আল্লাহ ওয়াদা করেছেন ইসলাম বিজয়ী হবে, আর আল্লাহর ওয়াদা তো মিথ্যে নয়। আপনি যদি এ ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন তাহলে আপনি আমার উপরে নয়, বরং আল্লাহকেই সন্দেহ করছেন। যদি ইসলাম আপনাকে সাথে নিয়ে বিজয়ী হয় তবে আপনি সফল। যদি ইসলাম বিজয়ী হয় আর আপনি দাওয়াহ দেন তাহলেও এটা আপনারই বিজয়। কিন্তু ইসলাম যদি আপনাকে বাদ দিয়েই বিজয়ী হয়, তাহলে আপনি হেরে গেলেন। আপনাকে সহ বা আপনাকে ছাড়া, উভয়ক্ষেত্রেই ফলাফল একই হবে, ইসলামই বিজয়ী হবে। যদি আমি আর আপনি এ দলে না যোগ দেই, তাহলে ওয়াল্লাহিল ‘আজিম এই বিজয়ী দলের সদস্যরা হবে সিরিয়ান সেই শিশুরা যারা কুরআন আর আল-উসুল আস-সালাসাহ মুখস্থ করছে। তারা বা তাদের মত কেউই হবে।
وَ اِنۡ تَتَوَلَّوۡا یَسۡتَبۡدِلۡ قَوۡمًا غَیۡرَکُمۡ ۙ ثُمَّ لَا یَکُوۡنُوۡۤا اَمۡثَالَکُمۡ ﴿۳۸﴾
যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে তিনি তোমাদের ছাড়া অন্য কোন কওমকে স্থলাভিষিক্ত করবেন। তারপর তারা তোমাদের অনুরূপ হবে না। [সূরা মুহাম্মদ ৪৭:৩৮]
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জীবনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়েও সবচেয়ে আশাবাদী ছিলেন। এই জিনিসটিই আপনাকে দেখাতে চাচ্ছি, যখন আপনি দেখবেন আল-গুতাহ এ হত্যাযজ্ঞ হচ্ছে, সেখানকার মসজিদে মানুষদের হত্যা করা হয়েছে তাই বলে এগুলো দেখে আশাহত হবার কিছু নেই। আপনি আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা রাখুন। যদি আল্লাহর তাওহীদে আপনার আস্থা পূর্ণাঙ্গ থাকে, আপনি যদি ইসলামের মূলনীতিগুলোকে আঁকড়ে ধরতে পারেন তাহলে আপনার আশা একদিন পূরণ হবেই, দ্বীন একদিন বিজয়ী নিশ্চয়ই হবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা থেকে চলে যাচ্ছিলেন তখন সুরাকাহ তাঁর লুকিয়ে থাকার জায়গা খুঁজে পায়। তিনি হিজরত করছিলেন, কিন্তু এমতাবস্থায় শত্রুর চোখে পড়ে যান। সুরাকাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পেয়ে যান কিন্তু সুরাকাহর রাব্ব রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষা করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাথার জন্য দুইশত উট এর পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছিল তাকে জীবিত বা মৃত হাজির করার জন্য। সুরাকাহ পুরোদস্তুর অস্ত্রে সজ্জিত, অন্যদিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ললাম তারা জামা পিঠে রেখে হাঁটছেন, তাঁর কাছে কোন অস্ত্র নেই। আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু বারবার পিছনে উদ্বিগ্ন দৃষ্টি হানছেন। কিন্তু রাসূলের মনে কোন চিন্তা নেই, কারণ আল্লাহ তাকে যা আদেশ করেছেন তাই তিনি করছেন, আল্লাহর উপর রয়েছে তাঁর অগাধ আস্থা। তিনি আল্লাহর দ্বীনকে রক্ষার কাজ করছেন, আল্লাহও তো তাকে রক্ষা করবেনই। যখন আপনি এই আয়াতটি তিলাওয়াত করেন, ‘আপনি যদি আল্লাহকে বিজয় দান করেন, আল্লাহও আপনাকে বিজয় দান করবেন’ তখন আপনার কিরূপ অনুভূতি হয়?
আমরা সবাই এই বিষয়গুলি জানি কিন্তু পুরোপুরি বুঝতে পারিনা, মানতে পারিনা আর বিশ্বাসও করতে পারি না। আল্লাহ কি বলছেন আমাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বের হয়ে তাকে রক্ষা করতে? আস্তাগফিরুল্লাহ। সাত আসমানের উপরে নিজের আরশে যিনি রয়েছেন তিনি কি তাকেই রক্ষা করতে বলছেন অস্ত্র দ্বারা?
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِنۡ تَنۡصُرُوا اللّٰہَ یَنۡصُرۡکُمۡ وَ یُثَبِّتۡ اَقۡدَامَکُمۡ ﴿۷﴾
হে মুমিনগণ, যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর তবে আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সুদৃঢ় করে দেবেন। [সূরা মুহাম্মদ ৪৭:৭]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরাকাহর উটের দিকে ইঙ্গিত করামাত্রই সেটি বসে পড়ল।
তখন সুরাকাহ বলল, ‘আমার জন্য দুয়া করুন তাহলে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাব।’ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাই করলেন। কিন্তু সুরাকাহ তাঁর পূর্বের কথা ভুলে গিয়ে আবার সুযোগ নেবার চেষ্টা করল, হয় তাকে মেরে ফেলবে নাহয় বন্দি করবে। কিন্তু রাসূলের ইঙ্গিতে আবারা তাঁর উটের পদবনত হল। তৃতীয়বারের মত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ফিরে যেতে বললেন আর বললেন তোমাকে কিসরার (স্যাসানীয় সাম্রাজ্যের শেষ অধিপতি) ব্রেসলেট দেয়া হবে। এটাই তো ইয়াকীন! নিজের ভূমি থেকে এক বিতাড়িত মানুষ তিনি, সাথে কেবল আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু আছেন, পুরো দুনিয়া তাঁর বিরুদ্ধে, তাঁর ও আবু বকরের মাথার উপর ২০০ উট পুরষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে, তারা মরুভূমির গহীনে অবস্থান করছেন, জানেন না আর কয়েক কদমও সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন না আর তিনিই কিনা বলছেন সেকালের পরাশক্তি স্যাসানীয় সাম্রাজ্যের মহারাজা কিসরার ব্রেসলেট তাকে দেয়া হবে? যখন তিনি বলেছিলেন, আমি তোমাকে ব্রেসলেট দেব তখন তিনি আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা নিয়েই কথাটি বলেছিলেন। কথাটি একটু অন্যভাবে বলা যাক। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা বললেন যে সুরাকাহ কিসরার ব্রেসলেট পাবে তখন তিনি তাকে এটাই বুঝিয়েছেন যে তিনি মদিনায় গিয়ে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন, ইসলাম সম্মানিত হবে এবং ইসলাম ছড়িয়ে পড়বে। ইসলাম সুশোভিত হবে, একদিন কিসরার উপর থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবে।
সেসময়ে দুটো পরাশক্তি ছিল আর তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত, একবার রোমানরা জিতত তো আরেকবার পার্শিয়ানরা। কিসরা সেসময় পার্শিয়ানদের নেতা ছিলেন, আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন সুরাকাহ এর কাছে সেই ওয়াদা করেন তখন পার্শিয়ানরাই ক্ষমতার দিক দিয়ে এগিয়ে ছিল। সেসময়ে এসব ব্রেসলেট বর্তমানের মুকুটের আইতেও বেশী বিখ্যাত ছিল। এসব ব্রেসলেট ক্ষমতার নিদর্শন বয়ে বেড়াত, অর্থাৎ ব্রেসলেট পাওয়া মানে তাঁর ক্ষমতাটাই পাওয়ার মত ব্যাপার। যারা জানেন না, এসব ব্রেসলেট বর্তমানের হাতঘড়ির মত কিছু ছিল না। এগুলো এতটাই ভারি ছিল যে এগুলো পরা হত না, বরং তারা তাদের হাত এসব ব্রেসলেটে ঢুকিয়ে দিত হাতটা কোন জায়গায় রেখে। এভাবেই ক্ষমতার প্রদর্শন চলত।
তিনি কোন সময়ে বললেন আমি তোমাকে কিসরার ব্রেসলেট দেব? মরুভূমিতে, হিজরতরত অবস্থায়, যখন তাঁর মাথার উপরে চড়া দাম হাঁকানো হয়েছে, যখন পুরো কুরাইশ তাঁর পিছে লেগেছে। তিনি তখনও মক্কার মরু ত্যাগ করতে পারেননি, তিনি তাঁর যাত্রার মধ্যপথে আছেন আর তখনই কিনা সুরাকাহকে ব্রেসলেট দেবার ওয়াদা করছেন। তিনি তাই করছেন যার আদেশ তাকে দেয়া হয়েছে, আল্লাহর উপর পূর্ণ ভরসা ছিল তাঁর। কিন্তু বর্তমান উম্মাহর ইয়াকীন এবং আল্লাহর আইন মানা এই দুই ক্ষেত্রেই ঘাটতি রয়েছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মৃত্যুর পরে আবু বাকর রাদিআল্লাহু আনহু খিলাফতের হাল ধরেন এবং মৃত্যূবরণ করেন, এরপরে উমর রাদিআল্লাহু আনহু মাত্র দুই দশকের মধ্যেই সেই চারা উত্তোলন করেন যার বীজ রাসূল বপন করেছিলেন। উমর রাদিআল্লাহু আনহু কিসরার ব্রেসলেট গ্রহণ করেন এবং চিৎকার করে বলেন সুরাকাহ কোথায়? যদি পুরো দুনিয়া ভুলে যায়, উমর রাদিআল্লাহু আনহু তাও ভুলবেন না তাঁর শিক্ষক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরাকাহ এর কাছে কি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। তিনি সুরাকাহকে ব্রেসলেটটি দিয়ে বললেন, এই নাও সেই ব্রেসলেট যার ওয়াদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাকে মরূভূমির উপর করেছিলেন।
এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে কঠিন সময়েও আল্লাহর উপরে পূর্ণ ভরসা রাখতে হবে। যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তখন সবকিছুই তাঁর বিরুদ্ধে যাচ্ছিল, কিন্তু তিনি আল্লাহর উপর ইয়াকীন রেখেছিলেন আর পরবর্তীতে তাই ঘটল যেভাবে তিনি বলেছিলেন।
তাই আমাদেরও সর্বদা একমাত্র আল্লাহর ওপরই ভরসা রেখে চলতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে হিদায়াতের পথে অটল থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।