করোনা মহামারির দুই বছরে নানা শঙ্কার মধ্যেও ধীরে ধীরে দেশের রপ্তানি বেশ চাঙা হয়ে উঠছে। গত আট মাসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশ এগিয়েছে এই খাত। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ে বাড়ছে সরকারের উদ্বেগ। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ওপরে চলে গেছে। এতে নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে।

অপরদিকে যুদ্ধের কারণেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির অঙ্কের চাহিদা এক লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। চলতি বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ আছে ৪৬ হাজার ১২৪ কোটি টাকা। কিন্তু বিপুল অঙ্কের নতুন ভর্তুকি দেওয়া হলে বাজেটের আকার বেড়ে যাবে। পাশাপাশি অতিরিক্ত ভর্তুকির টাকা বাজারে চলে এলে আরেক দফা মূল্যস্ফীতি ঘটবে-এমন আশঙ্কা খোদ অর্থ বিভাগের। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ করছে অর্থ বিভাগ।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ভর্তুকি ও মূল্যস্ফীতি ব্যবস্থাপনা করাই এখন কঠিন চ্যালেঞ্জ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জ্বালানি তেল, গ্যাস ও সারসহ খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এতে ভর্তুকির অঙ্ক এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এত টাকা একসঙ্গে দেওয়া হলে নতুন করে বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতি হবে সেটি নিয়েও আমাদের চিন্তা করতে হচ্ছে।

জানতে চাইলে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক এম কে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্য বিশ্ববাজারে বেড়েছে। এর প্রভাবে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। ফলে আগামী দিনগুলোতে আরও মূল্যস্ফীতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন। এর নিয়ন্ত্রণ হাতে নেই। এটি বিশ্ব পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। এই মুহূর্তে নিম্নআয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমছে। তাদের ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে আগে জ্বালানি তেলের মূল্য এক দফা বৃদ্ধি পায়। মূল্য সমন্বয় করতে দেশের ভেতর এর মূল্য বাড়ানো হয়। এতে বড় ধরনের মূল্যস্ফীতি ঘটে। যে কারণে সরকারের বছরের শুরুতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাকে অতিক্রম করে মূল্যস্ফীতির হার। এমন পরিস্থিতিতে গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার সংশোধন করে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়। যদিও অর্থবছরের শুরুতে এ হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশের মধ্যে রাখার ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত ওই ঘোষণার মধ্যে রাখা যাচ্ছে না। সংশোধিত মূল্যস্ফীতির হার দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

সর্বশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশে। জানুয়ারি মাসে এ হার ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এছাড়া খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ, যা জানুয়ারিতে ছিল ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বুধবার সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেন, আশপাশে আমাদের যেসব দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ প্রতিটি দেশের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি মিলিয়ে দেখুন, সেখানেও মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে।

গত দুবছর করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে অর্থনীতি চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সেখান থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসার আগেই শুরু হয় রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ। এর প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ফলে এ খাতে ভর্তুকির অঙ্ক বাড়বে। এ ছাড়া বেড়েছে সার ও খাদ্যপণ্যের দামও। আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম বাড়লেও সরকার কৃষকের সারের মূল্য বৃদ্ধি করেনি। কৃষককে দেওয়া হচ্ছে ভর্তুকি মূল্যে সার।

ফলে বড় ধরনের ভর্তুকি এ খাতেও গুনতে হবে। এ ছাড়া রেমিট্যান্স প্রভাব ঠিক রাখতে সরকার নিজেই এ খাতে প্রণোদনা ২ শতাংশ থেকে ২.৫ শতাংশে উন্নীত করেছে। এখানে ভর্তুকি গুনতে হবে ৫ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ খাতেও ভর্তুকি বাড়বে। বর্তমানে এ খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ আছে। পাশাপাশি গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর প্রভাব বিদ্যুৎ খাতে পড়েছে। এ খাতেও আরও দুই হাজার কোটি টাকা বাড়ানোর হিসাব করছে অর্থ বিভাগ।

আর এলএনজি খাতে চলতি অর্থবছরে ছয় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজি গ্যাসের মূল্য অনেক বেড়েছে। ফলে এ খাতে ভর্তুকি বাড়বে এমনটি ধরে হিসাব চলছে। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড কর্মসূচিতে ৫শ কোটি টাকার ভর্তুকির প্রয়োজন হবে। এরই মধ্যে কৃষি ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে ৬০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ভর্তুকি চেয়ে পত্র পাঠিয়েছে। এর মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় ২৮ হাজার কোটি টাকা এবং জ্বালানি মন্ত্রণালয় ৩২ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে।

অর্থ বিভাগ মনে করছে অর্থবছরের শুরুতে বরাদ্দকৃত ভর্তুকি পুরোটাই দেওয়া হবে। নতুন করে আরও ৮ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে। বাকি অর্থ আগামী অর্থবছরের বাজেটে দেওয়া হবে। না হলে চলতি অর্থবছরে ভর্তুকির চাহিদা অনুযায়ী বিপুল অঙ্ক অর্থ দেওয়া হলে এ অর্থ বাজারে চলে আসবে। এতে মূল্যস্ফীতিকে আরেক দফা উসকে দিতে পারে।

এদিকে করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি খাত নিয়ে নানা শঙ্কা থাকলেও অনেকটাই চাঙা আছে রপ্তানি খাত। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাবে গত ফেব্রুয়ারিতে আয় বেড়েছে ৩৪ শতাংশ। এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪২৯ কোটি ৪৫ লাখ ডলার। আগের বছরের ফেব্রুয়ারিতে যা ৩১৯ কোটি ডলার ছিল। চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে ৩৩৮৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। সেই হিসাবে আট মাসের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এগিয়ে আছে রপ্তানি খাত। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসে রপ্তানি হয়েছিল ২৫৮৬ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য।

বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মো. হাতেম জানান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা বেশ আতঙ্কের মধ্যে আছেন। আমাদের যে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ শতাংশ, এটি আরও বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু বিশ্ববাজারে কাঁচামালের মূল্য ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক প্রবৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, চীন বিদ্যুৎ উৎপাদন করে কয়লা দিয়ে। সম্প্রতি কয়লা নিয়ে চীনে সমস্যা হচ্ছে। এজন্য তাদের বিদ্যুৎ নিয়ে জটিলতায় পড়ছে মিলগুলো। সেখান থেকে নতুন বায়ার বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অনেকে এ দেশে এসে অর্ডার দিচ্ছে। যারা আগে কখনো বাংলাদেশে আসেনি। এজন্য আমাদের অর্ডারও বাড়ছে।

সরকারের পদক্ষেপ : কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য গত ২৫ মার্চ ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার ঘোষিত এই বিশেষ ঋণ সুবিধা ব্যবহার করে শ্রমিকদের এপ্রিল, মে ও জুনের মজুরি পরিশোধ করেছেন সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা। পরে এই ঋণ সুবিধা ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় ছিল ১৮ মাস।

কিন্তু পোশাক রপ্তানি খাত উদ্যোক্তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঋণের কিস্তি পরিশোধের মেয়াদ আরও পেছানো হয়। এছাড়া বড় শিল্পঋণসহ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য ১ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দেওয়া হয়। সরকারের সময়োপযোগী এসব পদক্ষেপের কারণেই মূলত রপ্তানি বাজার ধীরে ধীরে চাঙা হয়ে উঠছে-এমনটি মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

Share.

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Leave A Reply

mostplay app

4rabet app

leonbet app

pin up casino

mostbet app

Exit mobile version