: প্রিয়া, শুনছেন?
– হ্যাঁ শুনছি, বলুন।
: এখনকার আকাশ দেখেছেন?
– না তো।
: একটু কি দেখবেন?
আমি আর কোনো কথা বললাম না। ঘড়িতে এখন তিনটা বেজে তিন মিনিট। একটু বিরক্তি নিয়েই বিছানা ছেড়ে ভারী পর্দাগুলো সরিয়ে জানালা খুলে দিলাম।
সুবহানাল্লাহ! নীল আকাশে ধূসর মেঘের আনাগোনা। ঈশান কোণে ইতোমধ্যে কৃষ্ণ বর্ণ মেঘ জমতে শুরু করেছে। চারদিকে কি সুন্দরভাবে আঁধার নেমে আসছে। তারমানে… তারমানে… আমি যেন আর ভাবতে পারছিলাম না। প্রচন্ড উত্তেজনায় আমি যেন বাকরুদ্ধ। আমার বহুল আকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি নামার আভাস!
আমি ভিজবো! আমি বৃষ্টি ছোঁবো! ও আমার মালিক, তুমি আমাকে আরো ভালোবাসো প্লিজ।
বিছানায় ফেলে রাখা মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি প্রিয়ম এখনো লাইনেই আছে। খুশিতে আমার শ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইল কানে ধরার সাথে সাথেই প্রিয়ম বলে উঠলো, “কেমন চমকে দিলাম বলুন তো? আমি না বললে আপনি তো বিষণ্নঘুমে এখনো তলিয়ে থাকতেন। যাহোক, আপনি তৈরি থাকুন আমি আসছি।”
তাড়াতাড়ি করে বললাম,
-আপনি আসছেন মানে? আমরা কোথাও বেরুবো?
: হ্যাঁ বেরুবো।
– সত্যিইইই? কোথায় যাব?
: সেটা না হয় আপনার জন্য আরেকটা সারপ্রাইজ হোক। এখন রাখি। ঠিক তিনটে ত্রিশে আমি নিচে থাকব। আপনাকে কল করার সাথে সাথেই চলে আসবেন, ওকে?
– ওকে।
.
.
সময় তিনটা ত্রিশ মিনিট। ততক্ষণে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামা শুরু হয়েছে। আমি নিচে নেমে দেখি, প্রিয়ম কাকভেজা হয়ে রিক্সায় বসে আছে। দাড়ি থেকে চুইয়ে পড়ছে বৃষ্টির স্নিগ্ধতা। আমি কাছে যেতেই উনি হাত বাড়িয়ে আমাকে ওনার পাশে বসালেন। বসেই আমি বলা শুরু করলাম,
– আপনি জানেন আমি কতটা কৌতূহলী। তারপরও এত লুকোচুরি কেন? বলুন কোথায় যাচ্ছি আমরা। না বললে কিন্তু এক্ষুনি রিক্সা থেকে নেমে যাব আমি।
তাঁর দিকে না তাকিয়েই কপট রাগে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম। উনি জানেন আমি কতটা ছেলেমানুষী। এও জানেন, যথার্থ উত্তর না পেলে আমি সত্যিই নেমে যাব।
তাই কালবিলম্ব না করে আমার কালো মোজায় আবৃত হাত তাঁর দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে কোমল কন্ঠে বললেন,
“প্রথমে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে রিক্সায় ঘুরে বৃষ্টিবিলাস করব এরপর কৈলাসপার্কের ঐ নদীটা, যে নদীর নাম আপনি দিয়েছেন ‘ময়ূরাক্ষী’ সেখানে যাব। নদীর পানিতে দুইজোড়া পা ভিজিয়ে বৃষ্টি দেখবো, বৃষ্টির তান শুনব আর মন ভরে দেখব বৃষ্টিস্নাত প্রিয়াকে। তখন আপনি নিকাব খুলতে পারবেন। এসময়টায় ওখানে কেউ থাকে না। আমি আগেই খোঁজ নিয়েছি।”
আমি অবাক চোখে প্রিয়মের দিকে তাকালাম। উনি আমাকে এত ভালো বোঝেন কীভাবে? দু’চোখ ওনার মুখে নিবদ্ধ রেখে বললাম,
-আপনি কীভাবে জানলেন, আমি এমন একটা দিন চেয়েছিলাম?
: ভালোবাসলে সব কিছু বলতে হয় না প্রিয়া। ভালোবাসার মানুষটির চোখের দিকে তাকালেই অনেক কিছু পড়ে ফেলা যায়।
মনের গভীর থেকে কেউ কাউকে অনুভব করলে অপরপক্ষের মানুষটির ভালোলাগা, চাওয়াগুলো নিজের মানসপটে আপনাআপনি ভেসে ওঠে। এজন্য জিজ্ঞাসার প্রয়োজন হয় না। আমি আপনাকে হৃদয় থেকে উপলব্ধি করি প্রিয়া। আমি ভেবে রেখেছি, আপনার সব চাওয়ার মাঝে অন্ততপক্ষে কিছু চাওয়া আপনি বলার আগেই আমি পূর্ণ করে ফেলব ইন শা আল্লহ। তার বিনিয়মে চাই, আপনার এই বিস্ময়মাখা অপরূপ চাহনি।
ওনার কথা শুনে আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমার জন্য শুকরিয়ার নামাজ পড়া ওয়াজিব হয়ে গেছে। আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ওনাকে বললাম,
-আমি এখন একটা জায়নামাজ কিনতে চাই।
উনি আমার এমন কথায় খানিকটা দমে গেলেন মনে হলো। এমন উত্তর উনি হয়তো আশাও করেননি। ম্লান কন্ঠে বললেন,
: আমি কি জানতে পারি, আপনি এখন কেন জায়নামাজ কিনতে চাচ্ছেন? ফেরার পথে বা আরেকদিন কি কেনা যাবে না?
– যাবে। কিন্তু আপনার মন আপনাকে এটা জানাতে পারেনি যে, বৃষ্টির দিনে নদী কিংবা সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা আমার অনেকদিনের ইচ্ছে।
উনি একটু হেসে বললেন,
: তবে একটা কেন? দুটো জায়নামাজ কিনব চলুন। আপনি দাঁড়িয়ে শুকরিয়ার নামাজ আদায় করবেন আর আমি অকৃতজ্ঞের মত বসে থাকব, এটা তো হতে পারে না।
আমার আরো একবার বিস্মিত হবার পালা। আমি বিস্ময়ের ধাক্কা কোনোমতে সামলিয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
-আ..পনি কী..ভা..বে জানলেন যে, আ..মি শুকরিয়ার নামাজ আদায় করতে চাই?
উনি বেশ কিছুক্ষণ মন খুলে হেসে নিলেন। এরপর বললেন,
: ঐতো আগেই বলেছি। আপনার চোখের ভাষা আমি পড়তে জানি, মায়াবতী।
আমি আর কিছু বললাম না। তব্দা খেয়ে বসে আছি। এই ধাক্কা পুরোপুরি সামলাতে আজকের গোটা দিনটাই চলে যাবে। যাক, তবে বৃষ্টি থাকুক। আরো থাকুক আমার প্রিয়ম, আমার অর্ধাঙ্গ।
|| আমার প্রিয়ম, আমার অর্ধাঙ্গ ||
লেখাঃ মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া।