‘শেষ রাত্রির গল্পগুলো’ বইয়ের রিভিউ

“নিঝুম নিস্তব্ধ রাতে ঘুমিয়েছে শহর,
প্রণয়ের আলাপনে নিষ্পন্ন রাত্রির শেষ প্রহর।”

ঘোর অমাবস্যা কিংবা অঘোর পূর্ণিমা। নিঃসঙ্গতার অমানিশায় ভরাডুবি খেতে খেতে মুদিত চোখে নেমে এসেছিল একরাশ তন্দ্রা। সহস্র অভিযোগ, এন্তার আক্ষেপ আর এক-আকাশ ভালোবাসার কথা হয়নি-কো ব্যক্ত করা।

প্রভুর প্রেমে ব্যাকুল এই হৃদয় এক মুহূর্তও আর থাকতে চায় না কোমল বিছানার জঠরে। অবসন্ন শরীরটা আড়মোড়া ভেঙ্গে নেমে গেল মালিকের সামনে দাঁড়াবার প্রস্তুতি নিতে। খানিক বাদে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলে, কৌমুদীরা হুড়মুড়িয়ে নেমে এলো। তাদের হাস্যোজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে শুরু হয়ে যায় এক গভীর কথোপকথন।

রবের ভালোবাসায় রাত জাগানিয়া কিছু গল্প যদি আমাদের করে তোলে আরো উদ্বুদ্ধ, আরো উদ্দীপ্ত; তবে কেমন হয় বলুন তো?

বলছিলাম সবুজ কবি আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীব রচিত “শেষরাত্রির গল্পগুলো” বইটির কথা। এই বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে প্রভু প্রেমের টুকরো টুকরো গল্প, গোটাকতক কবিতা আর এক চিলতে কাব্য মেশানো লেখক-পাঠকের বাঙময় আলাপন।

◑বইয়ের বিষয়বস্তু:

‘শেষরাত্রির গল্পগুলো’ নাম দেখেই মনে হতে পারে বইটি কোনো গল্পগ্রন্থ। কিন্তু আদতে তা নয়। লেখকের মতে, গল্পের আসর। যে আসরে লেখক ও পাঠক গল্প করবেন। গল্প করতে করতেই চিন্তা-প্রতিচিন্তায় ঋদ্ধ হবেন।

বইটি মূলত লেখকের ব্যক্তিজীবন ঘনিষ্ঠ বেশ কিছু গল্পের সমাহার। জীবন থেকে নেয়া ছোট-বড় অভিজ্ঞতা, ভাবনা ও অনুভূতি এখানে মূর্ত হয়েছে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে। এছাড়াও রয়েছে একরাশ স্বপ্ন,স্বপ্নপূরনের পথপরিক্রমা, রবকে কাছে পাওয়ার আকুলতা, নবীজি ﷺ এর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা এবং শিক্ষণীয় কিছু দিনলিপি। সবগুলো প্রবন্ধগল্পই যেন পাঠকদের জন্য একেকটি অপেক্ষমান চমক।

◑যেভাবে সাজানো হয়েছে বইটি:

১৪০ পাতার ২৮টি আকর্ষণীয় শিরোনামে সাজানো হয়েছে মূল্যবান এ বইটি। ‘গল্পকারের অল্প কথা’ শিরোনামে লেখক পুরো বই সম্পর্কে আংশিক ধারণা দিয়েছেন। এরপর তিনি গল্পের আসরে প্রবেশ করেছেন ‘শেষরাত্রির গল্প’ দিয়ে।

বইটিতে আছে ‘আক্ষেপের গল্প’, ‘পরীক্ষার গল্প’ নামক দুইটি রিমাইন্ডারমূলক গল্প। ‘আত্মকথন’, ‘একটি দিনলিপি অথবা কুকুর উপাখ্যান’, ‘রোজনামচার দ্বিতীয় পাঠ’, ‘সপ্তাহান্তের দিনলিপি’ এর মতো আছে কিছু রোজনামা।

আরো আছে আলোকবর্তিকার ন্যায় কিছু গল্প। এগুলো হলো: ‘পারঘাটা পার হলে’, ‘তিনি এক মজার শিক্ষক’, ‘কল্পকথার গল্প নয়’, ‘ফিরদাউসের ফুল বাগানে আমি হবো পাখি’।

পাপ, পঙ্কিলতা, কদর্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করার হাতিয়ারের যোগানদার হলো, ‘আমি নিষ্পাপ হতে চাই’ গল্পটি।

দাম্পত্য জীবনের রসবোধ তুলে ধরা হয়েছে, ‘বিয়ের কবিতা: জীবনের কবিতা’, ‘খুনসুটির গল্প’ এর মাঝে। ‘বিষমাখা পুষ্প’ গল্পটির মাঝে পাওয়া যায় বিশুদ্ধ নিয়তের দীক্ষা।

একটি স্বপ্নের বেড়ে উঠার গল্প’, ‘স্বপ্ন যখন পৌঁছে গেলো মঞ্জিলে’ আর ‘স্বপ্নের উড়াউড়ি,স্বপ্নের অবশেষ’ শীর্ষক ধারাবাহিক তিনটি লেখায় জড়িয়ে আছে লেখকের হেজায সফরের এক আবেগোপাখ্যান।

‘তিনটি ব্যামো : ত্রিফলা প্রতিষেধক’ গল্পে ত্বালিবুল ইলম তথা ‘student of knowledge’ যারা, লেখক তাদের তিনটি সমস্যার সমাধান দিয়েছেন তিনটি কবিতা কাব্যানুবাদের মাধ্যমে।

‘তোমাকে ভালোবাসি না, আম্মু’ গল্পের আসরে লেখক মায়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসার পরিমাণ এক সমুদ্র বাড়িয়ে দিয়েছেন।

বইটি শেষ হয়েছে ‘পিপাসার গল্প প্রথম সংস্করণ অথবা ঈর্ষার গল্প দ্বিতীয় সংস্করণ’ এই শিরোনামে। এরপর তিনি তথ্যসূত্রের গ্রন্থপরিচিতির মাধ্যমে কলম থামিয়ে এই বইয়ের কার্যসমাধা করেছেন।

◑বইটি যাদের জন্য:

তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে যারা উচ্ছ্বাসিত, বিশ্বাসী চেতনা যারা লালন করেন, শুদ্ধাচারী প্রাণনে যারা চেষ্টারত, যারা এক আকাশ স্বপ্ন ছোঁয়ার তাগিদে সিঁড়ি নির্মাণ করছে – বইটি মূলত তাদের জন্যই। এছাড়াও যে কোনো বয়সের পাঠক বইটি থেকে শিক্ষা নিতে পারবেন। পাশাপাশি নিজেদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এভাবে ভাবতে সহায়তা করতে পারবেন।

◑ভালোলাগা-মন্দলাগা:

ভালোলাগার অনেক কিছুই আছে বইটিতে। সংক্ষেপে বলতে গেলে :

• মনোরম প্রচ্ছদ।
• পোক্ত বাইন্ডিং।
• মানসম্মত কাগজ।
• উৎকৃষ্ট সাহিত্যমান।
• সালাফদের মহামূল্যবান উক্তি এবং ঘটনা।
• গল্পের আসরে পাঠকের সাথে লেখকের আন্তরিকতার যথার্থ উপস্থাপন।
• আত্ন-উন্নয়নের কার্যকরী কিছু টেকনিক।
• বইয়ের শেষে দলিলের পর্যাপ্ততা।
• অনেকগুলো রেফারেন্স বইয়ের সন্ধান।

মন্দলাগার মতো বেশি কিছু পাইনি। একটু বলা যেতে পারে — বইয়ের শিরোনামগুলো একটু এলোমেলো লেগেছে। জীবনবোধের ঘটনাগুলি পর্যায়ক্রমে সাজানো থাকলে বোধ করি পাঠক আরো বেশি তৃপ্তি নিয়ে পড়তে পারতো। রিমাইন্ডারমূলক গল্প, দিনলিপি এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

◑কেন পড়বেন এই বই:

রাতের শেষাংশে স্রষ্টার সাথে একান্ত আলাপনের সুপ্ত ইচ্ছে যদি থেকে থাকে, তবে আপনার সেই ইচ্ছে জাগ্রত করার প্রয়াস হবে ‘শেষরাত্রি গল্পগুলো’ শিরোনামের চারটি গল্প।
এই চারটি গল্পে বিভিন্ন হাদিস, সালাফদের মর্মভেদী কথায় আপনার মুগ্ধতার পারদ এতখানি বেড়ে যাবে যে, আপনি রীতিমত অস্থির হয়ে পড়বেন রাত্রিকালীন নামাজের জন্য। মনে হবে এক্ষুণি নেমে আসুক রাত্রির শেষ প্রহর, আর আমি দাঁড়াই আমার রবের সামনে।

রিমাইন্ডারমূলক গল্পগুলো আপনাকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিবে কিয়ামতের ভয়াবহ দিনের কথা, পাপীদের অবস্থান আর আক্ষেপকারীদের হৃদয়-বিদারক চিৎকার। যেগুলো কুরআনে আল্লাহ পাক সহস্রবার আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন; যাতে আপনি সর্তক হোন।

শিক্ষণীয় দিনলিপিগুলো আপনার বাস্তব জীবনের পথ বাতলে দিবে। আপনাকে শেখাবে মানবিকতা।

পাপ-পঙ্কিলতার সায়রে ডুবে গিয়েও যদি অনুতাপের অশ্রু ঝরান, তবে আপনার রব আপনাকে ফিরিয়ে দিবেন না। এই শিক্ষা পাবেন ‘আমি নিষ্পাপ হতে চাই গল্পে’। এখানে তাওবাকে রাবারের সাথে তুলনা করে সকল পাপ মুছে ফেলার কথা বলা হয়েছে।

সর্বোপরি, বইটি আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে। তরুণ মনে যেসব পঙ্কিলতা পদে পদে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে, লেখক তারই সমাধান দিয়েছেন বইটির পরতে পরতে। বইটি পড়ে মনে হবে, লেখক আমার মনের কথাগুলো জেনেই তার উত্তরগুলো মলাটবদ্ধ করেছেন। সাহিত্যের নেশায় যারা বুঁদ হয়েছে আছেন, তারাও এই বইয়ে সাহিত্যের স্বাদ পাবেন।

◑লেখক সম্পর্কে :

আব্দুল্লাহ মাহমুদ নজীবের জন্ম চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা সদরের ১৯৯৭ ঈসাব্দের ২২ জানুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে স্নাতক সম্মান শেষ করেছেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি বির্তক অঙ্গনেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। কয়েক বছর আগে কাতারে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বির্তকে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এছাড়াও তিনি গবেষণাপত্র উপস্থান করেছিলেন মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামিক সিভিলাইজেশন কনফারেন্সে। কাব্য, অণুকাব্য, প্রবন্ধগল্পের বেশ কিছু বই রচনা করে তিনি পাঠক মহলে নিজের একটি পোক্ত অবস্থান গড়ে নিয়েছেন।

◑ইতিকথা :

জীবনের একটি সুন্দর পরিসমাপ্তি সবারই একান্ত কাম্য। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমরা ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমাদের গন্তব্যস্থলে। সেই স্থানটি কার কেমন হবে আমরা আগে থেকেই জানি না। রঙিন দুনিয়ায় মোহাচ্ছন্ন হলেও মুসলিম জাতির একটাই স্বপ্ন। আর তা হলো, চির শান্তির স্থান জান্নাতে পদার্পণ। লেখকের মতো আমিও আমার অনুভূতি ব্যক্ত করতে চাই তাঁরই রচিত এই অণুকবিতার মধ্য দিয়ে।

“বুকের খাতায় খুব যতনে
একটা স্বপন আঁকি
ফিরদাউসের ফুল বাগানে
আমি হবো পাখি।”

◑এক নজরে বইটি:
————————

• বই : শেষ রাত্রির গল্পগুলো
• লেখক: আবদুল্লাহ মাহমুদ নজীব
• প্রথম প্রকাশ: একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৭
• প্রকাশনী : সঞ্চারী পাবলিকেশন
• পৃষ্ঠাসংখ্যা : ১৪০
• প্রচ্ছদমূল্য : ৩০০/-
• কভার : ফ্ল্যাপসহ পেপারব্যাক
• ধরন : আত্মশুদ্ধিমূলক
• রেটিং : ৭/১০

লেখাঃ মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া।

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *