কক্সবাজারের ২টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে ৩৩ বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগ। দলের প্রার্থীরা এখন একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিপরীতে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন না করালেও গোপনে বিশেষ কাউকে সমর্থন করার চেষ্টায় আছেন বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা।
২টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউপির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ২০ সেপ্টেম্বর। মেয়র, কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান ও সদস্য পদের জন্য ১০ সেপ্টেম্বর থেকে মাঠে নেমেছেন ১ হাজার ১৭৫ জন প্রার্থী। এর মধ্যে মেয়র ও ইউপি চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ৩৩ জন।
পৌরসভা দুটি হলো চকরিয়া ও মহেশখালী। আর ইউপি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে টেকনাফ, কুতুবদিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালী উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় দলীয় প্রার্থীর চেয়ে মেয়র ও চেয়ারম্যান পদে বিদ্রোহী প্রার্থীর অবস্থান ভালো। তাঁদের কাছে দলীয় প্রার্থীর পরাজয় হলে কেন্দ্রে জবাবদিহি নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। এ কারণে বিদ্রোহীদের প্রচারণা বন্ধ করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, কোন্দল কিংবা বিদ্রোহী প্রার্থীর কারণে দলীয় প্রার্থীর পরাজয় হোক তা তাঁরা চান না। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আছে কক্সবাজারের দিকে। দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের মাঠ থেকে সরে গিয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী (টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউপির আলমগীর চৌধুরী ও মহেশখালীর কুতুবজোমের নুরুল আমিন) সরে এসেছেন। বাকিরা সোমবার রাতের মধ্যে সরে না এলে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হবে।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দুই পৌরসভায় মেয়র পদে ৮ জন, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ২৫ ও সাধারণ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ৭৬ জন লড়ছেন। আর ১৪টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান পদে ৯২, সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে ১৯৯ ও সাধারণ ওয়ার্ডে ৭৭৫ জন প্রার্থী।
আওয়ামী লীগের ৩৩ বিদ্রোহী
চকরিয়া পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান মেয়র আলমগীর চৌধুরী। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। এখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন আওয়ামী লীগ দলীয় স্থানীয় সাংসদ জাফর আলমের ভাতিজা জিয়াবুল হক ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সাল উদ্দিন সিদ্দিকী।
মহেশখালী পৌরসভায় দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও বর্তমান মেয়র মকসুদ মিয়া। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও সাবেক মেয়র সরওয়ার আজম।
টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন শাহপরীর দ্বীপ সাংগঠনিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সোনা আলী। তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান নুর হোসেন। ২০১৬ সালে নির্বাচনেও দলীয় মনোনয়ন পেয়েছিলেন সোনা আলী। সেবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয় পান নুর হোসেন।
ইউনিয়নের মুন্ডারডেইল এলাকার ভোটার আবদুল করিম (৫৫) বলেন, গতবারের মতো এবারও দুই চেয়ারম্যান (সোনা আলী ও নুর হোসেন) প্রার্থীর সমর্থক ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। প্রচারণায় এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ইয়াবা ব্যবসায়ী, অশিক্ষিত, দুর্নীতিবাজ বলে গালমন্দ করছে।
দলের সিদ্ধান্ত না মেনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া প্রসঙ্গে নুর হোসেন বলেন, তৃণমূলের সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তাই তিনি এবারও চেয়ারম্যান পদে লড়ছেন। শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবেন।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন আবু সৈয়দ। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি ও বর্তমান চেয়ারম্যান শাহজাহান মিয়া। আবু সৈয়দ বলেন, শাহজাহানকে সরে যেতে বলেছেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। কিন্তু তিনি প্রচারণা বন্ধ করেননি।
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রতিটি ইউনিয়নে নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন একাধিক প্রার্থী। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও পেকুয়া উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের চিত্রও একই রকম। সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহী প্রার্থী মহেশখালীর মাতারবাড়ী ইউনিয়নে। এ ইউনিয়নে দলীয় প্রার্থী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আবু হায়দার। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে রয়েছেন ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ উল্লাহ, সাবেক চেয়ারম্যান এনামুল হক চৌধুরী, জেলা পরিষদ সদস্য রুহুল আমিনসহ কয়েকজন।
মাতারবাড়ী ইউনিয়নের ভোটার সিরাজুল ইসলাম বলেন, তাঁর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের সমর্থক বেশি। কিন্তু প্রার্থী হয়েছেন দলের তিনজন। সবাই প্রচারণার সময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও শেখ হাসিনার কথা বলছেন। এখন কাকে ভোট দেবেন তা বুঝতে পারছেন না বলে জানান সিরাজুল।
এদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, বেশির ভাগ বিদ্রোহী প্রার্থী বিএনপি-জামায়াতের ভোট টানতে মরিয়া। বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরাও নৌকা ঠেকাতে ভেতরে-ভেতরে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন। তবে জেলা বিএনপির সভাপতি শাহজাহান চৌধুরী বলেছেন, এই নির্বাচনে তাঁদের কোনো প্রার্থী নেই। দলের কেউ আওয়ামী লীগের নেতার পক্ষে কাজ করছেন, এমন অভিযোগ পেলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এর আগে করোনা পরিস্থিতির কারণে দুই দফায় এসব পৌরসভা ও ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত হয়। আগের দুই দফায় টেকনাফের সেন্ট মার্টিন ইউনিয়নে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। তবে এবার বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকার কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা এস এম শাহাদাত হোসেন বলেন, নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে সাগর শান্ত হলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।