রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার আগামী মাসের শুনানিকে মিয়ানমারের সামরিক সরকার যাতে নিজেদের বৈধতার স্বার্থে ব্যবহার না করে, সে ব্যাপারে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিজে) নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, মিয়ানমারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের এক বছর পেরিয়ে গেলেও জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের সামরিক সরকার এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে ব্যর্থ হয়েছে।আইসিজেতে ২১ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার শুনানির আগে গণহত্যা এবং আইন বিশেষজ্ঞরা গত বৃহস্পতিবার এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় এই মন্তব্য করেছেন।তুরস্কের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা আনাদুলু গতকাল শুক্রবার জানিয়েছে, আলোচনার আয়োজন করে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মানবাধিকার সংগঠন ফোর্সেস অব রিনিউয়াল ফর সাউথ ইস্ট এশিয়া।
ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে গাম্বিয়া ২০১৯ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজেতে গণহত্যার মামলা করে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের আগস্টে জাতিগত নিধন শুরু হলে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রায় ১২ লাখ মানুষ প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গাম্বিয়া গণহত্যা সনদের আওতায় মিয়ানমারর বিরুদ্ধে আইসিজেতে ওই মামলাটি করেছিল। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মামলার বিষয়ে প্রাথমিক শুনানির পর ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের জন্য অন্তবর্তীকালীন আদেশ জারি করে।আইসিজেতে ওই মামলায় মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন দেশটির তখনকার স্টেট কাউন্সেলর অং সান সুচি। কিন্তু সামরিক শাসনের পর গ্রেপ্তার হয়ে একাধিক অভিযোগে তাঁর কারাদণ্ড হয়েছে। এখন সামরিক সরকারের প্রতিনিধিরা ওই মামলায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। মিয়ানমারের পক্ষে সামরিক সরকার আদালতে প্রতিনিধিত্ব করায় দেশটির সরকারকে স্বীকৃতির প্রসঙ্গটি এখন সামনে চলে এসেছে।
গত বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার আয়োজন করে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মানবাধিকার সংগঠন ফোর্সেস অব রিনিউয়াল ফর সাউথ ইস্ট এশিয়া। হেগভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন মাকউয়িগে ফাউন্ডেশনের আইনবিষয়ক পরামর্শক এরিন ফারেল রোজেনবার্গ বলেন, আইনসম্মতভাবে মিয়ানমারের প্রতিনিধিত্ব কে করবে, এটি নির্ধারণের এখতিয়ার আইসিজের নেই। মিয়ানমার গণহত্যা সনদের লঙ্ঘন করেছে কি না, সেটা দেখাই আইসিজের একমাত্র দায়িত্ব।তাঁর মতে, গণহত্যার মামলায় আইসিজে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেওয়ায় সামরিক জান্তা এখন এটিকে তাদের স্বীকৃতি হিসেবে কাজে লাগাতে চাইবে কি না, সে বিষয়টি উদ্বেগের। তাই সামরিক সরকারের আদালতে প্রতিনিধিত্ব যাতে তাদের স্বীকৃতির বিষয় হিসেবে বিবেচনায় না আনা হয়, সে বিষয়টিতে আইসিজের বিবেচনায় রাখতে হবে। এ জন্য জাতিসংঘের আদালতকে স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
অতীতের দৃষ্টান্ত গাম্বিয়ার জন্য উদ্বেগের
আইসিজেতে ক্রোয়েশিয়া এবং বসনিয়ার গণহত্যা মামলায় যে রায় দেওয়া হয়েছে, সেটিকে বিবেচনায় নিলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে গাম্বিয়ার উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে।এ প্রসঙ্গে গত বৃহস্পতিবারের আলোচনায় গণহত্যা বিশেষজ্ঞ ও নিউইয়র্কভিত্তিক সংগঠন জেনোসাইড ওয়াচের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গ্রেগারি স্টেনটন বলেন, অতীতের ওই দুই উদাহরণকে বিবেচনায় নিলে বলা যায় মামলার রায় গাম্বিয়ার বিপক্ষে চলে যেতে পারে। আইনের শাসনের নামে অদ্ভুতভাবে ওই দুই মামলা বলা হয়েছিল, একমাত্র গণহত্যা সনদের লঙ্ঘন ঘটেছে কি না, সেটিকে বিবেচনায় নিয়ে গণহত্যাকে আমলে নেওয়া হবে।গ্রেগারি স্টেনটন বলেন, এখন আইসিজে যদি মনে করে জাতিগত নিধনের নামে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুতি ঘটছে। তবে তাতে গণহত্যা সনদের লঙ্ঘন না–ও হতে পারে। এটি ঘটলে তা হবে গাম্বিয়ার জন্য চরম বিপর্যয়ের। তাঁর মতে, আইসিজে যেকোনো প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়ে রায় দিতে পারে। আবার মিয়ানমারকে শুনানিতে অংশগ্রহণের অনুমতি দিতে বাধ্য নয়।