নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সব স্তর নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, সেলিনা হায়াৎ আইভী মেয়র পদে তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়ে নিজের জনপ্রিয়তা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা দেখিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে তাঁকে ঘিরে দল সাজাতে পারলে দল শক্তিশালী হবে।দলীয় সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই নারায়ণগঞ্জে দল পুনর্গঠনের কাজ করতে চান আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা।
ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমানের নিয়ন্ত্রণে। ২০১১ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইভীর কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হওয়ার পর থেকে নারায়ণগঞ্জে ওসমান পরিবারের দাপট কমতে থাকে। তবে দলীয় কমিটিগুলোতে এখনো শামীম ওসমানের অনুসারীদের প্রাধান্য রয়েছে। তাই এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে শুরুতে আওয়ামী লীগের জেলা ও মহানগর কমিটি এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর তৎপরতা চোখে পড়েনি। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু নেতা আইভীর পক্ষে তৎপর ছিলেন। শেষের দিকে কেন্দ্রীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে শামীম ওসমানের অনুসারী নেতারা ‘লোকদেখানো’ কিছু তৎপরতা দেখান বলে সিটি নির্বাচন তদারককারী কেন্দ্রীয় নেতারা জানান। তবে আগের দুবারের মতো এবারও ওসমান পরিবার বা তাদের অনুসারীদের সহযোগিতা ছাড়াই আইভী বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। আইভীর এই বিজয়ে একদিকে তাঁর ব্যক্তি জনপ্রিয়তা ও সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে এটাকে নারায়ণগঞ্জে পেশিশক্তি বা দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতির পরাজয় হিসেবে দেখছে মানুষ।
এই পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের সব স্তরের কমিটি নতুন করে সাজানোর প্রয়োজন মনে করছেন দলটির নেতারা। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় নেতারা ১০-১৫ দিন নারায়ণগঞ্জে থেকে দলের ভঙ্গুর অবস্থার তথ্য দলীয় প্রধানকে অবহিত করেন। নারায়ণগঞ্জে কোনো সাংগঠনিক তৎপরতা কিংবা রাজনীতি নেই বলে তাঁরা মনে করেন। দলীয় প্রধানের সবুজ সংকেত পেয়ে ৯ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। ওই কমিটিতে শামীম ওসমানের ছেলে অয়ন ওসমানের প্রভাব বেশি। এরপর ১৩ জানুয়ারি জেলা ও মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সব কমিটি বিলুপ্ত করা হয়। ভোটের পর ১৭ জানুয়ারি শ্রমিক লীগের জেলা ও থানার সব কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এর মাধ্যমে দলকে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়েছে বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। যুবলীগ, মহিলা লীগ, যুব মহিলা লীগ, কৃষক লীগ, তাঁতী লীগসহ অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের কমিটিও ভেঙে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।
তবে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ সংগঠনের মূল কাঠামো। এই দুই কমিটি ভাঙার রেওয়াজ কম। তাই সম্মেলনের মাধ্যমেই এই দুই কমিটি পুনর্গঠন করা হবে বলে জানা গেছে।আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম বলেন, দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির পরবর্তী সভায় নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তারিখ চাওয়া হবে। তিনি বলেন, সেখানে দলীয় কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা আছে। তাই সংগঠন পুনর্গঠন করা সময়ের দাবি।
বর্তমানে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের মতো দলের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোও দুই ভাগে বিভক্ত। আইভী যেহেতু দলের খণ্ডিত শক্তি নিয়েই নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন, তাই তাঁকে প্রাধান্য দিয়ে দল সাজানোর পক্ষে দলের নীতিনির্ধারকেরা। এ ক্ষেত্রে আইভীকে মহানগর কিংবা জেলার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। তবে দলের কেউ কেউ বলছেন, আইভী গুরুত্বপূর্ণ একটি সিটি করপোরেশনের মেয়রের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। তাঁকে দলের বড় দায়িত্ব না দিয়ে নতুন কমিটিগুলো গঠনের ক্ষেত্রে আইভীর পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে নেতা নির্বাচন করা যেতে পারে।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, সংগঠনের কোনো ইউনিট কাজে সফল হতে না পারলে কিংবা দলকে এগিয়ে নেওয়ার মতো পারদর্শিতা না দেখাতে পারলে পরিবর্তন করা হয়। নারায়ণগঞ্জে মনে হয়েছে এই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা আছে। সেটা প্রক্রিয়া মেনে করা হবে।২০১৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের নারায়ণগঞ্জ মহানগর কমিটি এবং ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর জেলা কমিটি হয়। তিন বছর মেয়াদি কমিটির দুটিই মেয়াদ পেরিয়েছে অনেক আগে। আইভী প্রথমে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান, এরপর টানা তিনবার সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু দলের মহানগর কমিটিতে তাঁর স্থান হয়নি। ২০১৬ সালে জেলা কমিটিতে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতির পদ দেওয়া হয়।
শামীম ওসমান মহানগর আওয়ামী লীগের এক নম্বর সদস্য। বড় পদে না থাকলেও জেলা, মহানগর কমিটি এবং সহযোগী সংগঠনের বেশির ভাগ নেতা তাঁর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। ২০১৬ সালে মেয়র হওয়ার পর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল হাই এবং মহানগর সভাপতি আনোয়ার হোসেনকে পাশে পাচ্ছেন আইভী।আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অতীতে বিরূপ পরিস্থিতিতে শামীম ওসমানের দেশ ছেড়ে যাওয়ার নজির আছে। কিন্তু আইভী মাঠ ছাড়েননি। ভবিষ্যতে যেকোনো পরিস্থিতিতে মাঠ ধরে রাখতে আইভীকে দরকার। তাই তাঁকে ঘিরেই দল সাজানো উচিত বলে নেতাদের অনেকে মনে করেন।