হালাল রিযকের অন্বেষণ

হালাল রিযকের অন্বেষণ, ইসলামে প্রাথমিক পর্যায়ের ফরজ আমলগুলোর পর রিজিক অন্বেষণকে অত্যন্ত গুরত্ব দেওয়া হয়েছে। হালাল রিজিকের অনুসন্ধান করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। ফরজ পরিমাণ ইলম যেমন প্রতিটি মানুষকে অর্জন করতে হয়, তেমনি নিজের জীবনযাপনের জন্য হালাল রিজিকের সন্ধান করাকেও ইসলাম অত্যন্ত গুরত্বারোপ করেছে। হালাল রিজিক উপার্জন করা, তা দিয়ে স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের ভরণপোষণ করা ইসলামে অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের আমল।

হালাল রিযকের অন্বেষণ

হালাল উপার্জন করা ফরজ হলেও দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হওয়া যাবে না। হালাল উপার্জন হচ্ছে কিন্তু দুনিয়ার প্রতি আসক্তি হচ্ছে না, এর উদাহরণ হলো, নামাজের সময় দোকান বন্ধ করে মসজিদে যাওয়া। হালাল রিযকের অন্বেষণ, কিন্তু কেউ ব্যবসায় এত ডুবে থাকল যে সে নামাজ পড়ারও ফুরসৎ পেল না, তাহলে তা দুনিয়ার প্রতি আসক্তি। সুতরাং হালাল উপার্জন করা ফরজ, তবে দুনিয়ার প্রতি আসক্তি নিষিদ্ধ। এ জন্যই ওলামায়ে কেরাম বলেন, ‘ব্যবসা করা ফরজে কেফায়া। কারণ এ ছাড়া সমাজ ও রাষ্ট্র চলতে পারে না। তবে সম্পদের আসক্তি নিষিদ্ধ।’ (খুতুবাতে হাকিমুল উম্মত : ৮/১৯৭)। 

কুরআনে রিজিকের ব্যাপারে অনেক আয়াত এসেছে। যেমন,

وَ مَا مِنۡ دَآبَّۃٍ فِی الۡاَرۡضِ اِلَّا عَلَی اللّٰهِ رِزۡقُهَا وَ یَعۡلَمُ مُسۡتَقَرَّهَا وَ مُسۡتَوۡدَعَهَا ؕ کُلٌّ فِیۡ کِتٰبٍ مُّبِیۡنٍ ﴿۶﴾

জমিনে বিচরণশীল এমন কোন জীব নেই যার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর উপর নেই, তিনি জানেন তাদের থাকার জায়গা কোথায় আর কোথায় তাদেরকে (মৃত্যুর পর) রাখা হয়, সব কিছুই আছে সুস্পষ্ট লিপিকায়। [সুরা হুদ : ৬]

فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَ ابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰهِ وَ اذۡکُرُوا اللّٰهَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ ﴿۱۰﴾

অতঃপর যখন সালাত সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার। [সুরা আল-জুমুআ : ১০]

یٰۤاَیُّهَا الرُّسُلُ کُلُوۡا مِنَ الطَّیِّبٰتِ وَ اعۡمَلُوۡا صَالِحًا ؕ اِنِّیۡ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ عَلِیۡمٌ ﴿ؕ۵۱﴾

‘হে রাসুলগণ, তোমরা পবিত্র ও ভাল বস্ত্ত থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সর্ম্পকে আমি সম্যক জ্ঞাত। [সুরা মুমিনুন : ৫১]

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُلُوۡا مِنۡ طَیِّبٰتِ مَا رَزَقۡنٰکُمۡ وَ اشۡکُرُوۡا لِلّٰهِ اِنۡ کُنۡتُمۡ اِیَّاهُ تَعۡبُدُوۡنَ ﴿۱۷۲﴾

হে মুমিনগণ, আহার কর আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিজিক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর কর, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদাত কর। [সুরা বাকারা : ১৭২]

এ ছাড়া হাদিসেও হালাল রিজিক অন্বেষণের কথা এসেছে। যেমন,

ইবনু মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

আল্লাহর নির্ধারিত রিজিক পূর্ণমাত্রায় লাভ না করা পর্যন্ত কোনো জীবজন্তুই মারা যায় না। সাবধান! আল্লাহকে ভয় কর এবং বৈধ পন্থায় আয়-উপার্জনের চেষ্টা কর। হালাল রিযকের অন্বেষণ, রিজিক প্রাপ্তিতে বিলম্ব যেন তোমাদের তা উপার্জনে অবৈধ পন্থা অবলম্বনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তা কেবল তার আনুগত্যের মাধ্যমেই লাভ করা যায়। [সুনানু ইবনু মাজাহ]

হালাল রিজিকের জন্য কি আমল

হালাল রিজিকের জন্য কি আমল, রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হাদিসে পাকে ইরশাদ করেন, 

‘হালাল রিজিক অন্বেষণ করা ফরজ আদায়ের পর আরেক ফরজ।’ [তিবরানি ও বায়হাকি শরিফ]

মানুষের মনে একটি ধারণা আছে যে, যার উপায় ও মাধ্যম বেশী আছে সে বেশী উপার্জন ও রিজিক ভোগ করতে পারে। কিন্তু রিজিক কেবল উপায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং কে কত বেশী রিজিক ভোগ করবে তা নির্ভর করে কুদরতি ফায়সালার ওপর। প্রত্যেকের রিজিকের ফায়সালা আল্লাহ মানুষের জন্মের বহু আগে লিখে রেখেছেন। যেটুকু রিজিক লিখে রাখা হয়েছে, আপনি তার চেয়ে কমও পাবেন না, বেশিও পাবেন না।

হালাল রিজিক অন্বেষণ করো তোমরা!

হালাল রিজিক অন্বেষণ করো তোমরা! সবার রিজিক একই জায়গায় থাকে না। কারো রিজিক থেকে পড়ানোর মাধ্যমে। ফলে সে টিউশন, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর মাধ্যমে রিজিক উপার্জন করে। হালাল রিযকের অন্বেষণ, কেউ হোটেল-রেস্টুরেন্টে কাজ করে রিজিক উপার্জন করে। পাইলটরা আকাশে বিমান চালিয়ে রিজিক অন্বেষণ করে। কারো রিজিক লুকায়িত অথৈ সাগরে ভাসমান জাহাজে। কারো রিজিক রান্নাঘরে, ফলে তাকে আগুনের তাপে রান্না করে রিজিকের অন্বেষণ করতে হয়। আবার কেউ কাজ করে বরফ ভাঙ্গার কলে। ফলে শীতল পরিবেশে তার রিজিকের ব্যবস্থা হয়। একেক জনের রিজিক অন্বেষণের পন্থা একেক রকম। কেউ একটু সহজে অর্জন করে, কাউকে অনেক বেশী পরিশ্রম করতে হয়। কেউ কম পায়, আবার কেউ বা বেশী পায়। কিন্তু মানুষ যখন সম্পদ বা উপার্জনের বিচারে তার চেয়ে নিচের কাউকে দেখে তখন সে প্রশান্তি লাভ করে। 

ইসলামেও আমাদেরকে সর্বদা নিচের দিকে তাকাতে উৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ, উপরে তাকালে কেবল হতাশই হতে হবে। কারণ উপরের কোনো শেষ নেই। সর্বদা আপনার চেয়ে উপরে কেউ না কেউ থাকবেই। তাই আপনার কখনোই পরিপূর্ণ সন্তুষ্টি লাভ হবে না। এ জন্য যারা আপনার চেয়ে পিছিয়ে আছে তার দিকে তাকান। আপনি সবসময় ক্লাসের প্রথম ছেলেটার দিকে তাকান। কিন্তু দ্বিতীয়জনের দিকে তো তাকান না। 

রিজিক বণ্টন আল্লাহই করেছেন। প্রত্যেকের রিজিক ও হায়াত আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন।হালাল রিযকের অন্বেষণ,  আল্লাহ বলেননি যে, তুমি বসে বসে থাকো আর আসমান থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রিজিক চলে আসবে। বরং ইসলামে কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

আল্লাহ তাআলা মানুষের থেকে একজন দিয়ে অপরজনের রিজিকের ব্যবস্থা করেন। [মুসনাদু আহমাদ : ১০৬৪৯]

রিজিক নিয়ে চিন্তিত?

রিজিক নিয়ে চিন্তিত? অনেকেই বলে, ‘আমার রিজিকে অমুক লোক ভাগ বসিয়েছে।’ কিন্তু সর্বদা মনে রাখবেন, আপনার রিজিকে কেউ ভাগ বসাতে পারবে না। আপনার রিজিকে যা লেখা আছে সেটা আপনি পাবেনই। আপনি যা পাওয়ার কথা কল্পনা করেছিলেন, কিন্তু সেটা আরেকজন পেয়ে গেল – এর অর্থ এই নয় যে অমুক লোক আপনার রিজিক ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। বরং ওই রিজিক অমুক লোকের ভাগ্যেই লেখা ছিল।

রিজিক অবশ্যই ভাগ করা। এটা চিরসত্য একটি বিষয়। তবে রিজিকের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে অবশ্যই। রিজিক অন্বেষণে যে প্রচেষ্টা চালানো দরকার এ ব্যাপারে চমৎকার একটি হাদিস এসেছে:

উমার ইবনুল খাত্তাব রা. হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ “‏ لَوْ أَنَّكُمْ كُنْتُمْ تَوَكَّلُونَ عَلَى اللَّهِ حَقَّ تَوَكُّلِهِ لَرُزِقْتُمْ كَمَا تُرْزَقُ الطَّيْرُ تَغْدُو خِمَاصًا وَتَرُوحُ بِطَانًا ‏”

তোমরা যদি প্রকৃতভাবেই আল্লাহ তাআলার উপর নির্ভরশীল হতে তাহলে পাখিদের যেভাবে রিজিক দেয়া হয় সেভাবে তোমাদেরকেও রিযিক দেয়া হতো। এরা সকালবেলা খালি পেটে বের হয় এবং সন্ধ্যা বেলায় ভরা পেটে ফিরে আসে। [সুনানু তিরমিজি : ২৩৪৪]

হালাল রিজকের জন্য প্রচেষ্টা চালানো

ক) জ্ঞান এবং দক্ষতা উন্নয়ন: মুসলিমদেরকে জ্ঞান অন্বেষণ করতে, দক্ষতা অর্জন করতে এবং তাদের পছন্দের ক্ষেত্রে দক্ষতা বিকাশ করতে উৎসাহিত করা হয়। শিক্ষা এবং পেশাগত উন্নয়নে বিনিয়োগ করার দ্বারা একজন মুসলিম হালাল উপার্জনের বৈধ ও টেকসই উপায় নিশ্চিত করার পথে এগিয়ে যান।

খ) সততা: ব্যবসায়িক লেনদেনে সততা এবং ন্যায় বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হালাল রিযকের অন্বেষণ, মুসলিমরা তাদের লেনদেনে স্বচ্ছ, সত্যবাদী এবং ন্যায্য হবে। তারা প্রতারণা, ঘুষ এবং হালাল রিজকের পবিত্রতাকে নষ্ট করে এমন অনৈতিক চর্চা এড়িয়ে চলবে।

গ) সামাজিক দায়বদ্ধতা: মুসলিমদের তাদের কাজের মাধ্যমে সমাজে ইতিবাচকভাবে অবদান রাখতে উৎসাহিত করা হয়। উপকারী পণ্য এবং সেবা প্রদান করে, কাজের সুযোগ তৈরি করে এবং দাতব্য উদ্যোগকে সহায়তা করে, সমাজের লোকেরা তাদের সমাজের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে হালাল রিজকের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে।

রিজিক নিয়ে টেনশন করবেন না

রিজিক নিয়ে টেনশন করবেন না, হালাল রিজিক অনুসন্ধান মানে শুধুমাত্র আর্থিক লাভই বোঝায় না। বরং রিজিকের মধ্যে জীবনের সকল দিক যেমন সম্পদ, স্বাস্থ্য এবং জ্ঞান সবই অন্তর্ভুক্ত। মুসলিমরা বিশ্বাস করে হালাল রিজিক অনুসন্ধান করা একটি মৌলিক দায়িত্ব। নিজেদের, পরিবারের এবং সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনের একটি উপায়। হালাল রিযকের অন্বেষণ, ইসলামি নীতিগুলিকে সমুন্নত রেখেই জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, হারাম (নিষিদ্ধ) উৎসগুলো এড়িয়ে চলতে হবে এবং নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে।

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *