দুই বছর আগে দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ছিল ৬৯৯ কোটি টাকা। বকেয়া পরিশোধে দফায় দফায় আন্তমন্ত্রণালয়ের সভা, চিঠি চালাচালি হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায়নি। বর্তমানে এই বকেয়া বিলের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪৫ কোটি টাকার বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগ ও স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরেই কোটি কোটি টাকার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়ে রয়েছে। মাঝেমধ্যে কিছু পুরোনো বকেয়া বিল পরিশোধ করা হয়। বকেয়া থাকায় কিছু পৌরসভায় নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার মতো ঘটনাও ঘটছে। তবে চলতি বিল বকেয়া থাকার পরিমাণ কমে আসছে।
ঝিনাইদহের মহেশপুর পৌরসভার বিদ্যুৎ বিল বকেয়া দুই কোটি টাকার বেশি। বিল বকেয়া থাকায় নতুন কোনো সংযোগ দেওয়া হচ্ছে না। পৌর কর্তৃপক্ষ পাইপলাইনের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহে প্রায় ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই বছর আগে একটি শোধনাগারের নির্মাণকাজ শেষ করেছে। বিদ্যুৎ–সংযোগ না পাওয়ায় শোধনাগারটি চালু করা যাচ্ছে না। এ কারণে পৌরবাসীর বিশুদ্ধ পানির চাহিদা মিটছে না। চাঁদপুর পৌরসভার বিল বকেয়া ২১ কোটি টাকার বেশি। এই পৌরসভার সাবেক মেয়র নাছির উদ্দিন আহমেদ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি দায়িত্বে ছিলেন ১৫ বছর। বকেয়া বিলের বড় অংশই তাঁর আমলের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সম্প্রতি নাছির উদ্দিন রংপুর ডেইলীকে বলেন, ‘বকেয়া কেন ছিল, সেটার জবাব আপনাকে দেব না। আমি তো দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছি। এসব বিষয়ে এখন আর কোনো কথা বলতে চাই না।’
এই পৌরসভার বর্তমান মেয়র জিল্লুর রহমান ১১ মাস আগে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা ও মানবসম্পদবিষয়ক সম্পাদক। রংপুর ডেইলীকে তিনি বলেন, বিদ্যুতের মিটার পোস্টপেইড ছিল। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর শুধু পানি শোধনাগার ছাড়া সড়কবাতি, নিজস্ব স্থাপনার সব মিটার প্রিপেইড করা হয়েছে। বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে কথা হয়েছে। কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে। দুই বছর আগে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের বকেয়ার বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ ছিল ৫৯ কোটি টাকা। বর্তমানে বকেয়া ৭৮ কোটি টাকার বেশি। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন রংপুর ডেইলীকে বলেন, বিলুপ্ত ময়মনসিংহ পৌরসভার বকেয়াই বেশি। সিটি করপোরেশন সব ডিজিটাল মিটার বসিয়েছে। করপোরেশনের চলতি বিল বেশি বকেয়া নেই। আগের বিল সমন্বয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বকেয়া বিল পরিশোধ করা হবে। নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৯ সালের নভেম্বরে বকেয়া বিলের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে স্থানীয় সরকার বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়। ওই সময় দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর কাছে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থার বকেয়া পাওনা ছিল ৬৯৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। এসব বকেয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চিঠিতে অনুরোধ করা হয়।
এ চিঠির পর স্থানীয় সরকার বিভাগের পক্ষ থেকে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোর বকেয়া বিলের বিষয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়। পৌরসভার বকেয়া বিল ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পৌর মেয়রদের সঙ্গে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর বৈঠকেও বকেয়া বিল পরিশোধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে চিঠি চালাচালি, আন্তমন্ত্রণালয় সভাতেও বকেয়া আদায়ে খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। বিদ্যুৎ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোর কাছে বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলোর বকেয়ার পরিমাণ ছিল ৭৪৫ কোটি টাকার বেশি। জুলাইয়ের পর এই বকেয়ার পরিমাণ আরও বেড়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব (নগর উন্নয়ন) সায়লা ফারজানা রংপুর ডেইলীকে বলেন, ‘এসব বকেয়া বিল অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভার সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের দাবিদাওয়া নিয়ে যদি কোনো সমস্যা থাকে, সেটা স্থানীয় পর্যায়েই মেটাতে হবে। যাদের বিল বকেয়া, তাদের নানাভাবে চাপে রাখা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকলে নতুন প্রকল্পের বরাদ্দ দেওয়া হবে না।’
আগের বকেয়ার দায় নিতে চান না মেয়ররা
পাবনা পৌরসভার প্রায় ১৫ কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া। এই পৌরসভায় তিন মেয়াদে মেয়র ছিলেন জেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল হাসান। গত বছর তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। বর্তমান মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান দায়িত্ব নিয়েছেন ৯ মাস হলো। তিনি জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি। শরীফ উদ্দিন রংপুর ডেইলীকে বলেন, আগের মেয়র টানা ১৭ বছর দায়িত্বে ছিলেন। তাঁর আমলেই অধিকাংশ বিল বকেয়া পড়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার সময় বকেয়া বিলের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সাবেক মেয়র কোনো জবাব দিতে পারেননি। বর্তমান মেয়াদে (শরীফ উদ্দিনের সময়ে) কোনো বিল বকেয়া নেই।
পৌরসভার মেয়ররা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একজন মেয়র তাঁর মেয়াদ শেষে বিল বকেয়া রেখে গেছেন। নতুন মেয়র দায়িত্ব নিয়ে চলতি বিল পরিশোধ করেন; কিন্তু আগের মেয়রের বকেয়া বিলের দায় নিতে চান না। তাতে ওই বিল বকেয়াই থেকে যাচ্ছে। মেয়রদের দাবি, পৌরসভার সীমিত আয়ে আগের বকেয়া পরিশোধ সম্ভব নয়। পৌর মেয়রদের সংগঠন মিউনিসিপ্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ম্যাব) গত ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে এক সভা করেছে। সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। মেয়রদের পক্ষ থেকে পৌরসভার সক্ষমতা বাড়াতে সভায় ৩৫ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে দুটি দাবি ছিল বিদ্যুৎ বিল–সংশ্লিষ্ট। মেয়ররা বলছেন, বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের জন্য সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলে পানি সরবরাহ ও সড়কবাতির মতো জরুরি সেবা দেওয়া বিঘ্নিত হয়। পৌরসভার বিদ্যুৎ বিল বাণিজ্যিক হারের বদলে আবাসিক হারে ধার্য করা প্রয়োজন। পৌরসভার রাস্তায় স্থাপিত বৈদ্যুতিক খুঁটির জন্য কর নির্ধারণ করতে হবে। তাঁরা বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়ারও দাবি জানান।
বেশি বকেয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটির
দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের কাছে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের পরিমাণ ৪৬৮ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি বকেয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি)। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ডিএসসিসির কাছে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) বকেয়ার পরিমাণ ছিল ১০৬ কোটি টাকার বেশি। ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, আন্তমন্ত্রণালয় সভা করা হয়েছে। দক্ষিণ সিটির মেয়রের সঙ্গে সরাসরি দেখা করেও বিলের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তাঁরা পরিশোধ করবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন। ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুগ যুগ ধরে বিল বকেয়া ছিল। গত অর্থবছরের প্রায় ২০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এবারও বাজেটে দুটি ভাগ করা হয়েছে। চলতি বিলের পাশাপাশি বকেয়াও কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে। দু-তিন বছর পর আর কোনো বকেয়া থাকবে না।’ বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন রংপুর ডেইলীকে বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বকেয়া স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। যতটুকু বকেয়া আদায় হয়, তার চেয়ে বেশি বকেয়া পড়ে যায়। বকেয়া আদায়ে বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে বলে আশা করা যায়।