স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। বহুল প্রতীক্ষিত মেট্রোরেলের কাজও এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। পুরোদমে চলছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি, পায়রা বন্দর প্রকল্পের কাজ। এমন আট মেগা প্রকল্প বিশ্ব কাতারে আরও এগিয়ে নিচ্ছে বাংলাদেশকে। সবগুলো সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প। রয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সার্বক্ষণিক তদারকি। দেশের উন্নয়নমূলক এসব প্রকল্পের সুফল প্রাপ্তির দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ।পদ্মা সেতু ২০২২ সালের জুন মাসে খুলে দেওয়া হবে। মেট্রোরেল চালু হবে ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে। মেগা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত না হলেও কাঙ্ক্ষিত কর্ণফুলী টানেল চলতি বছরের অক্টোবরে খুলে দেওয়া হবে।
চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট আটটি মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে- পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প, মেট্রোরেল প্রকল্প, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প ও সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প।মেগা প্রকল্প প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, মানুষের কোভিড ভীতি কমেছে। কাজের গতি বেড়েছে। সরকার যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল তার মধ্যেই মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে ফেলবো। আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এগুলো সব সময় মনিটরিং করা হয়। তিনটি প্রকল্প চলতি বছর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ফলে প্রবৃদ্ধি বাড়বে। প্রবৃদ্ধি কী পরিমাণ বাড়বে তার সঠিক হিসাব করা মুশকিল। তবে এটা বলতে পারি মেগা প্রকল্প খুলে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির চাকা কয়েকগুণ গতিতে ঘুরবে। মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি পাবে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প
সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম পদ্মা বহুমুখী সেতু। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের মোট অগ্রগতি ৮৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে ২৬ হাজার ৬৫৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দ্বিতল এ সেতুর ৪২টি পিলারে মোট ৪১টি স্প্যান বসেছে। এই সেতুর ওপর দিয়ে গাড়ি আর নিচ দিয়ে ট্রেন চলাচল করবে।
মেট্রোরেল প্রকল্প
চলতি বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশের বাণিজ্যিক চলাচল শুরুর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রকল্পটি উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে কমলাপুর পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৭৪ দশমিক ০৪ শতাংশ। তবে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৯০ শতাংশের উপরে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে প্রকল্পের আওতায় ১৬ হাজার ৯৬৮ কোটি ৮৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প
চীনের অর্থায়নে এগিয়ে যাচ্ছে পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প। ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের মাধ্যমে বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে জাতীয় ও আন্তঃদেশীয় রেল যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এ রেলপথটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২৩টি জেলায় প্রথম রেলসংযোগ স্থাপন করবে। প্রকল্পের মোট অগ্রগতি ৫০ দশমিক ৫০ শতাংশ ও আর্থিক অগ্রগতি ২০ হাজার ৩৩৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা। প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের ঋণ ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। বাকি অর্থায়ন সরকারি কোষাগার থেকে মেটানো হবে। সেতুর রেল সংযোগটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে মাওয়ায় পদ্মা সেতু ও রেল সংযোগ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুন মাসে শেষ হবে।
দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্প
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজারের রামু হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত ১৮৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণের কাজ চলমান। প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৬ শতাংশ এবং প্রকল্পের আওতায় মোট ৬ হাজার ২২৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ ১৩ হাজার ১১৫ কোটি টাকা ও বাকি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে মেটানো হবে।প্রকল্পের অধীনে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে হচ্ছে ঝিনুক আকৃতির আইকনিক স্টেশন। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর ওপর নির্মিত হচ্ছে তিনটি বড় সেতু। সাতকানিয়ার কেঁওচিয়ায় নির্মাণ হচ্ছে উড়াল সেতু। ফলে পর্যটন শহর কক্সবাজার ও সেখানে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে যোগাযোগের পথ সুগম হবে। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প
২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পাবনার রূপপুরে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে রাশিয়ার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করে সরকার। চুক্তি বাস্তবায়নের সময়কাল ধরা হয়েছে সাত বছর। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট ২০২৩ সালে ও দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৪ সালের অক্টোবরে উৎপাদনের সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ৬০ বছর ধরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এক লাখ এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে পাবনার রূপপুরে, যেখানে দুটি ইউনিটে ১২০০ মেগাওয়াট করে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রকল্পের মোট অগ্রগতি ৪৩ দশমিক ১২ শতাংশ। এরই মধ্যে প্রকল্পের আওতায় মোট ব্যয় হয়েছে ৪৬ হাজার ৭৪৭ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প
সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো। এরই মধ্যে বন্দরটির কার্যক্রম মোটামুটি মাত্রায় শুরু হয়েছে। প্রকল্পের মোট অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ। এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে তিন হাজার ৮৪ কোটি টাকা। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হবে। ৩ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে।পায়রা থেকে ঢাকামুখী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কাজও চলছে দ্রুতগতিতে। সরকারের লক্ষ্য ২০২৩ সালের মধ্যে ১৬ মিটার গভীরতায় চ্যানেল ড্রেজিং সম্পন্ন করে পূর্ণাঙ্গ বন্দর সুবিধা গড়ে তোলা। মূলত চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমাতে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়ায় রাবনাবাদ চ্যানেলে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হচ্ছে।
মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প
কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে বিদ্যুতের হাব গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এজন্য শুধু বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, পুরো এলাকাটিকেই একটি আধুনিক শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মাতারবাড়ি ও ঢালঘাটা ইউনিয়নের এক হাজার ৪১৪ একর জমিতে এ প্রকল্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হবে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে। প্রকল্পের আওতায় ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি স্টিম টারবাইন, সার্কুলেটিং কুলিং ওয়াটার স্টেশন স্থাপন, ২৭৫ মিটার উচ্চতার চিমনি ও পানি শোধন ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে। কয়লা আমদানির জন্য নদীতে ৭ কিলোমিটার নৌচ্যানেল তৈরি করা হবে। পাশাপাশি কয়লা ওঠানামার জন্য নির্মাণ করা হবে জেটি। চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৫২ দশমিক ২০ শতাংশ। প্রকেল্পের আওতায় এরই মধ্যে ১৯ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এখানে সংশ্লিষ্ট ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। ২০১৫ সালের আগস্টে মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ৩৬ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। প্রকল্পের ২৯ হাজার কোটি টাকা দেবে জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা-জাইকা। বাকি ৫ হাজার কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হবে। অবশিষ্ট অর্থের জোগান দেবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ও স্বত্বাধিকারী কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)।