ছোট একটি গ্যারেজ। সেখানে লেখাপড়া শিখছে সুবিধাবঞ্চিত কয়েকটি শিশু। সাজেদা ফাউন্ডেশনের যাত্রাকালীন কার্যক্রম বলতে এটুকুই। ১৯৮৭ সালে ছোট সে গ্যারেজে যাত্রা করা সাজেদা ফাউন্ডেশন কালের পরিক্রমায় বড় হয়েছে। কলেবর বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে কাজের পরিধিও। সংস্থাটি বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা ও নানা সামাজিক কর্মসূচির পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণসেবা কার্যক্রমও পরিচালনা করছে। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম ছড়িয়েছে দেশের ২৫ জেলায়। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। দেশের ওষুধ খাতের অন্যতম শীর্ষ বিক্রেতা লাভজনক প্রতিষ্ঠান রেনাটা লিমিটেডেরও সিংহভাগ মালিকানা সাজেদা ফাউন্ডেশনের। সংস্থাটির অধীনে রেনাটা লিমিটেড প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশের মৌলিক ও সামাজিক ব্যবসার সফল উদাহরণ হিসেবে।

দেশে এখন পর্যন্ত পারিবারিক উদ্যোগে বেশ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পারিবারিক নানা জটিলতা এসব ব্যবসার ওপর জোরালো প্রভাবও ফেলতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিবারের অধীনে পরিচালনাধীন সামাজিক ব্যবসাগুলোয় এসব জটিলতার উপস্থিতি তুলনামূলক কম। পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ বিরোধ, সুশাসনের ঘাটতির মতো বিষয়গুলো উপস্থিত থাকলেও ফাউন্ডেশনের ক্ষেত্রে এসব জটিলতা খুব কমই দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অলাভজনক দৃষ্টিভঙ্গির যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সামাজিক ব্যবসায় বিশেষ উদাহরণ সৃষ্টি করা সম্ভব। ভারতে টাটা ট্রাস্টস ফাউন্ডেশন এ মডেলে ব্যবসা চালিয়ে সাফল্য পেয়েছে। বাংলাদেশেও রেনাটা লিমিটেডের মাধ্যমে এমনই এক মৌলিক ও সফল উদাহরণ সৃষ্টি করেছে সাজেদা ফাউন্ডেশন।

সংশ্লিষ্টদের ভাষ্যমতে, রেনাটা ও সাজেদা ফাউন্ডেশনের এ সফলতার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কৃতিত্বের দাবিদার প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ হুমায়ুন কবীর। তাদের ভাষ্যমতে, হুমায়ুন কবির নিজে ছিলেন ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসনের কঠোর অনুসারী। তার জীবনদর্শন অনুসরণ করেই এখনো সাজেদা ফাউন্ডেশন ও রেনাটা সাফল্য ধরে রাখতে পেরেছে।

আশির দশকের শেষ দিকে ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করলেও দেশের ওষুধ খাতে সৈয়দ হুমায়ুন কবিরের পদার্পণ ষাটের দশকের মাঝামাঝি। ওই সময়ে তত্কালীন ফাইজার ইন্ডাস্ট্রিজে সিনিয়র ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেন তিনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে মার্কিন ওষুধ জায়ান্ট ফাইজার করপোরেশনের সাবসিডিয়ারি হিসেবে বাংলাদেশে ফাইজার ল্যাবরেটরিজের কার্যক্রম শুরু হয়। সে সময় সৈয়দ হুমায়ুন কবীর প্রতিষ্ঠানটির প্রথম এমডি হিসেবে দায়িত্ব নেন। ২৫তম বিবাহবার্ষিকীতে স্ত্রীর জন্য উপহার হিসেবে ১৯৮৭ সালে অনানুষ্ঠানিকভাবে সাজেদা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সংস্থাটির আনুষ্ঠানিক যাত্রা ১৯৯৩ সালে।

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে উৎপাদনের চেয়ে গবেষণার দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে বৈশ্বিক ওষুধ খাতের বহুজাতিক জায়ান্ট ফাইজার। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশ থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নেয় কোম্পানিটি। ১৯৯৩ সালে ফাইজারের বাংলাদেশের ব্যবসার মালিকানা স্থানীয় শেয়ারহোল্ডারদের হাতে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ হস্তান্তর প্রক্রিয়া চলাকালেই রেনাটা প্রতিষ্ঠা করেন সৈয়দ হুমায়ুন কবীর। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের মার্কিন শেয়ারহোল্ডারদের মালিকানাধীন ফাইজার বাংলাদেশের শেয়ার সাজেদা ফাউন্ডেশনের অনুকূলে ধার দিতে রাজি করান।

শুরুতে শর্ত ছিল, সাজেদা ফাউন্ডেশন পরবর্তী সময়ে শেয়ারের মূল্য পরিশোধ করে দেবে। পরে সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে ফাইজার এখানকার ব্যবসার শেয়ারের ৫১ শতাংশ সাজেদা ফাউন্ডেশনকে দান করে দেয়। সে সময় ফাইজার করপোরেশনের কাছ থেকে সাজেদা ফাউন্ডেশনের পাওয়া শেয়ারের সংখ্যা ছিল ২১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯০। প্রতিটি ১০ টাকার শেয়ারকে ১৫ টাকা ১০ পয়সায় ধরে শেয়ারগুলোর মোট মূল্যায়িত অংক দাঁড়ায় ৩ কোটি ২৫ লাখ ৪৬ হাজার ৩৮৯ টাকায়। গতকালের বাজারদর অনুযায়ী সাজেদা ফাউন্ডেশনের মালিকানায় থাকা রেনাটার শেয়ারের মূল্য ৬ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকারও বেশি। আর রেনাটার শতভাগ শেয়ারের মূল্য ১২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ) পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে সামাজিক ব্যবসার ভালো বেশ কয়েকটি উদাহরণ আছে আর তার মধ্যে অবশ্যই রেনাটা একটি। সাজেদা ফাউন্ডেশনের মতো কার্যক্রমগুলোর মূলে আছে সামাজিক কল্যাণ, কিন্তু এ সংস্থাগুলোর মুনাফাও আছে। বিএসআরএম, রহিমআফরোজ, ইনসেপ্টাসহ আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠান একই ধরনের ব্যবসা পরিচালনা করে। আবার স্কয়ারেরও সামাজিক ব্যবসার আদলে কর্মকাণ্ড আছে। তবে সাজেদা ফাউন্ডেশনের মডেল বা কাঠামোটি মৌলিক। রেনাটা পৃথক একটা ব্যবসায়িক সত্তা, যা সাজেদা ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ডের একটি অংশ।

২০১৯-২০ হিসাব বছরে রেনাটার কাছ থেকে ৪১ কোটি টাকার বেশি লভ্যাংশ আয় পেয়েছে সাজেদা ফাউন্ডেশন। এ লভ্যাংশ আয়ের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণের বিপরীতে সার্ভিস চার্জ ও সদস্যদের জমাকৃত অর্থ দিয়েই পরিচালিত হচ্ছে ফাউন্ডেশনের অধিকাংশ কর্মসূচি।

সাজেদা ফাউন্ডেশন ও রেনাটার এ ব্যবসায়িক সাফল্য এবং সম্প্রসারণের পেছনে সৈয়দ হুমায়ুন কবীরের গড়ে দেয়া কাঠামো অনেক বড় অবদান রেখেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে সাবেক ব্যাংকার ও অর্থনীতির বিশ্লেষক মামুন রশীদ বণিক বার্তাকে বলে, হুমায়ুন কবীর অনেক ন্যায়পরায়ণ একজন ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সুশাসনে বিশ্বাস করতেন। সামাজিক ব্যবসাগুলোর পরিচালনাসংক্রান্ত সমস্যা আছে। দেখা যায় এগুলো একজন ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত। এক্ষেত্রে ব্র্যাক কিছুটা করপোরেট কাঠামো উন্নয়ন করতে পেরেছে। হুমায়ুন কবীর শুরু থেকেই সাজেদা ফাউন্ডেশনের কাঠামোর বিস্তৃতি বাড়িয়েছেন।

ফাউন্ডেশন কাঠামোয় ব্যবসা পরিচালনা সম্পর্কে মামুন রশীদ বলেন, ব্যবসাগুলো সমাজের ভালো মানুষগুলোকে কাজের সুযোগ করে দেয়। এ কাঠামোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো আমি মালিক থাকলেও এটা পরিচালিত হবে দক্ষ অভিজ্ঞ মানুষের মাধ্যমে। দিনশেষে কর্তৃত্ব মালিকের হাতেই থাকবে। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রটি হয় অনেক বিস্তৃত।

সাজেদা ফাউন্ডেশনের পরিচালনাধীন রেনাটা লিমিটেড এখনো সফলভাবেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোম্পানিটির ওষুধ রফতানি হচ্ছে। আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ধারাবাহিকভাবে ব্যবসা ও মুনাফায় প্রবৃদ্ধি করছে কোম্পানিটি। ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি, পরের বছর ২ হাজার ১৩৩ কোটি, ২০১৮-১৯ সালে ২ হাজার ৫৪৩ কোটি ও ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার পণ্য বিক্রি করেছে কোম্পানিটি। গত চার হিসাব বছরে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট মুনাফা হয়েছে যথাক্রমে ২৬১ কোটি, ৩১৯ কোটি, ৩৮২ কোটি ও ৪১২ কোটি টাকা। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) কোম্পানিটির শেয়ার গতকাল সর্বশেষ ১ হাজার ২৮২ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হয়েছে।

রেনাটা লিমিটেড ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থা সাজেদা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ হুমায়ুন কবীরের জন্ম ১৯৩১ সালে কলকাতায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোয় ইউনিভার্সিটি অব স্ট্রাথক্লাইডে ফার্মাসিতে পড়াশোনা করার জন্য যান। ১৯৫৭ সালে তিনি চা বাগানে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি শুরু করেন। সেখানে তিনি ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন। এরপর ফাইজারে যোগ দেন তিনি।

সৈয়দ হুমায়ুন কবীর মারা যান ২০১৫ সালের ৭ জুলাই। এর আগ পর্যন্ত তিনি ব্র্যাকের গভর্নিং বডির সদস্য ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তবে শুধু সামাজিক ব্যবসার কাঠামোকে ব্যবসা পরিচালনার জন্য ভালো বিকল্প বা পরিমাপক হিসেবে মানছেন না হুমায়ুন কবীরের সন্তান ও রেনাটার বর্তমান কর্ণধার সৈয়দ এস কায়সার কবীর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, করপোরেট মালিকানা ও ব্যবসায়িক দক্ষতার বিচার কেবল দীর্ঘকালের ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে করা সম্ভব। কারণ এর যথার্থতা কাঠামোভেদে আলাদা। দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডনির্ভর মতামত হবে বিভ্রান্তিকর। ফাউন্ডেশনের মালিকানাধীন কোম্পানি যেমন অসাধারণ পারদর্শিতা দেখাতে পারে আবার অনেক ফাউন্ডেশন ও এনজিও মালিকানাধীন কোম্পানিও আছে, যেগুলোর পারদর্শিতা বেশ দুর্বল। মূল হলো ব্যবসাটি পেশাদার যোগ্য কর্মীর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে কিনা। আবার কিছুটা অনানুষ্ঠানিকতা অনেক সময় প্রতিষ্ঠানের জন্য ইতিবাচক হিসেবেও কাজ করে। মোদ্দা কথা হলো ব্যবসার পারফরম্যান্স শুধু ব্যবসার নীতির ওপর নির্ভর করে না। আবার মালিকানার স্বত্ব কাঠামোও এখানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়।

Share.

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Leave A Reply

mostplay app

4rabet app

leonbet app

pin up casino

mostbet app

Exit mobile version