সিদ্ধান্ত গ্রহনের ধাপ সমূহ

রাত আটটা বেজে গেল।মাশরাফি এখনও বাসায় আসেনি।মাশরাফির মা রাবেয়া বানু চিন্তায় অস্থির।ছেলের চিন্তা না যতটা,ছেলের বাবাকে নিয়ে চিন্তা তার চেয়েও বেশি।উনি মাশরাফির ফুটবল খেলা একদমই পছন্দ করেন না।ফুটবল ফুটবল করে পড়ালেখা লাটে উঠেছে।তাও অনেক ভাগ্য করে এসএসসি টা পাশ করেছে।এভাবে ফুটবলের পিছনে সময় দিলে এইচএসসি আর পাশ হবেনা- মাশরাফির বাবা এমনটাই মনে করেন।
মাশরাফি এখনো বাসায় না আসার খবরটা বাবার কানে গেছে।কিন্তু কিছু বলছেন না।এর মানে ঘটনা আরো সিরিয়াস।মাশরাফির কপালে দুঃখ আছে।রাবেয়া বানু দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছেন।


মাশরাফি এসেছে।রাবেয়া বানু চমকে উঠলেন।
-এত দেরী হলো কেন তোর?
-আর কয়েকদিন পরে ঢাকায় টুর্নামেন্ট।তাই স্যার এই কয়েকদিন ওভারটাইম প্রাকটিস করতে বলেছেন।ঐজন্য দেরী হলো,মা।
-তোর বাবা কিন্তু জেনে গেছেন।তাই বাবার সাথে আর দেখা করার দরকার নাই।চুপচাপ ঘরে যা।আমি ভাত নিয়ে আসছি।
এমন সময় মাশরাফির বাবা রফিক ইসলামের সেই ঘরে আগমন।
-আমাদের রোনালদো বাসায় এসেছে?
(মাশরাফি চুপ)
-এত আগে আসলেন কেন স্যার?বিশ্ব জয় করা শেষ?
-বাবা….ইয়ে মানে…
-চুপ কর বেয়াদব।তোর এত বাড় বেয়েছে যে তুই এত রাত করে বাসায় ফেরা ধরছিস!ফুটবলের পিছনে এত টাইম দিলে আর এইচএসসি পাশ করতে হবেনা।চাকরি বাকরিও করতে হবেনা।বাপের ঘাঁড়ে বসে খাইতে হবে সারাজীবন।
-বাবা, সামনেই ঢাকায় টুর্নামেন্ট।তাই প্রাকটিস করতে গিয়ে….
মাশরাফির গালে রফিক ইসলামের চড় পড়লো।
-তোর এত বড় সাহস তুই আবার আমার সামনে এই ফুটবলের নাম উচ্চারণ করিস!তোর ফুটবল খেলা আজকে থেকে বন্ধ।
-কেন,বাবা?ফুটবল খেললে সমস্যা টা কি?
রফিক সাহেব এবার মাশরাফির গালে,পিঠে,কানের নিচে সব জায়গায় প্রচুর মারতে লাগলেন।রাবেয়া বানু তাকে থামালেন।
-কালকে থেকে ফুটবল খেললে তুই আর আস্ত থাকবি না।বেয়াদব কোথাকার।
মাশরাফি কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেল।মা ছেলের কষ্ট বুঝলেন।কিন্তু তাকে সান্ত্বনা দেয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
অবশেষে রাবেয়া বানু মাশরাফিকে বললেন, “তোর যখন সামনে বড় প্রতিযোগিতা আছেই,তখন তো প্রাকটিস করাটা দরকার।তুই করিস প্রাকটিস।কিন্তু সন্ধ্যা ছয়টার আগে বাসায় ফিরে আসবি।তাহলে তোর বাবা আর কিছু বুঝতে পারবে না।আর এই প্রতিযোগিতার শেষে লেখাপড়ায় বেশি সময় দিস বাবা।পরিক্ষায়ও তো পাশ করা দরকার”।
মাশরাফি চুপ করে রইলো।


পরদিন থেকে মায়ের কথামতই সব চললো।মাশরাফি অল্প প্রাকটিস করে ছয়টার মধ্যেই বাসায় ফিরে আসে।রফিক সাহেব কিছু বুঝতে পারেন না।কিন্তু ঢাকার টুর্নামেন্ট! সেটা খেলতে ঢাকায় গেলে তো বাবা কিছুতেই মানবেন না।যেতে দেবেন না কিছুতেই।কালকেই যেতে হবে টিমের সাথে ঢাকায়।বাবাকে এখনো সে ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি।মা অবশ্য জানে বিষয়টা।কিন্তু মা বাবাকে বলতে গেলে অনেক কথা শুনবেন।তাই মা কে দিয়ে মাশরাফি বলাতে পারবে না।সবমিলিয়ে চিন্তায় সে অস্থির।কি করবে কি না করবে ভেবে দু’চোখের পাতা এক হচ্ছেনা।কি করা যায় তা ভাবতে ভাবতে সারারাত মাশরাফির ঘুম হলো না।প্রায় ভোর হয়ে এসেছে।এমন সময় সে সিদ্ধান্ত নিলো কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবে।যে কথা সেই কাজ।জামাকাপড় আর কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।
সকালে জানাজানি হলো মাশরাফি নেই।পুরো দিনটা তার অপেক্ষা করা হলো।তবুও মাশরাফি ফিরলো না।এবার রাবেয়া বানু মুখ খুললেন।স্বামীকে বলে দিলেন যে মাশরাফি টুর্নামেন্ট খেলতে ঢাকায় গেছে।টুর্নামেন্ট শেষ হলে আবার চলে আসবে।রফিক সাহেব সোফায় বসে পড়লেন।

এক মাস কেটে গেল।এক রাতে মাশরাফি বাসায় ফিরে এলো।বাবা মা দুজনে তখন বসার ঘরেই বসে ছিলেন।মা ছুটে গেলেন মাশরাফির কাছে।আদর করতে লাগলেন ছেলেকে।বাবা উঠে দাঁড়িয়েছেন।কিছু একটা বলতে যাবেন এমন সময় মাশরাফি তাকে সালাম করলো।ব্যাগ থেকে দশ হাজার টাকা বের করে বাবার হাতে দিলো।
-বাবা,আমার নিজের ইনকাম।
মা বললেন:
-তুই টুর্নামেন্টে জিতেছিস,বাবা! সেরা খেলোয়াড় হয়েছিস নিশ্চই?তাই এতগুলো টাকা পেয়েছিস!
বাবার মুখে এবার হাসি ফুটেছে। “সাব্বাশ,মাশরাফি! তুই কাউকে কিছু না বলে চলে গেছিস শুনে আমার রাগ হয়েছিল ঠিকই।কিন্তু তুই আজ বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিস।জিতে ফিরেছিস।আমার গর্ব হচ্ছে,বাবা।”- এই বলে রফিক সাহেব মাশরাফিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।তারপর বললেন, “যা বাবা ঘরে যা।হাত মুখ ধুয়ে নে।একসাথে খাব”
এই বলে তিনি নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছেন,এমন সময় মাশরাফি তাকে ডাকলো:
-দাঁড়াও,বাবা।
-হ্যাঁ…
-এই টাকাগুলো আমি ফুটবল খেলে পাইনি।
-তাহলে?
-চাকরি করে পেয়েছি।
-মানে?কিসের চাকরি?
-দারোয়ানের।
-মানে টা কি?তুই না ঢাকায় গেলি ফুটবল খেলতে?
-আমার ঢাকায় গেছিলাম এটা ঠিক।কিন্তু ফুটবল খেলতে না,বাবা।এই একমাস ঢাকায় আমি দারোয়ানের চাকরি করে এই টাকাটা পেয়েছি।
মা-বাবা দুজনে অবাক হয়ে মাশরাফির দিকে তাকিয়ে আছে।
-বাবা,আমার ফুটবল খেলা তুমি কোনোদিনও পছন্দ করোনি।কিন্তু আজ যখন জানলে আমি ফুটবল খেলে টাকাগুলো পেয়েছি তখন তো টাকাকে অপছন্দ করলে না।ফুটবলের টাকাকে সহ্য করা যায়,কিন্তু ফুটবলকে না,তাইনা বাবা?
-ইয়ে…মানে…
-বাবা,ফুটবল আমার ভালোবাসা।আমার নেশা।সেই নেশাকে পেশা হিসেবে নিলে সমস্যা কি,বাবা?
-ভালোবাসাটাই তো সব না।ফুটবল খেলে কয় টাকা কামাবি?সুখে থাকতে পারবি না।
-কিন্তু ফুটবল ছাড়লে আমি শান্তিতে থাকতে পারবনা।
-টাকাটা দরকার,মাশরাফি।
-আত্মার শান্তিটা আরো বেশি দরকার,বাবা। ফুটবল খেলে আমি হয়তো খুব বেশি টাকা নাও কামাতে পারি।কিন্তু আমি ভালো থাকব।বিশ্বাস করো।
বাবা চুপ করে আছেন।তার চোখ স্থির।রাবেয়া বানু কান্না করছেন।

পরেরদিন সকাল।মাশরাফি ঘুম থেকে উঠে দেখে বাবা তার জন্য ঐ দশহাজার টাকা থেকে খরচ করে ফুটবল,বুটসহ আরও অনেক প্রাকটিসের জিনিসপাতি কিনে এনেছেন।মাশরাফি অসম্ভব খুশি হলো।বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে সে।আর ভাবছে-সেদিন রাতে ফুটবল টুর্নামেন্টে না গিয়ে চাকরির খোঁজে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা তার ঠিক ছিল।

©দীপা সিকদার জ্যোতি

Leave a Comment