দেশে করোনা সংক্রমণের পর এখন সবচেয়ে বিপর্যস্ত অবস্থা চলছে। গত ১৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছিল চলতি বছরের এপ্রিল ও জুনে। কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এ সময়ে মৃত্যু ও রোগী শনাক্তে একের পর রেকর্ড হয়েছে। মাত্র ১৪ দিনেই গত এপ্রিলের দ্বিগুণ ও জুনের তিনগুণ বেশি রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছে।

এমনকি গত ১৪-২০ জুন এক সপ্তাহের নমুনা পরীক্ষা ও রোগী শনাক্তের হার বিশ্লেষণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৪০টিই সংক্রমণের অতি উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। এর বাইরে আরও ১৫টি জেলা আছে সংক্রমণের উচ্চঝুঁকিতে। সংক্রমণের মধ্যমঝুঁকিতে আছে আটটি জেলা।

এর দুই সপ্তাহ পর (অর্থাৎ গত জুনের শেষ সপ্তাহ ও এ মাসের প্রথম সপ্তাহ) সংক্রমণ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সে সময় বেশি বিপজ্জনক অবস্থা দেখা দেয় ৫৭ জেলায়, যেখানে পরীক্ষা অনুপাতে রোগী শনাক্তের হার ছিল ৫৮-২১ শতাংশের মধ্যে। অতি উচ্চসংক্রমণে ছিল অবশিষ্ট সাত জেলা, যেখানে সংক্রমণ হার ছিল ২০-১৩ শতাংশের মধ্যে।

এরপর গত দুই সপ্তাহ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত দুদিন ধরে ১২ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। তার আগের দিন ১২ জুলাই এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ১৩ হাজার ৭৬৮ রোগী শনাক্ত হয়েছে। এছাড়া পাঁচ দিন ১১ হাজারের বেশি, এক দিন ৯ হাজারের বেশি এবং চার দিন আট হাজারের বেশি রোগী পাওয়া গেছে।

একইভাবে গত দুই সপ্তাহ ধরে মৃত্যুও বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। গত চার দিন ধরে দৈনিক গড়ে ২১৬ জন মারা যাচ্ছে। এর আগে প্রথম সর্বোচ্চ মৃত্যু হয় গত ২৭ জুন, ১১৯ জন এবং সেদিনই প্রথম মৃত্যু একশর ওপরে উঠে। এরপর গত ১৮ দিনে দৈনিক মৃত্যু একশর নিচে নামেনি, বরং গত ৭ জুলাই প্রথম দুইশোর ঘরে ওঠে ও সেদিন ২০১ জনের মৃত্যুর সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়। এরপর গত চার দিন ধরে দৈনিক দুইশোর বেশি মানুষ করোনায় মারা যাচ্ছে। এমনকি গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে দৈনিক নতুন মৃত্যু ও রোগী শনাক্তে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকার মধ্যে বাংলাদেশ অবস্থান করছে।

দেশে করোনা সংক্রমণের এমন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যেই গতকাল বুধবার মধ্যরাত থেকে আগামী ২৩ জুলাই সকাল ৬টা পর্যন্ত অর্থাৎ আট দিনের জন্য সব বিধিনিষেধ শিথিল করল সরকার। ঈদুল আজহা উদযাপন উপলক্ষে সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব ধরনের গণপরিবহন এবং শপিং মলসহ দোকানপাট খোলা থাকবে। তবে আসনসংখ্যার অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলতে হবে গণপরিবহনকে। কোরবানির হাটও বসবে। খোলা মাঠে ঈদের জামাত হবে।

‘লকডাউন’ শিথিলের খবরে গতকাল থেকেই রাজধানীসহ সারা দেশে মানুষের মেলামেশা বেড়েছে। বিভিন্ন রিকশা ও প্রাইভেট যানবাহনের সংখ্যাও বেড়েছে। বিভিন্ন বাস টার্মিনালে গতকাল থেকেই মানুষ ঈদের অগ্রিম টিকিটের জন্য ভিড় করতে শুরু করেছে। অনলাইনে চাপ বেড়েছে ট্রেনের টিকিটের জন্য। মানুষ ব্যক্তিগত যানে বাড়ি যাওয়ার জন্য বিভিন্ন রেন্ট-এ-কার কেন্দ্রগুলোতে যোগাযোগ করতে শুরু করেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, প্রত্যেক ঈদের মতো এবারও স্বাস্থ্যবিধি ভেঙে মানুষ ঈদযাত্রায় অংশ নেবে।

‘লকডাউন’ শিথিলে সরকারের এ সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও করোনা মোকাবিলায় গঠিত সরকারের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। তাদের মতে, এতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া ও পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

‘লকডাউন’ শিথিলের ঘোষণার কথা শুনে গত সোমবার জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা মনে করি যে এতে সংক্রমণ ঝুঁকিটা অনেক বাড়বে। এমনিতেই যতটুকু লকডাউন আছে, তার মধ্যেও সংক্রমণ বাড়ছে। আর যদি সব খুলে দেওয়া হয়, তাতে মানুষের যে পরিমাণ মেলামেশা হবে, সেই মেলামেশার সময় সংক্রমণ মানুষের মধ্যে এতটাই ছড়িয়ে যাবে যে, পরে কঠোর লকডাউন দিলেও দেখা যাবে সংক্রমণ পরিস্থিতি আবার আগের অবস্থায় চলে গেছে। তীব্রগতিতে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।’

‘লকডাউন’ শিথিলের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর গতকাল কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, ‘আমরা গত মঙ্গলবার পর্যন্ত বেশ হতাশ ছিলাম। আজ (গতকাল) একটু আশান্বিত যে, সরকার পর্যটন কেন্দ্র, বিয়েশাদি, জনসমাবেশ বন্ধ রেখেছে। এটার সঙ্গে যদি আমরা সবাই সত্যিকার অর্থে অপ্রয়োজনে বের না হই ও মাস্কটা পরি আর কোরবানির হাটে যতটা সম্ভব না যাওয়া ও অনলাইনে পশু কেনাবেচা করা যায়, যারা যাবে তারা স্বাস্থ্যবিধি মানবে আমি মনে করি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এটা হবে মন্দের ভালো। আর সেটা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’

একইভাবে ‘লকডাউন’ শিথিলের কারণে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন গতকাল বলেন, ‘সরকারের নির্দেশে পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে চলমান বিধিনিষেধ ১৫-২২ জুলাই আট দিনের জন্য শিথিল করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনে করে এই বিধিনিষেধ শিথিল করা সাপেক্ষে আমাদের সংক্রমণ বৃদ্ধি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে যেন গণপরিবহন, বাজার ও পশুর হাট এবং শপিং মলগুলো খোলা রাখা হয় সেটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বারবার কঠোরভাবে বলার চেষ্টা করছে। পরিবহনে যাত্রীর সংখ্যা অর্ধেক করা না হলে সংক্রমণের মাত্রা কমার কোনো সুযোগ থাকবে না। ঢাকায় ১৭-২১ জুলাই পর্যন্ত কোরবানির পশুর হাট বসবে, সেখানে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বাড়তে পারে। তাই বিধিনিষেধ শিথিল করা হোক বা না হোক, আমাদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে।’

১৪ দিনেই এপ্রিল-জুনের দ্বিগুণ ও তিনগুণ রোগী : গত দুই সপ্তাহে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা গত এপ্রিল ও জুন মাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ মাসের গত ১৪ দিন আগে দেশে সর্বোচ্চ রোগী ছিল এপ্রিল মাসে মোট ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩৭ ও জুনে ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন। অথচ গত ১৪ দিনেই মোট রোগী শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ৪৬ হাজার ২৮০ জন। এ সংখ্যা পুরো জুন মাসের মোট রোগীর সংখ্যার চেয়ে ৩৩ হাজার ৫৬২ জন বেশি ও পুরো এপ্রিল মাসের মোট রোগীর চেয়ে ১ হাজার ৫৫৭ জন কম। সে হিসাবে এপ্রিল মাসে দৈনিক রোগী পাওয়া গেছে ৪ হাজার ৯২৮ ও জুনে ৩ হাজার ৭৫৭ জন করে। অথচ এ মাসের গত ১৪ দিনেই দৈনিক রোগী শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৪৪৯ জন করে। অর্থাৎ ১৪ দিনেই এপ্রিলের দ্বিগুণ ও জুনের তিনগুণ বেশি রোগী পাওয়া গেছে।

মৃত্যুও এপ্রিল-জুনের দ্বিগুণ-তিনগুণ : গত ১৪ দিনে যে সংখ্যক মানুষ করোনায় মারা গেছে, তা এপ্রিল ও জুন মাসের মোট মৃত্যুকেও ছাড়িয়ে গেছে। এপ্রিলে মারা গেছে ২ হাজার ৪০৪ ও জুনে ১ হাজার ৮৮৪ জন। অন্যদিকে গত দুই সপ্তাহে মারা গেছে ২ হাজার ৫৪৯ জন। সে হিসাবে গত ১৪ দিনের মৃত্যু পুরো জুন মাসের মৃত্যুর চেয়ে ৬৬৫ ও এপ্রিলের চেয়ে ১৪৫ জন বেশি। গত ১৪ দিন ধরে যেখানে দৈনিক মৃত্যু হচ্ছে ১৮২ জন করে; সেখানে এপ্রিলে দৈনিক মৃত্যু ছিল ৮০ ও জুনে ৬২ জন করে। অর্থাৎ ১৪ দিনেই জুনের চেয়ে তিনগুণ ও এপ্রিলের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি মৃত্যু হয়েছে।

জুলাই করোনার কঠিন মাস : চলতি জুলাই মাসকে করোনা সংক্রমণের জন্য অত্যন্ত কঠিন মাস বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ব্যাপারে অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ‘জুলাই মাস খুব কঠিন মাস। জুনে ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ রোগী শনাক্ত করা হয়েছিল। জুলাইয়ের ১৪ দিনে আমরা এত রোগী পেয়ে গেছি। এ মাসের আরও ১৬ দিন বাকি আছে। যেহেতু সংক্রমণের মাত্রা এখন অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে, স্বাস্থ্যবিধি ও প্রতিরোধে ব্যবস্থা যদি না নেওয়া হয়, দুই সপ্তাহ পর্যন্ত কিন্তু টানা এভাবে চলতে পারে। মৃত্যু তিন সপ্তাহ পর্যন্ত এভাবে চলতে পারে।’

এ কর্মকর্তা বলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরে আমরা দুইশোর ওপরে মৃত্যু দেখতে পাচ্ছি। এক দিনে শনাক্তের হারও অনেক বেশি, প্রায় ২৯ দশমিক ২১ শতাংশ। প্রথম থেকে হিসাব করলে ১৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আমাদের মৃত্যুর হারও বাড়ছে। গত দুই সপ্তাহে ঢাকায় এবং খুলনায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে। প্রথম থেকে হিসাব করলে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ঢাকা ও চট্টগ্রামে। সংক্রমণের মাত্রা বরিশাল ও চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি।’

তিনি আরও বলেন, ‘বরিশালে গত এক সপ্তাহে শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি। গত এক সপ্তাহে ১১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চট্টগ্রামে ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। ঢাকায় অন্যান্য বিভাগের চেয়ে সংক্রমণ ২৫ শতাংশ কম। রাজশাহীতে সংক্রমণ সবচেয়ে কম যেখানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাধ্যমে প্রথমে রাজশাহীতে আমরা সংক্রমণের ঢেউ দেখেছিলাম। সেখানে এখন সংক্রমণ মাত্র ১৫ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জকে আদর্শ বলা হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যে পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল, প্রশাসন সহায়তা করেছে এবং প্রান্তিক মানুষ স্বাস্থ্যবিধি পালন করেছে দুই থেকে তিন সপ্তাহের স্থানীয় কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে তারা ৭২ শতাংশ থেকে সংক্রমণের হার ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে তা কঠোরভাবে পালন করলে সংক্রমণের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। পুরো দেশে গত সাত দিনের চিত্রে দেখা যাচ্ছে, কিছুটা হলেও যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তার মাধ্যমে সংক্রমণের মাত্রা ৩২ শতাংশ থেকে ২৯ শতাংশে নেমে এসেছে।’

Share.

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Leave A Reply

mostplay app

4rabet app

leonbet app

pin up casino

mostbet app

Exit mobile version