অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতিকে মূলধারায় নিয়ে আসতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার প্রতিশ্রুতি রক্ষার বড় শর্ত পূরণ করলেন কালো টাকা সাদা করার অবারিত সুযোগ রেখে। তবে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় গতবারের চেয়ে এবার কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করেছেন তিনি। বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখে গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে অর্থবিল ২০২১ পাস করা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন শিল্পে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা অব্যাহত রাখা হয়েছে।

কিন্তু তালিকাভুক্ত শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটসহ পুঁজিবাজারের বিভিন্ন ইনস্ট্রুমেন্টে কালো টাকা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ কর এবং মোট করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা গুনতে হবে। এর আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, অপ্রদর্শিত অর্থ মূলধারায় ফিরিয়ে আনার সুযোগ আগামীতেও থাকবে। যতদিন অর্থনীতিতে অপ্রদর্শিত অর্থ থাকবে, ততদিন এ সুযোগ দেওয়া হবে। আশা করা যায় এক সময় অপ্রদর্শিত টাকা অর্থনীতির সিস্টেম থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কালো টাকা সাদা করার অবারিত সুযোগ থাকা উচিত নয়। তারপর বিনিয়োগে সুযোগ দিলে বিশেষ বিশেষ শিল্পে দেওয়া উচিত। নইলে আদৌ কালো টাকা শিল্পে বিনিয়োগ হবে কিনা কেউ বলতে পারবে না।

গত ৩ জুন সংসদে প্রস্তাবিত অর্থবিলে জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বৈধ করার বিশেষ সুযোগ দেওয়ার সংশোধনী আনা হয় গতকাল মঙ্গলবার। পরে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে তা আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য এই বিল পাস হয়। এ বিল পাসের সময় সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। আজ ৩০ জুন জাতীয় সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট পাস হওয়ার কথা রয়েছে। গত ৩ জুন কালো টাকা সাদা করার প্রচলিত নিয়মের বাইরেও বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে জরিমানা ও শর্ত বাড়িয়ে প্রশ্ন ছাড়া বিশেষ সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। পাস হওয়া অর্থবিলে আগামী অর্থবছরে পুঁজিবাজারে প্রশ্নাতীতভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে।

অবশ্য এর আগে ৩ জুন প্রস্তাবিত বাজেটে পুঁজিবাজারসহ বেশ কয়েকটি খাতে কালো টাকা বিনা প্রশ্নে সাদা করার অবাধ সুযোগ অব্যাহত রাখার বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। প্রস্তাবিত অর্থবিলেও তখন এই বিষয়ে কিছু উল্লেখ না থাকলে কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ শেষ হচ্ছে বলে আলোচনা তৈরি হয়। তবে বাজেট প্রস্তাবের পরদিন সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এই বিষয়ে আলোচনার সুযোগ রেখে তা বহাল রাখার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগেও তিনি এক অনলাইন ব্রিফিংয়ে কালো টাকার ব্যাপারে অর্থবিল পাস হওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করার কথা বলেছিলেন।

পাস হওয়া অর্থবিল অনুযায়ী তালিকাভুক্ত শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটসহ পুঁজিবাজারের বিভিন্ন ইনস্ট্রুমেন্টে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ কর এবং মোট করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা গুনতে হবে। অন্যদিকে ২৫ শতাংশ কর এবং করের ওপর ৫ শতাংশ জরিমানা দিয়ে নগদ টাকা, ব্যাংক ডিপোজিট, ফিনান্সিয়াল স্কিম ও ইনস্ট্রুমেন্ট, সব ধরনের ডিপোজিট ও সেভিংস ডিপোজিট, সেভিং ইনস্ট্রুমেন্ট অথবা সেভিং সার্টিফিকেট (সঞ্চয়পত্র) বৈধ প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা যাবে বলে অনুমোদিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া জায়গা অনুপাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর ও জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত জমি, ভবন, অ্যাপার্টমেন্ট প্রশ্নাতীতভাবে বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে অর্থবিলে। পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের ন্যায় ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা নতুন শিল্পায়নে বিনিয়োগ করা যাবে ।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, কালো টাকা অবারিত সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে নই। এটা যদি দিতেই হয়, তাহলে আয়ের উৎস জানানোর শর্ত দেওয়া উচিত। সবক্ষেত্রে সমান জরিমানা ধার্য করা দরকার। নতুন শিল্পে বিনিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, বিনিয়োগের সঙ্গে আরও কিছু জড়িত থাকে। বিনিয়োগ নাও বাড়তে পারে।

তবে শিল্পায়নে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট খাত উল্লেখ করার পক্ষে মত দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, কালো টাকা শর্তহীন সুযোগ দিলেই শিল্পে বিনিয়োগ বাড়বে এটা বলা মুশকিল। এর আগেও বিনিয়োগে তেমন সুফল আসেনি। তারপরও বিনিয়োগ বাড়াতে এসএমই শিল্প, কটেজ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো খাতগুলোকে উল্লেখ করে সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। শিল্প বলতে অনেক কিছু বুঝায়। দেখা যাবে নানা ধরনের শিল্পে সামান্য কালো টাকা বিনিয়োগ করে বড় অঙ্কের ব্যাংকঋণ বের করে নেবে। এ জন্য ঢালাওভাবে দেওয়া উচিত নয়।

সংসদে নিজের দেওয়া বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘গত ১২ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। এই সময়ে আমাদের মাথাপিছু আয় ৬৮৬ ডলার থেকে তিন গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ ডলারে। জিডিপির আকার ৯১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে প্রায় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৫ বিলিয়ন ডলারে। রপ্তানির পরিমাণ ১৪ দশমিক ১ বিলিয়ন থেকে প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৬ দশমিক ১ বিলিয়ন হতে সাড়ে সাত গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৪৬ বিলিয়ন ডলার ছুঁইছুঁই করছে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, এত অল্প সময়ে এত বেশি পরিমাণ রিজার্ভ নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক রেকর্ড। তারপর প্রবাসী আয় ৭ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার থেকে সাড়ে তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁইছুঁই করছে। মাত্র এক বছরে প্রবাসী আয় খাতে ২৫ বিলিয়ন ডলার অর্জন নিঃসন্দেহে আরও একটি অনন্য ঐতিহাসিক রেকর্ড।

মুস্তফা কামাল জানান, সারা বিশ্বই করোনার কারণে ঘাটতি বাজেট প্রণয়নের পথ বেছে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এ বছর বাজেট ঘাটতি নির্ধারণ করেছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ সারা বিশ্বে অর্থনীতিতে ঘাটতি বাজেটের হার ৪১ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। তিনি আরও বলেন, ‘সারা বিশ্বের অর্থনীতি পাল্টে গেছে, লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। বিশ্বে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন এমন করুণ, সে অবস্থায়ও বাংলাদেশের অর্থনীতি ততটা খারাপ হয়নি। পাকিস্তানও বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রশংসা করছে। আমরা যেতে চাই বহুদূর।’

উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে ১৪ হাজার ৪৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ সাদা করা হয়েছে। এর মধ্যে আবাসনে ২ হাজার ৫১৩ কোটি ২০ লাখ টাকা, শেয়ারবাজারে ২৮২ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং ব্যাংক সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য খাতে ১১ হাজার ৬৬৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা অপ্রদর্শিত অর্থ আয় কর রিটার্নে দেখানো হয়েছে। এ সুযোগ নিয়েছে মোট ১০ হাজার ৪০৪ জন করদাতা। ২০০৫-০৬ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত এমন সুযোগ নিয়ে ১৪ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা বৈধ করা হয়।

অর্থবিলে অন্যান্য সংশোধনী : পাস হওয়া অর্থবিলে আরও কিছু সংশোধনী আনা হয়েছে । অর্থবিলে শিল্পের কাঁচামাল ক্রয়ে ক্রসচেকে লেনদেনের শর্ত শিথিল করে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য অর্থবিল পাস করেছে সংসদ। বাজেট ঘোষণার পর মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদানকারী (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথকভাবে করপোরেট কর কমানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আবেদন করে। এনবিআর প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে এ খাতে করপোরেট কর কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিং সেবার করপোরেট কর প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ করা হয়। এটি কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এদিকে হোটেল রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৭ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৫ শতাংশ করার প্রস্তাবও অনুমোদন করা হয়েছে।

নতুন অর্থবিলে নতুন এসব সুযোগের পাশাপাশি আগের ঘোষণা অনুযায়ী হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এবং জমি ও ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে এমন সুযোগ থাকছে। সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মোবাইল ব্যাংকিং সেবার করপোরেট কর প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে ৩৭ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশ করা হয়। এটি কমিয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।

এবারের অর্থবিলে কর্মীদের বেতন পরিশোধে নতুন নিয়ম আনা হয়েছে। বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশে কর্মীদের বেতনভাতা ও সম্মানীর পরিমাণ ১৫ হাজার টাকার বেশি হলে তা ক্রসচেক বা ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে করার বিধান রয়েছে। তা না হলে এই খাতে ব্যয় করা অর্থ আয় হিসেবে দেখানো হয় না। আর আয় হিসেবে গণ্য করলে তা করযোগ্য হয়ে যায়। সংশোধিত অর্থবিলে এই সীমা ১৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে।

বিনিয়োগ সহজ এবং উৎসাহী করতে শিল্পের কাঁচামাল কেনার ক্ষেত্রে ক্রসচেকের শর্ত শিথিল করা হয়েছে। বর্তমানে ৫০ হাজার টাকার বেশি কাঁচামাল কিনলে সে ক্ষেত্রে চেকে লেনদেনের বিধান চালু আছে। এটি বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হয়েছে। এখন থেকে পাঁচ লাখ টাকার কম টাকার কাঁচামাল কিনলে চেকে লেনদেনের বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এতে শিল্প উদ্যোক্তারা কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবেন।

এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রণীত বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তব্য রাখেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ সময় অর্থবিলের ওপর কয়েকজন সদস্যের আনা কয়েকটি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। বাকিগুলো কণ্ঠভোটে বাতিল হয়ে যায়। পরে তিনি অর্থবিল পাসের অনুরোধ জানালে স্পিকার তা ভোটে দেন। উপস্থিত সদস্যদের কণ্ঠভোটে পাস হয় অর্থবিল।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে সীমিত সংখ্যক আইনপ্রণেতাকে নিয়ে জাতীয় সংসদে গত ৩ জুন বসে বাজেট অধিবেশন; অধিবেশন কক্ষে সংসদ সদস্যদের বসতে হয়েছে দূরত্ব রেখে, মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে অধিবেশনে অংশ নেন সংসদ সদস্যরা।

Share.

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Leave A Reply

mostplay app

4rabet app

leonbet app

pin up casino

mostbet app

Exit mobile version