বর্তমান পৃথিবীতে অবিশ্বাস্য গতিতে প্রযুক্তিক্ষেত্রের বিকাশ ঘটছে। আর সেই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ যেসব পালক যুক্ত হয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি শাখা, যেখানে মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কম্পিউটার দ্বারা অনুকৃত করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন হয়ে উঠেছে একটি একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্র যেখানে পড়ানো হয় কীভাবে বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন করবে এমন কম্পিউটার এবং সফটওয়্যার তৈরি করতে হয়।
মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তা শক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তি নির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলে। কম্পিউটারকে মিমিকস কগনেটিক এককে আনা হয় যাতে করে কম্পিউটার মানুষের মত ভাবতে পারে। যেমন শিক্ষা গ্রহণ এবং সমস্যার সমাধান। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সক্ষমতা আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই এটি নানা যুগান্তকারী উদ্ভাবন ঘটিয়ে চলছে, আমূল বদলে দিয়েছে অনেক ইন্ডাস্ট্রিকে। ব্রেইনের কার্যকলাপ ট্র্যাক করা থেকে শুরু করে কেবল বর্ণনা থেকেই ছবি তৈরী করে ফেলার বিস্ময়কর ক্ষমতা – সব কিছুতেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রেখে চলছে তার কৃত্রিম মেধার ছাপ। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দুনিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ককে আরেকটু বদলে দিতে চলেছে। উঁহু, অনেকটাই বদলে দিবে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভিত্তিক আবিষ্কার বা ইনোভেশন যা-ই বলি না কেন, তা আশ্চর্য বললেও কম বলা হবে। সাম্প্রতিককালে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্রেইনের সিগন্যালকে ডিকোড করার ক্ষমতা দেখিয়েছে। এমআরআই স্ক্যানের মাধ্যমে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যালগরিদম বুঝতে পারছে একজন ব্যক্তি কি দেখছেন, কি ভাবছেন ইত্যাদি। মানুষের বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে জানার নতুন দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে এটি। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক বিষয়াদিতেও সমান তালে পাল্লা দিয়ে চলেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। একজনের সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট, তার মতামত, তার আচার-আচরণ ও কথাবার্তা থেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যাকুরেটলি বলে দিতে পারছে কোন লোক কোন দলের সমর্থক, সে কাকে ভোট দিতে যাচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বলে দিতে পারবে, আপনি কি লিবারেল নাকি কনজারভেটিভ।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি মানুষের জন্যে বিপদজনক হয়ে উঠছে?
এই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে মূলত চ্যাটজিপিটি নামের একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাজারে আসার পর। ভাষাভিত্তিক এই চ্যাটবট তার তথ্যভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে প্রায় সব প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারে।
চ্যাটজিপিটি রচনা লিখতে পারে, চাকরির বা ছুটির আবেদন, যেকোনো রিপোর্ট তৈরি করতে পারে, এমনকি গান ও কবিতাও লিখতে পারে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ক্ষমতা দেখে সারা বিশ্বের প্রযুক্তি বিষয়ক নীতি-নির্ধারক, বিনিয়োগকারী এবং নির্বাহীরা নড়ে চড়ে বসেন। এক হাজারের মতো ব্যক্তি এক খোলা চিঠিতে এই প্রযুক্তির ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, গবেষণায় এখনই রাশ টেনে না ধরলে সমাজ ও মানবজাতি বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়বে।
আয়ারল্যান্ডের একজন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ নাসিম মাহমুদ, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড হেলথ-গ্রুপের একজন প্রকৌশলী এবং এই প্রতিষ্ঠানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করছেন, তিনি বলছেন এই ভয় অনেকটাই মানসিক।
“এটা হচ্ছে অজানাকে ভয় পাওয়ার মতো ভয়,” বলেন তিনি।
নাসিম মাহমুদ বলছেন, “ধরা যাক আমরা একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে দায়িত্ব দিলাম প্রেসক্রিপশন লিখে দেওয়ার জন্য। সে লিখেও দিল। তার এই লেখা পর্যন্ত আমরা অনেকভাবে পরীক্ষা করে নিলাম। এর ভালো দিকটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয় যা আমাদের বর্তমান সময়ের এথিকসের সাথে সংঘাতপূর্ণ, তখন কী হবে!”
“এই ভুল তো মানুষও করেছে। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে আমরা এই জায়গাতে দেখতে চাই না,” বলেন তিনি।
চ্যাটজিপিটির মতো জেনারেটিভ এআই নিয়ে উদ্বেগ ঠিক এই কারণেই। এই এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের সুলিখিত উত্তর তৈরি করা সম্ভব। এর ফলে একজন ছাত্রকে সুশিক্ষিত করে তোলার যে মূল লক্ষ্য সেটা ব্যাহত হতে পারে। [সূত্রঃ বিবিসি]
তবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সংক্রান্ত আবিষ্কারের পাল্লায় যে আবিষ্কার মানুষের নজর বেশী কেড়েছে তা হলো জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মডেলগুলো। যেমন, মিডজার্নি। মিডজার্নির নাম আপনারা অনেকেই শুনেছেন। কেবল ছবির বর্ণনা থেকেই এই প্রযুক্তিটি হাই কোয়ালিটির ছবি তৈরী করতে সক্ষম। যেমন, আপনি যদি লেখেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সাথে চাঁদে বসে কোলাকুলি করছেন – আপনাকে মিডজার্নি ঠিক এরকম একটা ছবিই তৈরী করে দেখাবে। এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মডেল যেন আমাদের কল্পনাকেও হার মানাতে চলেছে। আর দিন দিন এসবের সক্ষমতা বেড়েই চলেছে। মিডজার্নির মতো আরেকটি ইমেজ জেনারেটিভ মডেল হচ্ছে ওপেন এআই কোম্পানির ডাল-ই এবং ডাল-ই টু। ডাল-ই এর চেয়ে তার পরের সংস্করণ আরো ক্ষমতাসম্পন্ন, আরো সুন্দর, হাই কোয়ালিটি ও বাস্তবসম্মত ছবি তৈরী করতে সক্ষম। এভাবে এআই মডেলগুলো দিনদিন প্রোগ্রেস করছে।
টেক্সট-টু-ভিডিও টেকনোলজি – নাম শুনেই হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন এই প্রযুক্তির কাজ কি। তবুও বলি, এটা মিডজার্নির মতোই। তবে এটি বর্ণনা থেকে ছবি বানানোর বদলে ভিডিও বানাবে। Runway Gen 2 –এর মতো প্ল্যাটফর্মগুলো এই কাজের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বর্তমানে ইউটিউবে সার্চ দিলে অনেক এআই জেনারেটেড বিজ্ঞাপন ও কনটেন্ট দেখা যাচ্ছে এবং দিন দিন এগুলো স্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। এআই যে কীভাবে কনটেন্ট ক্রিয়েশনের জগতে ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে তা আমরা আন্দাজ করতে পারছি। এ ছাড়া, এআই দিয়ে ভয়েস ম্যানিপুলেশন বা কন্ঠস্বর নকল করা যায় নানা কাজের জন্য। যেমন, আপনি চাইলে যে কারো ভয়েস হুবহু ক্লোনিং করতে পারবেন।
কিন্তু এআই যেমন আশার আলো দেখাচ্ছে, তেমনি এর আছে নানা অন্ধকার দিক। কিছু নৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে যেগুলোর দিকে আমাদের মনোযোগ দেওয়া কাম্য। এআই এর সদ্ব্যবহারের পাশাপাশি অসৎ কাজেও এআই ব্যবহৃত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে ডিপফেক। ডিপফেক হলো বাস্তবসম্মত দেখতে কিন্তু নকল বা কিছুটা পরিবর্তিত কন্টেন্ট যা ভিডিও বা অডিওর উপাদান সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়। ডিপফেক ভিডিওতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন ব্যক্তির মুখের অবয়ব বা ভয়েসকে অন্য কারোর সাথে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়। ডিপফেকের মাধ্যমে বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের পর্নোগ্রাফি বানানো হচ্ছে। এ ছাড়া আরো নানা প্রতারণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের মা-বোনরা, যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি শেয়ার করেন, তারাও এআই এর ফাঁদ থেকে রক্ষা পাচ্ছেন না। তাদের ছবি থেকেও পর্নোগ্রাফি বানানো হচ্ছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি এআই জেনারেটেড ইমেজ স্টক মার্কেটেও ভারসাম্যহীনতা আনছে। তাই এর ব্যবহার অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত, যেন মানবতার ক্ষতি না করে বসে এআই।
এআই যে বড় বড় উন্নয়ন সাধন করেছে, সেগুলো যেমন মাথায় রাখতে হবে, তেমনি যেসব নৈতিক বিষয়াদিতে এআই আঘাত হেনেছে সেগুলোও আমাদেরকে বিবেচনা করে দেখতে হবে। এআই নিয়ে আলোচনা একটা ক্রিটিকাল অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ইলন মাস্ক নানা খারাপ কাজে এআইয়ের ব্যবহার হওয়ার ব্যাপারে আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন, যেমন অ্যাসাসিন ড্রোন তৈরী করা। এই বিষয়গুলো প্রযুক্তির দ্বৈত ধর্মকেই চিহ্নিত করে। অর্থাৎ, এটা যেমন মারাত্মক উন্নতি সাধন করে সমাজের, তেমনি বড় বড় বিপর্যয়ও ডেকে আনে। সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে, তারা এআই এর ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রিত করবেন এবং নিশ্চিত করবেন, এটাকে যেন কেবল ইতিবাচক পরিবর্তন ও কাজেই ব্যবহার করা হয়।