সদকাতুল ফিতর রমাদান, রোজা ও ঈদের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। ইসলামের যাবতীয় বিধান মানবতার কল্যাণে নিবেদিত। সমাজের দুস্থ অসহায় হতদরিদ্ররাও যেন রমজান শেষে ঈদের আনন্দে শামিল হতে পারে, সে জন্য সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা। ফিতরা ঈদের নামাজের পূর্বে প্রদান করতে হয়।
ঈদের দিন সকালে যিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের (সাড়ে ৭ ভরি সোনা বা সাড়ে ৫২ ভরি রুপা বা সমমূল্যের নগদ অর্থ ও ব্যবসা পণ্যের) মালিক থাকবেন, তাঁর নিজের ও পরিবারের ছোট–বড় সবার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা তাঁর প্রতি ওয়াজিব। একে অন্যের ফিতরা আদায় করতে পারেন। নিসাব, রুপার হিসাবে বর্তমান বাজারমূল্যে সর্বনিম্ন ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা প্রায়।
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বর্ণনা করেন, ‘নবী (সা.)–এর জমানায় আমরা সদকাতুল ফিতর প্রদান করতাম এক সা (তিন কেজি তিন শ গ্রাম প্রায়) খাদ্যবস্তু, তিনি বলেন, তখন আমাদের খাদ্য ছিল: যব, কিশমিশ, পনির ও খেজুর।’ (বুখারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৪)।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্যবস্তু, যেমন: এক সা যব, এক সা খেজুর, এক সা পনির, এক সা কিশমিশ।’ (বুখারি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২০৫।
ফিতরা একটি ইবাদত, তাই যাঁরা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নন, তাঁদেরও ফিতরা আদায় করা সুন্নত ও নফল। আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন আমাদের মাঝে ছিলেন, তখন আমরা ছোট–বড়, মুক্ত ক্রীতদাস সকলের পক্ষ থেকে সদকাতুল ফিতর আদায় করতাম এক সা খাদ্য অর্থাৎ এক সা পনির বা এক সা যব বা এক সা খেজুর অথবা এক সা কিশমিশ। আমরা এভাবেই আদায় করতে ছিলাম।’ একবার হজরত মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.) হজ বা ওমরাহ উপলক্ষে মদিনায় এলেন, তিনি জনগণের উদ্দেশে মিম্বারে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। তখন তিনি আলোচনা করলেন সে বিষয়, যে বিষয়ে মানুষ প্রশ্ন করেছে।
তিনি বলেন, ‘আমি দেখছি শামের দুই মুদ (নিসফ সা বা পৌনে দুই কেজি) আটা সমান হয় (মূল্যমান হিসাবে) এক সা (তিন কেজি তিন শ গ্রাম) খেজুরের। অতঃপর মানুষ (সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিয়ীগণ) এই মত গ্রহণ করলেন।’ (মুসলিম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩১৭-৩১৮)।
আটা বা গমও এক সা (তিন কেজি তিন শ গ্রাম) দেওয়া উত্তম। হাসান বসরী (রা.) বর্ণনা করেন, আলী (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ যখন তোমাদের প্রাচুর্য দিয়েছেন, তোমরাও উদার হও, গমও এক সা দাও।’ (নাসায়ী, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২৬৮-২৭০)।
মুজতাহিদ ইমামদের মতে, যেসব খাদ্যবস্তু সহজে সংরক্ষণযোগ্য, সহজে বিনিময়যোগ্য ও বাজারমূল্য স্থিতিশীল থাকে; সেসব খাদ্যদ্রব্য দ্বারা সদকাতুল ফিতর আদায় করা যায়। উল্লেখ্য, চালের মধ্যে ওই তিনটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান এবং সৌদি আরবসহ সব আরব দেশ এবং প্রায় সব মুসলিম দেশ বর্তমানে চালের হিসাব গ্রহণ করেছে। মুজতাহিদ ফকিহরা বলেন যেখানে যা প্রধান খাদ্য, তা দ্বারা ফিতরা আদায় করা শ্রেয়।
হজরত ইমাম আযম আবুহানীফা (রা.)–এর মতে, অধিক মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম; অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরিবদের বেশি উপকার হয়, সেটাই উত্তম। ইমাম মালিক (রা.)–এর মতে, খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম এবং খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত ‘আজওয়া’ খেজুর দ্বারাই আদায় করা উত্তম। ইমাম শাফিয়ী (রা.)–এর মতে, হাদিসে উল্লিখিত বিষয়সমূহের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা আদায় করা উত্তম। অন্য সব ইমামদের মতও অনুরূপ। ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল (রা.)-এর মতে, সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর অনুসরণ হিসেবে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা উত্তম। এ ছাড়া সদকার ক্ষেত্রে ফকিহদের ঐকমত্য হলো, ‘যা গরিবদের জন্য বেশি উপকারী।’ (আল মুগনি, খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২১৯; আওজাযুল মাসালিক শরহে মুআত্তা মালিক, খণ্ড: ৬, পৃষ্ঠা: ১২৮)।
খাদ্যবস্তুর মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যের খেজুর বা উন্নত মানের চাল অথবা উহার মূল্যে ফিতরা প্রদান করা উত্তম। ধনীরা সর্বোচ্চ এবং সাধাণরা মাঝামাঝি মূল্যে আদায় করাই শ্রেয়। ইনসাফ হলো, যাঁরা যে চালের ভাত খান বা যাঁরা যে খেজুর দ্বারা ইফতার করেন, তাঁরা সে সমমানের বা সমমূল্যে ফিতরা আদায় করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তাই উত্তম, দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।’ (বুখারি, খণ্ড: ৩, পৃষ্ঠা: ১৮৮)। ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বেফাকুল মাদারিস, হাইআতুল উলইয়া ও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ২০১০ সাল থেকে এ নিয়মই অনুসরণ করছে।
সুবিধার জন্য সদকাতুল ফিতর রমাদানেও আদায় করা যাবে। ফিতরা তাদের দেওয়া যায়, জাকাত যে আটটি খাতে প্রদান করা যায়। কোরআন কারিমের বর্ণনা, ‘মূলত সদকাত হলো ফকির, মিসকিন, জাকাতকর্মী, অনুরক্ত ব্যক্তি ও নওমুসলিম, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে জিহাদ, বিপদগ্রস্ত বিদেশি মুসাফির ও পথ সন্তানদের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞানী ও পরম কৌশলী।’ (সূরা-৯ তাওবাহ, আয়াত: ৬০)।
নির্ধারিত খাদ্যদ্রব্য, পণ্যসামগ্রী বা তার মূল্যে টাকায়ও ফিতরা আদায় করা যায় এবং অন্য কোনো বস্তু (যেমন: পোশাক-আশাক, ঈদের বাজার ইত্যাদি) কিনেও দেওয়া যায়। পিতা-মাতা ও ঊর্ধ্বতন এবং ছেলেমেয়ে ও অধস্তন এবং যাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব রয়েছে (যেমন স্ত্রী ও পোষ্য), তাদের ওয়াজিব ফিতরা ও জাকাত প্রদান করা যায় না।
● মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম।