চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে গতকাল শনিবার রাত ১১টায়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্তত চার বর্গকিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। আশপাশের বাড়িঘরের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। বিস্ফোরণের পর এখনো আগুন জ্বলছে। ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪১ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম হাসান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়ে অনেকে চলে গেছেন। ৭০ জন চিকিৎসাধীন। আর ৪ জন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ছয় কর্মী রয়েছেন বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।
ঘটনার পরপরই হতাহত ব্যক্তিদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা শুরু হয়। গত রাতে অ্যাম্বুলেন্স, গাড়ি ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে আহত ব্যক্তিদের সেখানে আনা হচ্ছিল। এদিকে হাসপাতালে মানুষ আহত ব্যক্তিদের রক্ত দিতে ভিড় করছেন। সেখানে চিকিৎসক ও নার্সদের জড়ো করা হয়েছে। হাসপাতালে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা ভিড় করছেন। স্বজনদের খোঁজ করছেন। তাঁদের কান্না ও আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
থেমে থেমে বিস্ফোরণ
বিএম কনটেইনার ডিপোতে গত রাতে আগুন লাগার পর সারা রাত থেমে থেমে বিস্ফোরণ হয়। আজ বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। বেলা ১টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রথম আলোর প্রতিবেদক জানান, আর শব্দ শোনা যাচ্ছে না। আগুন নেভানোর কাজ চলছিল। বিষাক্ত ধোয়ার কারণে আগুন লাগার মূল জায়গায় এখনো ফায়ার সার্ভিস ঢুকতে পারেনি।
আইএসপিআর জানায়, উদ্ধার অভিযানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৫০ জন সদস্য কাজ করছেন। উদ্ধার অভিযান ও আগুন নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনীর একটি বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ও নিরাপত্তা দলও নিয়োজিত রয়েছে। রাসায়নিক দ্রব্যাদির বিস্ফোরণের কারণে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রাসায়নিক সামগ্রী সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়া রোধে এ দল কাজ করছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর মিলিটারি পুলিশও সহায়তা করছে। তা ছাড়া বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিদের সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিম গতকাল রাত থেকে কাজ করছে। আহত ব্যক্তিদের চট্টগ্রাম মেডিকেল ও সিএমএইচে স্থানান্তরে সেনাবাহিনীর অ্যাম্বুলেন্স সহায়তা করছে । এ পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ১৪ জন সদস্যসহ চট্টগ্রাম সিএমএইচে ১৫ জন চিকিৎসাধীন।
বিপুল রাসায়নিক
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ‘হাইড্রোজেন পারক্সাইড’ নামের বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক রয়েছে। ফায়ার সার্ভিস ও ডিপোর কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
হাইড্রোজেন পারক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। এটি যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পারক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে।
বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় কেমিক্যালের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যসহ ঘটনাস্থলে আসা লোকজন চোখ খুলতে পারছেন না। বেশির ভাগ সদস্যের চোখ লাল হয়ে গেছে। কারও কারও চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তাঁদের।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ৪টি উপজেলা, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ২৩টি ইউনিটের ১৮৩ জন সদস্য কাজ করছেন।
বাসাবাড়ির টেলিভিশন-ফ্রিজ নষ্ট
বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগে। সেটা সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়িতে। এটি মূল শহরের বাইরে। তবে আশপাশে জনবসতি হয়েছে। বড় ভবন কম। নিম্ন আয়ের মানুষের বসবাস বেশি। অনেকের ঘরের জানালার কাচ, দরজা ভেঙে গেছে। বেশির ভাগ বাসার টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর ও বৈদ্যুতিক পাখা নষ্ট হয়ে গেছে।
ডিপোর আশপাশে টিনের ছাউনির ঘর বেশি। বেলা ১টা নাগাদ সেখানকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তাঁরা কালো ও বিষাক্ত ধোয়ার কারণে ঘরে টিকতে পারছেন না। অনেককেই মুখে কাপড় বেঁধে বসে থাকতে দেখা যায়।
আজ দুপুর পৌনে ১২টা পর্যন্ত ডিপোর মালিক বা কোনো কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে আসেননি। মালিকপক্ষের কেউ না থাকায় কনটেইনার ডিপোতে কী ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে, তা জানতে পারছে না ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল। ফায়ার সার্ভিস বলছে, এ কারণে তারা উদ্ধার তৎপরতায় বেকায়দায় পড়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, কনটেইনার ডিপোটির মালিকপক্ষের কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। এখানে কী ধরনের কেমিক্যাল আছে, তা বলা যাচ্ছে না। পানি দিয়ে সব কেমিক্যালের আগুন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লাগছে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে তিনজন ভর্তি আছেন; আরও দুজনকে আনা হচ্ছে।
আজ ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তাঁরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। কাল সোমবার সকালে তাঁর নেতৃত্বে একটি দল চট্টগ্রাম যাবে। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামে আপাতত কোনো লজিস্টিক সাপোর্ট প্রয়োজন হচ্ছে না। তবে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে।
প্রধানমন্ত্রীর শোক
বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে হতাহত হওয়ার ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী আজ এক শোকবার্তায় নিহত ব্যক্তিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। তিনি আহত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য নির্দেশনা দেন।
প্রধানমন্ত্রী দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানে সরকারের পাশাপাশি দলীয় নেতা–কর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
তদন্ত চান সংসদ সদস্য
সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম বলেছেন, ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কীভাবে রাসায়নিক ডিপো করা হয়েছে, তা তদন্ত করা উচিত।
আজ রোববার দুপুরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন করতে গিয়ে দিদারুল আলম এসব কথা বলেন।
আমদানি-রপ্তানি পণ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ২৪ বছর আগে চট্টগ্রামে কনটেইনার ডিপো শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। চট্টগ্রামে এ শিল্পের যাত্রা শুরুর পর এই প্রথম কোনো কনটেইনার ডিপোতে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটল।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান নুরুল কাইয়ূম খান আজ প্রথম আলোকে বলেন, এই শিল্পের যাত্রা শুরুর ২৪ বছরে এত বড় দুর্ঘটনা আগে ঘটেনি। এর আগে ডিপোতে ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেসব ক্ষেত্রে খুব দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছিল।