মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্লামের হাদিসের বেশ কিছু বর্ণনায় আয়াতুল কুরসিকে সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াত হিসেবে বলা হয়েছে। মুসলিম হিসেবে এই আয়াতটি দৈনিক তিলাওয়াত করা অত্যন্ত জরুরী এবং এটি অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। এই আয়াত আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালার) নাম ও প্রশংসা ধারণ করে। এটি ছাড়াও আয়াতুল কুরসি পাঠের অনেক উপকারিতা রয়েছে। প্রথমে আমরা আয়াতটি পড়ব। এরপর আয়াতটির নানাবিধ ফজিলত আমরা জানব এবং দৈনন্দিন জীবনে আয়াতুল কুরসি পাঠকে অবিচ্ছেদ্য অংশ বানাব।
اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ ۗ مَن ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِندَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِّنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ ۖ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ
আল্লাহ, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণকারী। তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, তাঁরই। কে সেই ব্যক্তি যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করে? তিনি লোকদের সমুদয় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অবস্থা জানেন। পক্ষান্তরে মানুষ তাঁর জ্ঞানের কোনকিছুই আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়, তিনি যে পরিমাণ ইচ্ছে করেন সেটুকু ছাড়া। তাঁর কুরসী আকাশ ও পৃথিবী পরিবেষ্টন করে আছে এবং এ দু’য়ের রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না, তিনি উচ্চ মর্যাদাশীল, মহান। [সুরা বাকারাঃ ২৫৫]
এ আয়াতটিকে আয়াতুল কুরসী বলা হয়। এটি মর্যাদার দিক থেকে কুরআনের সর্ববৃহৎ আয়াত। হাদিসে এ আয়াতের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। হাদিসে এসেছে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উবাই ইবনু কাবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কুরআনের মধ্যে কোন আয়াতটি সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ? উবাই ইবনে কাব বললেন, তা হচ্ছে আয়াতুল কুরসী। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা সমর্থন করে বললেন, হে আবুল মুনজির! জ্ঞান তোমার জন্য সহজ হোক’। [সহিহ মুসলিমঃ ৮১০]
এ আয়াতে মহান রব আল্লাহ জাল্লাশানুহুর একক অস্তিত্ব, তাওহিদ ও গুণাবলীর বর্ণনা এক অত্যাশ্চর্য ও অনুপম ভঙ্গিতে দেয়া হয়েছে। যাতে আল্লাহর অস্তিত্ববান হওয়া, জীবিত হওয়া, শ্রবণকারী হওয়া, দর্শক হওয়া, বাকশক্তিসম্পন্ন হওয়া, তার সত্তার অপরিহার্যতা, তার অসীম-অনন্ত কাল পর্যন্ত থাকা, সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা ও উদ্ভাবক হওয়া, যাবতীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া, সমগ্র বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়া, এমন শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের অধিকারী হওয়া যাতে তার অনুমতি ছাড়া তার সামনে কেউ কোন কথা বলতে না পারে, এমন পরিপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া যাতে সমগ্র বিশ্ব ও তার যাবতীয় বস্তুনিচয়কে সৃষ্টি করা এবং সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং তাদের শৃংখলা বজায় রাখতে গিয়ে তাকে কোন ক্লান্তি বা পরিশ্রান্তির সম্মুখীন হতে হয় না এবং এমন ব্যাপক জ্ঞানের অধিকারী হওয়া যাতে কোন প্রকাশ্য কিংবা গোপন বস্তু কিংবা কোন অণু-পরমাণুর বিন্দু-বিসর্গও যাতে বাদ পড়তে না পারে। এই হচ্ছে আয়াতটির মোটামুটি ও সংক্ষিপ্ত বিষয়বস্তু। ইমাম ইবনু কাসির রাহ. বলেনঃ এ আয়াতটিতে দশটি বাক্য রয়েছে। প্রতিটি বাক্যের সাথেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিক্ষা রয়েছে।
আয়াতুল কুরসি পাঠের দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ
আবূ উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এক বর্ণনায় নবী করীম (সাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পরপরই আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, তার এবং জান্নাতে প্রবেশের মাঝে মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
কল্পনা করুন যে জান্নাত লাভের জন্য আপনাকে কেবল প্রত্যেক ফরজ সালাতের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করতে হবে! এটা কি আপনাকে প্রতি নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করতে অনুপ্রাণিত করবে না? জান্নাতে প্রবেশের অনেক উপায় ও পন্থা রয়েছে। যদিও জান্নাতে প্রবেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার রহমত লাভ করা। তবে জান্নাত লাভের বড় একটি মাধ্যম হলো আয়াতুল কুরসি পাঠ। তাই আমাদের এটির সদ্ব্যবহার করা উচিত।
আয়াতুল কুরসি আপনাকে সুরক্ষা দেবে
আয়াতুল কুরসির মন্দ বা খারাবি থেকে সুরক্ষার দেয়। হাদিসের একটি বর্ণনায় এসেছে যে,
আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” مَنْ قَرَأَ حم الْمُؤْمِنَ إِلَى : (إِلَيْهِ الْمَصِيرُ ) وَآيَةَ الْكُرْسِيِّ حِينَ يُصْبِحُ حُفِظَ بِهِمَا حَتَّى يُمْسِيَ وَمَنْ قَرَأَهُمَا حِينَ يُمْسِيَ حُفِظَ بِهِمَا حَتَّى يُصْبِحَ ”
যে ব্যক্তি সকালবেলা সুরা আল-মুমিন-এর হা-মী-ম হতে ইলাইহিল মাসীর (১, ২, ও ৩ নং আয়াত) পর্যন্ত এবং আয়াতুল কুরসী তিলাওয়াত করবে সে এর উসীলায় সন্ধ্যা পর্যন্ত (আল্লাহ তাআলার) হিফাযাতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যা বেলায় তা পাঠ করবে সে ব্যক্তি এর উসীলায় সকাল পর্যন্ত হিফাযাতে থাকবে। [জামে আত তিরমিজিঃ ২৮৭৯]
সকালে এবং সন্ধ্যায় একবার আয়াতুল কুরসি পাঠ করলে এটি আপনাকে সারাদিন ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করবে, সুরক্ষা দেবে। আমরা পবিত্র কুরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াতটি তিলাওয়াত করে আমাদের স্রষ্টার হাতে আক্ষরিক অর্থে নিজেদের সুরক্ষিত রাখছি।
একটি ভিন্ন বর্ণনায় এসেছে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সূরা বাকারা পাঠ করবে, শয়তান সেই ব্যক্তির ঘরে প্রবেশ করতে পারবে না।
আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لَا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ مَقَابِرَ إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنْ الْبَيْتِ الَّذِي تُقْرَأُ فِيهِ سُورَةُ الْبَقَرَةِ
তোমাদের ঘরকে কবর বানিয়ে নিয়ো না (অর্থাৎ কবরে যেমন নামায বা তেলাওয়াত হয় না তেমনি বিনা নামায ও তেলাওয়াতে ঘরকেও তার মত করো না; বরং তাতে নামায ও তেলাওয়াত করতে থাক।) অবশ্যই শয়তান সেই ঘর হতে পলায়ন করে যে ঘরে সূরা বাকারাহ পাঠ করা হয়। [সহিহ মুসলিমঃ ১৮৬০]
সাহল ইবনে সাদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ لِكُلِّ شَيْءٍ سَنَامًا وَإِنَّ سَنَامَ الْقُرْآنِ سُورَةُ الْبَقَرَةِ مَنْ قَرَأَهَا فِي بَيْتِهِ لَيْلًا لَمْ يَدْخُلِ الشَّيْطَانُ بَيْتَهُ ثَلَاثَ لَيَالٍ وَمَنْ قَرَأَهَا نَهَارًا لَمْ يَدْخُلِ الشَّيْطَانُ بَيْتَهُ ثَلَاثَةَ أَيَّامٍ
“নিশ্চয়ই সবকিছুরই একটি চূড়া রয়েছে এবং কুরআনের শীর্ষস্থান হল সূরা বাকারা। যে ব্যক্তি রাতে তার ঘরে এটি পাঠ করবে, শয়তান তার ঘরে তিন রাত পর্যন্ত প্রবেশ করবে না। যে ব্যক্তি দিনে পাঠ করবে, শয়তান তার ঘরে তিন দিন প্রবেশ করবে না।” [সহীহ ইবনে হিব্বানঃ ৭৮২]
সুতরাং, আয়াতুল কুরসির অসংখ্য ফজিলতের ভেতরে মূল কয়েকটা ফজিলত হচ্ছেঃ
১) যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে ইনশাআল্লাহ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
২) যে কেউ সকাল ও সন্ধ্যায় আয়াতুল কুরসি পাঠ করবে ইনশাআল্লাহ সকল প্রকার ক্ষতি থেকে সে রক্ষা পাবে।
৩) যে ব্যক্তি বদ নজর বা জাদুতে আক্রান্ত সে আয়াতুল কুরসি পাঠ করে এগুলো থেকে নিরাময় পেতে পারে।
৪) সুরা বাকারার আয়াতুল কুরসি তিলাওয়াত আপনার ঘরকে শয়তান থেকে রক্ষা করে।
হয়তো আপনি নিয়মিত আয়াতুল কুরসি তিলাওয়াত করতেন না। নিশ্চয়ই এই ফজিলতগুলো জানা আপনাকে আয়াতুল কুরসি পাঠে আরো অনুপ্রাণিত করবে।