১৬ বছর কেটে গেছে। কিন্তু ছেলে হারানোর শোক এতটুকু কমেনি ওসমান আলীর। ২০০৬ সালের ৪ জানুয়ারি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনকারীদের মিছিলে পুলিশ প্রথম গুলি চালিয়েছিল। সেদিন ওসমান আলীর ছেলে কাজলসহ মারা যান দুজন। সন্তানহারা এই বাবা বললেন, ‘ছেলেটারে ভুলতে পারি না।’

২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষের দিকে বিদ্যুৎ না পেয়ে কানসাট এলাকার পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরা পল্লী বিদ্যুতের মিটার ভাড়া ও ন্যূনতম চার্জ প্রত্যাহারসহ পাঁচ দফা দাবিতে আন্দোলনের শুরু করেছিলেন। পাঁচ মাসব্যাপী পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে হওয়া আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান ১৭ জন। আহত হন অন্তত ৬০০ মানুষ।গোলাম রব্বানী ছিলেন এই পরিষদের আহ্বায়ক। বিদ্যুতের দাবিতে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচিত এ ঘটনা ‘কানসাট আন্দোলন’ নামে পরিচিত।হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলো কেমন আছে, তা জানতে গত ৫ মার্চ কানসাটে গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। কথা বলেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সঙ্গে। বাবাহারা, সন্তানহারা ব্যক্তিদের দিন কাটছে কষ্টে। ভালো নেই আহত ব্যক্তিরাও।

‘আনোয়ারের রক্তমাখা শার্ট’
১১ বছরের আনোয়ার পড়ত পঞ্চম শ্রেণিতে। বাড়ি শিবনগর জায়গিরপাড়া গ্রামে। কানসাট আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা যায় সে। তার মৃত্যুর পর ‘কিশোর আনোয়ারের রক্তমাখা শার্ট’ শিরোনামে প্রতিক্রিয়া লিখেছিলেন লেখক ও শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি লেখেন, ‘যে বুলেটটি আনোয়ারের বক্ষ বিদীর্ণ করে গেছে, সেই বুলেটের তৈরি ফুটোটা শার্টের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। হতভাগিনী মা তাঁর বাকি জীবন এই শার্টটা বুকে চেপে রাখবেন, অবিশ্বাস্য আতঙ্কে বুলেটের তৈরি ছোট ফুটোটার দিকে তাকিয়ে থাকবেন।’

মুহম্মদ জাফর ইকবালের কথা সত্য হয়েছে। মা মনোয়ারা ছেলের শার্টটি সযত্নে রেখেছেন। তিনি লাল-কালো চেকের শার্টটি হাতে নিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘ছেলেটাকে সব সময় মনে পড়ে। জামাটা মাঝে মাঝে দেখি। বুকে জড়িয়ে রাখি।’আনোয়ারের বাবা মইনুল ইসলাম আগে কাঠের ব্যবসা করতেন। শারীরিক অসুস্থতায় ব্যবসা বন্ধ। ধারদেনা করে চলছে সংসার। বললেন, তাঁর ছেলে মারা যাওয়ার পর শুধু সরকারি দুই লাখ টাকা পেয়েছেন।

নয়নের মায়ের কান্না থামেনি
নাম চঞ্চলা কর্মকার। তবে এলাকায় তিনি পরিচিত ‘নয়নের মা’ নামে। উচ্চমাধ্যমিকে পড়া নয়ন মারা গেছে কানসাট আন্দোলনে। ছেলে হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে চঞ্চলা কর্মকারও হয়ে উঠেছিলেন সাহসী নেত্রী।২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল ১৪ দলের নেতারা কানসাটে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে যান। ওই দিন সমাবেশে নেতাদের সঙ্গে চঞ্চলা কর্মকারও বক্তব্য দেন। তিনি বললেন, সমাবেশ থেকে নেতারা তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাঁরা কেমন আছেন, কেউ জানতে চায় না। ছেলে হারানোর কষ্ট এখনো তাঁকে কুরে কুরে খায় বলে জানালেন এই মা।

পরিবারে খুব কষ্ট
কানসাট আন্দোলনে নিহত দিনমজুর আবদুল মান্নানের মেয়ে শহীদা। বাবার মৃত্যুর দুই মাস পর তার জন্ম। শহীদা এখন ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। আবদুল মান্নানের স্ত্রী কবিরন বেগমও কানসাট আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। কবিরন মারা গেছেন দেড় বছর আগে।শহীদার বড় ভাই আবদুল হাকিম রাজমিস্ত্রি। মেজ ভাই আবু সাঈম ঝালাইয়ের কাজ করেন। অন্য দুই ভাই জাহেদুল ও মোসাব্বির এতিমখানায় থেকে পড়াশোনা করে। শহীদার ভাবি তাওহীদা বলেন, ‘পরিবারে খুব কষ্ট।’ তাঁদের কেউ খোঁজ নেয় না বলে জানান তিনি।

আহতরাও ভালো নেই
২০০৬ সালের ৪ জানুয়ারি পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট লাগে কানসাটের রাঘবপুর উত্তরপাড়ার বাসিন্দা গোলাম মোস্তফার (৬৪) দুই চোখে। তিনবার অস্ত্রোপচার করেও বাঁ চোখের দৃষ্টিশক্তি ফেরেনি। ডান চোখে মাত্র ২০ শতাংশ দেখতে পান।গোলাম মোস্তফা বললেন, সে সময় এক লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। কিন্তু চিকিৎসা করাতে গিয়ে তাঁকে ছয়-সাত বিঘা জমি বিক্রি করতে হয়েছে।কানসাট আন্দোলনে এক চোখ হারান মো. শাহীন। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে টানাটানির সংসার। রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য নজরুল ইসলাম বললেন, ‘শাহীনের আর্থিক অবস্থা বলতে কিছু নেই। সকালে কাজে গেলে বাজার হয়, না গেলে হয় না।’

পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো উচিত
কানসাট আন্দোলনের নেতা–কর্মী ও নিহত-আহত পরিবারগুলোর বেশি ক্ষোভ গোলাম রব্বানীর ওপর। তাঁদের ভাষ্য, গোলাম রব্বানী কানসাট আন্দোলনের মাধ্যমে পরিচিতি পান। ২০১৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে সাংসদ হওয়ার পর বদলে যান। হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াননি।পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন জহির হাসান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কানসাট আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি পূরণ না হওয়া লজ্জাজনক। এর দায় গোলাম রব্বানীরও।’

গত ৫ মার্চ রাতে কানসাটের পুকুরিয়া গ্রামে নিজের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে গোলাম রব্বানী কাছে দাবি করেন, আওয়ামী লীগে তাঁকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে দলের ভেতরে বিভিন্ন মহল তৎপর ছিল। সে জন্য কিছু করতে পারেননি। স্বজনহারা পরিবারগুলোর অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লক্ষ মানুষের অংশগ্রহণে গণ–আন্দোলন হয়েছে। চাওয়া-পাওয়া হিসাব করলে ওই পরিবারগুলো কষ্ট পেতে পারে।

কানসাট আন্দোলন নিয়ে গণতদন্ত কমিটি করেছিল তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। এ কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের লেখক জাহাঙ্গীর সেলিম। তিনি বলেন, তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ কানসাট আন্দোলনকারীদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করছিল। বিলম্বে হলেও বর্তমান সরকারকে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানো উচিত।

Share.

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Leave A Reply

mostplay app

4rabet app

leonbet app

pin up casino

mostbet app

Exit mobile version