সমসাময়িক মুসলমানরা প্রায়শই নিজেদেরকে আপাতদৃষ্টিতে এক প্যারাডক্সের মুখোমুখি হতে দেখে। এই প্যারাডক্সটি আমাদের বর্তমান সময়ে আবির্ভূত হয়েছে। মুসলিমরা নিজেদের প্রশ্ন করে যে, আধুনিক সমাজে উলামা বা ইসলামী স্কলারদের কী কী ভূমিকা পালন করতে হবে। এই প্রশ্নটি বিভিন্ন প্রসঙ্গে উঠে।
কখনও কখনও তারা মনে করে যে মুসলিম সমাজে উলামাদের প্রয়োজন আছে কি না। তারা মনে করতে পারে যে, এসব আলিমরা সমাজের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ কেউ নয়। অধিকসংখ্যক উলামা ছাড়াও এই সমাজ চলে যাবে। কিছু কিছু লোক মনে করতে পারে যে, শিক্ষিত মুসলিমরা তো সরাসরি কুরআনের অনুবাদ বা হাদিস পড়েই দীনি নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে পারে। তারা মনে করতে পারে, তাদের কোনো আলিমের সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে না। এমন কিছু লোকও আছে যারা উলামাদের বড় কিছু মনে করে না। তারা মনে করে, উলামারা সুশিক্ষিত নয়। সফল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের তুলনায় তাদের জ্ঞান অতি নগণ্য। আমাদের দেশে শাহবাগিদের মধ্যে এরকম লোক অহরহ দেখা যায়। দেখা যায় ঢাবির বিভিন্ন প্রফেসরদের মধ্যে এই গুণ!
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে যেগুলো আমাদের দেখাবে যে, কেন মুসলিমদের জন্য ঐতিহাসিকভাবে উলামারা অপরিহার্য ছিলেন, তারা এখন অপরিহার্য আছেন এবং ভবিষ্যতেও থাকবেন। এই কারণগুলি দেখানো হবে কুরআন, সুন্নাহ (নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামের প্রদর্শিত পথ) এবং অতীতের ন্যায়বান আলিমদের বক্তব্য থেকে এসেছে। উলামায়ে কেরাম সর্বদাই মুসলমানদের পথপ্রদর্শনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং ভবিষ্যতেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। যাইহোক, বর্তমান যুগে যোগ্য আলিমদের খুঁজে পাওয়া চ্যালেঞ্জিং কাজ। এই চ্যালেঞ্জগুলি কীভাবে উত্থাপিত হয়েছিল তা বোঝা, সেগুলো মোকাবেলার দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায় হিসাবে এবং একটি সম্মিলিত মুসলিম সম্প্রদায় হিসাবে এই চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে উঠতে পদক্ষেপ নেওয়া গুরত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
আলিমরা নবিদের উত্তরসূরি
নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, উলামা বা ধর্মীয় পণ্ডিতরা নবিদের উত্তরাধিকারী বা উত্তরসূরী। এর অর্থ এই যে, একজন নবি ইনতিকালের পর দীনের জ্ঞান পৌছে দেওয়ার এবং মানুষকে পথ দেখানোর দায়িত্ব আলিমদের উপর বর্তায়। তারা আমাদের সমাজের নেতাদের মতো যারা ইসলামের শিক্ষা সঠিকভাবে প্রচারের দায়িত্ব বহন করে। তাদের দীনি দাওয়াতের কাজে দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাদের কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে গভীর ধারণা রয়েছে।
আজকের জটিল বিশ্বে আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের উপর অনেক বেশি নির্ভর করি। আমরা বিজ্ঞানীদের ওপর তাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের জন্য বিশ্বাস করি। আমরা আইনি বিশেষজ্ঞদের, উকিল ও ম্যাজিস্ট্রেটদের সম্মান করি যারা আমাদের সমাজকে পরিচালনা করতে সাহায্য করে। যাইহোক, ধর্মীয় জ্ঞানও এক প্রকার দক্ষতা। তবে এই বিষয়ে পক্ষপাতিত্বও রয়েছে। এই পক্ষপাত প্রায়ই ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে দেখা যায়।
যেহেতু কুরআন এক হাজার বছরেরও বেশি আগে আরবি ভাষায় অবতীর্ণ হয়েছিল, তাই এটা এমনিতেই বোঝা যায় যে, কুরআনের বার্তা সঠিকভাবে বোঝার জন্য আমাদের প্রাচীন আরবি ভাষায় বিশেষজ্ঞ আলিমদের প্রয়োজন। উপরন্তু, আরবিতে কুরআন ও সুন্নাহ নিয়ে ঐতিহাসিক জ্ঞান রয়েছে আলিমদের। অতএব, আমাদেরকে সুন্নাহর ওপর নিবেদিত বিশেষজ্ঞদের উপর নির্ভর করতে হবে। তারা আমাদেরকে গাইড করতে এবং আজকের বিশ্বে মুমিন-মুসলমান হিসেবে জীবনযাপন করতে সাহায্য করতে পারবেন ইনশাআল্লাহ।
নির্ভরযোগ্য আলিম খুঁজে পাওয়া
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে যে, কোনো জায়গায় সন্দেহ দেখা দিলে জ্ঞানীদের শরণাপন্ন হও।
وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ اِلَّا رِجَالًا نُّوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِمۡ فَسۡـَٔلُوۡۤا اَهۡلَ الذِّکۡرِ اِنۡ کُنۡتُمۡ لَا تَعۡلَمُوۡنَ ﴿ۙ۴۳﴾
আর আমি তোমার পূর্বে কেবল পুরুষদেরকেই রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি, যাদের প্রতি আমি ওহী পাঠিয়েছি। সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জানো। [সুরা নাহলঃ ১৬]
এখানে আহলি কিতাবদের আলেম সমাজ এবং আরো এমন সব লোক যারা নাম-করা আলেম না হলেও মোটামুটি আসমানী কিতাবসমূহের শিক্ষা এবং পূর্ববতী নবীগণের জীবন বৃত্তান্ত জানেন এমন মানুষদের বোঝানো হয়েছে। কুরআনের অন্য আয়াতেও এ নির্দেশটি ঘোষিত হয়েছে। যেমন, “আপনার আগে আমরা ওহীসহ পুরুষদেরকেই পাঠিয়েছিলাম; সুতরাং যদি তোমরা না জান তবে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর।” [সূরা আল-আম্বিয়া: ৭]
এখানে أَهْلَ الذِّكْرِ বা “জ্ঞানীদের” বলে তাওরাত ও ইঞ্জীলের যেসব আলেম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তাদেরকে বোঝানো হয়েছে। উদ্দেশ্য এই যে, যে ইহুদীরা ইসলাম বৈরিতার ক্ষেত্রে আজ তোমার সাথে গলা মিলিয়ে চলছে এবং তোমাদেরকে বিরোধিতা করার কায়দা কৌশল শেখাচ্ছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, মূসা ও বনী-ইসরাঈলের অন্যান্য নবীগণ কী ছিলেন? মানুষ ছিলেন, না ফেরেশতা ছিলেন? কেননা, তারা সবাই জানে যে পুর্ববর্তী সকল নবী মানুষই ছিলেন। এটা তো মূলত: তাদের জন্য রহমতস্বরূপ। কারণ, তাদের মধ্য থেকে পাঠানোর কারণেই তিনি তাদের কাছে বাণী পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন। আর মানুষও নবীদের থেকে রিসালাত ও হুকুম আহকাম গ্রহণ করতে পেরেছেন। [ইবন কাসীর]
এ আয়াত থেকে জানা গেল যে, শরীআতের বিধি -বিধান জানে না, এরূপ মুর্খ ব্যক্তিদের উপর আলেমদের অনুসরণ করা ওয়াজিব। তারা আলেমদের কাছে জিজ্ঞেস করে তদনুযায়ী আমল করবে।
তবে আমাদের মতো সাধারণ মুসলিমদের ওপরো বেশ কিছু কর্তব্য রয়েছে। আমাদেরকে প্রকৃত আলিম খুঁজে বের করতে হবে। কেউ নিজেকে আলিম বলে বা আলিম সার্টিফিকেট দেখালেই যে তিনি প্রকৃত আলিম হয়ে যাবেন তা কিন্তু কখনোই নয়। একজন আলিম প্রকৃত আলিম হলে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য আলিমও তার শুদ্ধতার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেবে।
সমাজে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, আমরা মানুষকে ইসলামের ব্যাপারে আন্তরিকভাবে অধ্যয়নের জন্য উৎসাহিত ও অনুপ্রাণীত করব। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ইসলাম শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এভাবেই উঠে আসবে যুগশ্রেষ্ঠ উলামাগণ, ইনশাআল্লাহ। শুধু মুসলিম পুরুষেরাই উলামা হবেন তা নয়, নারীদেরকেও হতে হবে ইলমের চাদরে আবৃত। তারা সমাজের সবচেয়ে মেধাবী ব্যক্তিবর্গ হবেন ইনশাআল্লাহ। তাহলেই আমরা এমন সব উলামা গড়ে তুলতে পারব যারা সমাজে ব্যাপকভাবে অবদান রাখতে পারবেন। সমাজে সামগ্রিকভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবেন।
ইসলামে শক্তিশালী করতে হলে, ইসলামকে ফিরিয়ে আনতে গেলে উলামারা হচ্ছেন অপরিহার্য অংশ। সমাজে তাদের অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ অবস্থানের ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এভাবে আমরা প্রত্যেকে সমাজে ইসলামের বিনির্মাণে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে পারব। অনেক দিন পরে মুসলিম সমাজ প্রকৃতপক্ষে পিছিয়ে আছে। এখন সময় হয়েছে সেই বয়ানকে পালটে দেওয়ার।