সহানুভূতি পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক কূটনীতিক মালিহা লোধি। আর আইনজীবী ও কলাম লেখক হাসান কামাল ওয়াত্তোর ভাষ্যমতে, ইমরানের সমর্থকেরা তাঁকে পাকিস্তানের গতানুগতিক রাজনৈতিক নেতাদের বিকল্প হিসেবে দেখছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইমরানের পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন তাঁকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এটা স্পষ্ট যে তাঁর সরকারের পতনের পর পাকিস্তানে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে তেমন কিছুই করতে পারেননি শাহবাজ শরিফ।
করাচিভিত্তিক সাংবাদিক আরিবা শাহিদের মতে, ক্ষমতার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর লড়াই পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। এই রাজনীতির ফলে দেখা দিয়েছে দীর্ঘমেয়াদি মূল্যস্ফীতি। ডলারের বিপরীতে রুপির মান কমে যাচ্ছে। আর ঘাটতি সামাল দিতে করের পরিমাণ বাড়াচ্ছে সরকার। এসবের বোঝা পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকেই বইতে হচ্ছে।
পাকিস্তানের বর্তমান সংকটের সুফল শেষ পর্যন্ত ইমরান খানই পাচ্ছেন বলে মনে করেন ইসলামাবাদভিত্তিক রাজনীতি বিশ্লেষক হুসাইন নাদিম। তাঁর ভাষায়, ইমরানের জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেমনটা আগে কখনো দেখা যায়নি।