হাল তুরানা নালত্বাকী

[একটি কবিতা যার ভেতর লুকিয়ে আছে এক ইতিহাস। বিংশ শতাব্দীর রোমান্টিসিজমের ইতিহাস। কবিতাটি রচনা করেছিলেন সায়্যিদ কুতুব শহীদ (রহঃ) এর বোন সায়্যিদ আমিনা কুতুব (রহঃ) তার স্বামী কামাল আস সানানীরি (রহঃ) এর স্মরণে।

১৯৫৪ সালে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বড় নেতা কামাল আস সানানীরিকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে তার মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও পরে তা কমিয়ে ২৫ বছর করে হয়। কিন্তু পাঁচ বছরের মাথায় কামাল অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানে তাকে দেখতে যান সাইয়েদ কুতুব শহীদ (রহঃ)। তখন কামাল সানানীরী আমেনা কুতুবের জন্যে তার ভাই সাইয়েদ কুতুবের নিকট প্রস্তাব পেশ করেন।

প্রস্তাব আমেনার কাছে পৌছলে মহিয়সী এই নারী দীর্ঘ দারাদণ্ডপ্রাপ্ত এই ইসলামী দাঈর সাথে বিয়েতে সানন্দে রাজী হয়ে গেলেন। তাদের আকদ সম্পন্ন হলো, যদিও বর তখন ছিলেন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।
তারপর বেশ কয়েক বছর পর আমেনার নিকট চিঠি এলোঃ আমি মনে হয় তোমার উপর জুলুম করে ফেলছি। তখন মনে করেছিলাম খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি পাব। এখন আমি তোমার সুন্দর জীবনের কাঁটা হয়ে থাকতে চাইনা। আমি তোমাকে এই ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিলাম। তোমার কি মতামত তা আমাকে জানাবে।

এই চিঠির উত্তরে আমেনা কুতুব লিখেছিলেনঃ আমি আমার স্বপ্নকেই গ্রহণ করলাম। জি হা দ ও জান্নাতের পথকে গ্রহণ করলাম। এই পথে আমি দৃঢ় থাকবো কোনরকমের ইতস্ততা ছাড়া।

এরপর দীর্ঘ ১৭ বছর পর ১৯৭৬ সালে কামাল সানানীরী মুক্তি পান। এবার আমিনার সুখের সংসার শুরু হয়। কিন্তু এই সুখ বেশীদিন টিকেনি। ১৯৮১ সালে তাকে দ্বিতীয়বারের মত গ্রেফতার করা হয়। নাহ এবার আর আমিনার নিকট তাকে ফেরত পাঠানো হয়নি। প্রচণ্ড নির্যাতনের মুখে এই ইসলামের সৈনিক শাহাদাত বরণ করেন। তাকে সকলের অগোচরে রাতারাতি দাফন করা হয়।

এদিকে স্বামীর প্রতীক্ষায় থাকা আমেনা কুতুব তার বিরহে একটি বিখ্যাত ক্বাসিদা রচনা করেন।
” হাল তুরানা নালতাক্বী –
আচ্ছা বলুন! আমাদের কি আবার সাক্ষাৎ হবে? ”
যেখানে তিনি তার ভালোবাসা, একনিষ্ঠতা ও জি হা দে র স্মৃতিচারণ করেছেন।]

অনুবাদকৃত ক্বাসিদাঃ
❛❛ আপনার কি মনে হয়, আমাদের আবার সাক্ষাৎ হবে?
নাকি আমাদের এই সাক্ষাৎ মরীচিকাময় প্রান্তরে

যা শেষমেশ হারিয়ে যায় এবং এর ছায়া মিলিয়ে যায়
অতপর তা পরিণত হয় যন্ত্রণাদায়ক স্মৃতিতে

এভাবেই আমার অন্তর প্রশ্ন করে
যখন বিরহের দিনগুলো দীর্ঘ হয়

একসময় আপনার ছায়ামূর্তি হাস্যোজ্জ্বল হয়ে তাকায়
যেন সে আমার করা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়

আমরা কি একসাথে আবার জীবনসঙ্গী হয়ে চলবোনা?
যাতে অনিষ্ট এই পৃথিবী আবার কল্যাণে সিক্ত হতে পারে?

এক কণ্টকাকীর্ণ পথে আমরা চলেছি
যেখানে সমস্ত আরামকে আমরা বিসর্জন দিয়েছিলাম

ভালোবাসাকে দাফন করেছিলাম আমাদের অভ্যন্তরে
আর এই পথে চলেছিলাম হাসিমুখে, তার কল্যাণের প্রত্যাশায়

আমরা তো একসাথে পথ চলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম
কিন্তু আপনি প্রস্থানের ডাকে দ্রুত সাড়া দিলেন

যখন অনুগ্রহকারী প্রভু আমাকে ডেকেছিলেন
প্রশস্ত জান্নাতের এক জীবনের দিকে

ডেকেছিলেন অনন্ত নেয়ামতের সে সাক্ষাতের দিকে
আল্লাহর সৈনিকদের সাথে, যারা সঙ্গদানে উৎফুল্ল হয়

যারা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন
তার ডাকে দ্বিধাহীনভাবে সাড়া দিয়ে

অতএব আপনার অন্তর এই উদাসীনতা কাটিয়ে উঠুক
কেননা চিরস্থায়ী সাক্ষাৎ অপেক্ষা করছে সেই প্রশস্ত জান্নাতে

ওহে প্রস্থানকারী! বিভিন্ন অভিযোগের কারণে আমি ক্ষমাপ্রার্থী
এখন আমার ভর্ৎসনাগুলোকে সরিয়ে দিচ্ছি আপনার ছায়ামূর্তির দিকে

আপনি ভারাক্রান্ত এই হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটালেন
তা কুয়াশা ঢাকা রাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে

আমি একাকী দিশেহারা হয়ে চলছি
বিষন্নতায় এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে

রাত এখনো দীর্ঘ, খুব বেশী নির্জন
যেখানে যন্ত্রণার ঢেউ খেলছে

এই রাতে হঠাৎ কোন বিজলি চমকে উঠছেনা
তারার আলোগুলোও ম্লান হয়ে পড়েছে

তবু আমি এই পথ পাড়ি দিয়ে যাব
যেভাবে আপনি আমাকে খুঁজে নিয়েছিলেন এক কঠিন মুহুর্তে

আমার মাথা সর্বদা উঁচু থাকবে
কোন কথায় কিংবা উত্তরে তা নত হবেনা

এই সুরভিত রক্ত আমাকে সম্মুখ পানে এগিয়ে নিবে
যা প্রস্থানের সমস্ত দরজাকে আলোকিত করে রেখেছ ❜❜

©

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *