১০ দিনের বৈঠকে কী পেল বিএনপি

গত এক মাসে দলের নেতা ও পেশাজীবীদের সঙ্গে ১০ দিন বৈঠক করল বিএনপি। ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকগুলো ছিল বেশ দীর্ঘ, যা গড়ে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টার মতো। কিন্তু রুদ্ধদ্বার এবং দীর্ঘ এ বৈঠকগুলো থেকে কী পেল বিএনপি, তা নিয়ে নানা রকম বিশ্লেষণ চলছে বিভিন্ন মহলে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানায়, ১০ দিনের ভিন্ন ভিন্ন এসব বৈঠকে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এবং পেশাজীবী সংগঠনের মোট ৪২২ জন প্রতিনিধি বক্তব্য বা মতামত দেন।

১০ দিনের এ বৈঠকগুলো ছিল রুদ্ধদ্বার। বৈঠকে আলোচিত বিষয়গুলো সম্পর্কে বিএনপির পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলা হয়নি; বরং বৈঠকের বিষয়ে মহাসচিব ছাড়া অন্য কেউ যাতে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলেন, সে ব্যাপারে একরকম নিষেধাজ্ঞা ছিল দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে। তবু নানা সূত্রে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক ধরে কথা বলে সংবাদকর্মীরা নিজেদের মতো বৈঠকের সারকথাগুলো প্রকাশ করেছেন।

দেখা যায়, ১০টি বৈঠকের মূল কথা ছিল বর্তমান সরকারের অধীন আর কোনো নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের অধীন সংসদ নির্বাচনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনে নামতে হবে। আর এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে বিএনপিকে। সে ক্ষেত্রে জোটগতভাবে আন্দোলন না করে এবার যুগপৎ আন্দোলন গড়া। এর জন্য বর্তমান ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কাঠামোকে আর সক্রিয় না করা, দেশি–বিদেশি মহলের বৈরিতা কাটাতে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোটগত সম্পর্ক আর না রাখা ইত্যাদি।

তবে বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলো বলছে, পেশাজীবীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত তিনটি বৈঠক এবং দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকগুলোতে আলোচনা ও মতামতের ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য ছিল। পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা আন্দোলনের ব্যাপারে মত দিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের পরামর্শ হচ্ছে, আন্দোলন জনসম্পৃক্ত করতে হবে। কারণ, তাঁরা মনে করেন, কেবল দলীয় কর্মী-সমর্থক বেষ্টিত আন্দোলন কখনো সফল হয় না। এ ছাড়া আন্দোলন যাতে সহিংস না হয় এবং সাধারণ জনগণ যাতে আন্দোলনে আতঙ্কিত না হয়ে ওঠে, সে ব্যাপারে বিএনপির নেতৃত্বকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন পেশাজীবীরা। এ ছাড়া ১০ দিনের বৈঠকে দলকে ঐক্যবদ্ধ করার তাগিদ, দল পুনর্গঠন নিয়ে ক্ষোভ, কূটনৈতিক ব্যর্থতাও নিয়েও কথাবার্তা এসেছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, মতামতগুলো নিয়ে তাঁরা দলের স্থায়ী কমিটিতে বসবেন। এরপর তাঁরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন।

দলীয় সূত্র জানায়, মূলত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এ বৈঠকের আয়োজন করেন। প্রথম দফায় ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর ও দ্বিতীয় দফায় ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিন করে ছয় দিন বৈঠক হয়। এতে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদকমণ্ডলী, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সাংগঠনিক জেলা, দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতারা নিজেদের মতামত জানান। এর পরপর ২৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্যদের সঙ্গে, পরদিন ২৮ সেপ্টেম্বর পেশাজীবী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়। সর্বশেষ ৮ ও ৯ অক্টোবর ৪৮টি পেশাজীবী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।

বৈঠকগুলোতে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কয়েকজন নিয়মিত উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১০ দিনের বৈঠকে ৯ দিন উপস্থিত ছিলেন ইকবাল হাসান মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘এই বৈঠক থেকে আমরা মাঠপর্যায়ের নেতাদের কাছ থেকে একটা নির্দেশনা পেয়েছি, যেটি দলের নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বৈঠকে অন্য দিকটি হচ্ছে, এর প্রভাব নেতা–কর্মীদের ওপর পড়েছে। তারা এখন অনুপ্রাণিত। তাদের এত দিনকার যে ভয়, জড়তা ছিল—তা কাটছে।’

বিএনপির নেতারা বলছেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এত বিস্তৃত আয়োজনে এ বৈঠকগুলো ছিল বিএনপির বড় অর্জন। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে ৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর নেতৃত্বে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভা হয়েছিল। এরপর এই প্রথম বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে নির্বাহী কমিটির বৈঠক হলো। সব বৈঠকে তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত ছিলেন।

বিএনপির নেতারা বলছেন, এ বৈঠকে যে মতামতগুলো এসেছে, সেগুলোর ভিত্তিতে দল আন্দোলনে নামবে কি না, আগামী সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যাবে কি না, ২০-দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্ট ভেঙে দেওয়া হবে কি না—এ বিষয়গুলো এখনো বড় প্রশ্ন। তবে এ বৈঠকগুলোতে দল বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছে। দীর্ঘদিন পর বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটা উৎসাহের সৃষ্টি করেছে।

Leave a Comment