পেগাসাস-কাণ্ডে উত্তাল ভারতীয় রাজনীতি। গত লোকসভা ভোটের আগে বিরোধী নেতা, মন্ত্রী, সাংবাদিক, আইনজীবীদের ওপর নজরদারি চালানোর অভিযোগ উঠেছে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিরুদ্ধে।
রাহুল গান্ধী, প্রশান্ত কিশোর বা পিকে, তৃণমূল নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ প্যাটেল ও তার স্ত্রী এবং অশ্বিনী বৈষ্ণবের ফোনেও পেগাসাস দিয়ে আড়িপাতার অভিযোগ উঠেছে। তৃণমূলের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোনেও আড়িপাতা হয়।
ইসরায়েলি সংস্থার স্পাইওয়্যার পেগাসাস দিয়ে যে ১৭টি সংবাদমাধ্যমে আড়ি পাতা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম ভারতীয় সংবাদসংস্থা দ্য ওয়্যার।
দ্য ওয়্যার জানিয়েছে, ভারতে পেগাসাস ব্যবহার করে আড়িপাতার জন্য তিনশ ফোন নম্বরের একটি ভেরিফায়েড তালিকা আছে। তাতে রাহুল গান্ধীর দুইটি ফোন নম্বর আছে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত তাতে আড়িপাতা হয়েছিল। তাছাড়া রাহুলের ঘনিষ্ঠ অলঙ্কার সওয়াই ও সচিন রাওয়ের ফোনেও আড়িপাতা হয়।
২০১৯ সালের জুলাইয়ে যখন কর্ণাটকের বিরোধীদলীয় সরকারের পতন ঘটানো হয়, সেসময় রাজ্যটির উপ মুখ্যমন্ত্রী জি পরমেশ্বর এবং মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারাস্বামী ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার ব্যক্তিগত সচিবদের টেলিফোন পেগাসাসের লক্ষ্য হয়।
ইসরায়েলের এনএসও গ্রুপের ভারতীয় ক্রেতাদের রেকর্ড থেকে এমনটাই জানায় দ্যা ওয়্যার। সম্প্রতি ফরাসী অলাভজনক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ফরবিডেন স্টোরিজের নেতৃত্বে, পেগাসাস প্রজেক্ট নামের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামের তদন্তে যে তথ্য ফাঁস হয়, তাতেই প্রকাশিত হয়েছে এসব। ভারতে কারো স্মার্ট ফোন হ্যাক করা আইনত দণ্ডনীয়। আর ইসরাইএর সংস্থা এনএসও তাদের পেগাসাস স্পাইওয়্যারের মাধ্যমে ঠিক এই কাজটিই করে। তবে তারা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য শুধু মাত্র কোনো দেশের সরকারের কাছেই সরবরাহ করে, অন্য কারো কাছে নয়। ভারত তাদের গ্রাহক, এমন দাবি সরাসরি অস্বীকার করেনি এনএসও কিংবা মোদি সরকার কেউই।
প্রশান্ত কিশোরের (পিকে) ফোন পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানে পেগাসাস ব্যবহার করা হয়েছে। লোকসভা ভোটের আগে তার ফোন হ্যাক করা হয়। তারপর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে এবং সম্প্রতি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সময়েও তার ফোন হ্যাক হয়।
পিকে বলেছেন, তিনি ওই সময়ের মধ্যে পাঁচবার ফোন বদল করেছেন। তারপরেও তার ফোন হ্যাক করা হয়েছে।
কংগ্রেসের অভিযোগ, বিজেপি আসলে ভারতীয় জনতা পার্টি নয়, ভারতীয় জাসুস পার্টি। জাসুস মানে গুপ্তচর। তৃণমূলের দাবি, মমতা যখন পিকে, সুব্রত বক্সী, অভিষেকের সঙ্গে মিটিং করেছেন, তার যাবতীয় খবর বিজেপি-র কাছে চলে গেছে। অথচ, তারা কেউ মোবাইল ব্যবহার করেননি। তৃণমূলের দাবি, পেগাসাস ব্যবহার করে সেই বৈঠকের তথ্য হাতড়ে নেয় তারা।
সোমবার থেকেই সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছে। অধিবেশনের প্রথম দিনেই ফোনে আড়িপাতা নিয়ে বিরোধীরা সোচ্চার হয়েছে। তাদের চেঁচামিচিতে লোকসভা ও রাজ্যসভা একবার মুলতুবি হয়ে যায়। মঙ্গলবারও লোকসভায় মুলতুবি প্রস্তাব এনেছে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস। তার মানে সব কাজ মুলতুবি করে ফোনে আড়িপাতা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। রাজ্যসভাতেও বিরোধীরা একই প্রস্তাব এনেছে। সেখানে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী আড়িপাতা নিয়ে সরকারি বিবৃতি দেবেন।
তবে বিজেপি-র দাবি, পেগাসাস ব্যবহার করে আড়িপাতার অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। সাবেক তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ সাংবাদিক সম্মলেন করে বলেছেন, “সরকার বা বিজেপির বিরুদ্ধে আড়িপাতার কোনো প্রমাণ নেই। আর অ্যামনেস্টির মতো সংগঠনের ভারত-বিরোধী মনোভাব ও ভূমিকা সকলেই জানেন।”
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, “পেগাসাস নিয়ে মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। মুকুল রায় বিজেপি-তে আসার পর তার ফোনে আড়িপাতার অভিযোগ করে মামলা করেছিলেন। এখন তৃণমূল নেতাদের মুখে অন্য কারো বিরুদ্ধে এই অভিযোগ মানায় না।”
‘দ্য ওয়্যার’ জানায়, ভারতে ৪০ জনের বেশি সাংবাদিকের ফোনে স্পাইওয়্যার পেগাসাস ব্যবহার করে আড়ি পাতা হয়েছে। মোট ১০ জন ভারতীয় সাংবাদিকের ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়। যার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে দ্য ওয়্যার।