লিভার সিরোসিস কেন হয়, কীভাবে ঠেকাব

লিভার সিরোসিস রোগ সম্পর্কে অনেকেরই অল্পবিস্তর জানা আছে। এটা যকৃতের জটিল একটি রোগ। এ রোগ একবার হয়ে গেলে নিরাময় করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সে ক্ষেত্রে একমাত্র স্থায়ী সমাধান হতে পারে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা যকৃৎ প্রতিস্থাপন। যকৃৎ প্রতিস্থাপন ব্যয়বহুল চিকিৎসা। শুধু আর্থিক সামর্থ্য থাকলেই হবে না, যকৃৎ দান করার মতো দাতাও লাগবে, আর সেই যকৃৎ ম্যাচিং হতে হবে।তাই চিকিৎসার চেয়ে লিভার সিরোসিস প্রতিরোধই উত্তম। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশে আনুমানিক ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত। সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এর অনেকটা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

যকৃতের কাজ কী
মানুষের পেটের ওপরের অংশের ডান দিকে যকৃতের অবস্থান, যা মানবদেহে বিপাক ক্রিয়া সম্পাদন করে থাকে।খাদ্যের অতিরিক্ত গ্লুকোজ যকৃতে গ্লাইকোজেন হিসেবে সঞ্চিত থাকে, যা পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনে শক্তির জোগান দিতে পারে। যকৃৎ শরীরের অতি প্রয়োজনীয় অ্যালবুমিন এবং অন্যান্য প্রোটিনের মূল জোগানদাতা। রক্ত তরল রাখার বেশ কিছু উপাদান যকৃতে তৈরি হয়। আমাদের শরীরের অনেক দূষিত উপাদান, বর্জ্য, ওষুধের বিপাকজনিত বর্জ্য বের করে দিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে লিভার। কাজেই লিভার সিরোসিস হলে লিভারের সব কাজ ব্যাহত হয়।লিভার সিরোসিস নানা ধরনের উপসর্গ নিয়ে উপস্থিতি জানান দিতে পারে। ক্লান্তি ও দুর্বলতা, অরুচি, ওজন হ্রাস একেবারে প্রাথমিক লক্ষণ। জন্ডিস হতে পারে। কখনো জন্ডিস এত মৃদু হয় যে রুটিন পরীক্ষা–নিরীক্ষায় হঠাৎ লিভার ফাংশন টেস্ট করলে ধরা পড়ে ।


কেন হয় লিভার সিরোসিস
স্বাভাবিক অবস্থায় লিভারের কোষকলা নরম ও মসৃণ। সিরোসিস হলে লিভারের কলাগুলো শক্ত ও দানাদার হয়ে যায়। লিভারের গঠনগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে এবং একসময় অকার্যকর হয়ে পড়ে।
নানা কারণে লিভার সিরোসিস হতে পারে। উন্নত বিশ্বে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ অতিরিক্ত মদ্যপান। আবার অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি এবং হেপাটাইটিস ডি ভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের কারণে সাধারণত মানুষের লিভার সিরোসিস হয়ে থাকে। বাংলাদেশে লিভার সিরোসিসের প্রধান কারণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস।

এ ছাড়া পৃথিবীজুড়ে লিভার সিরোসিসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ফ্যাটি লিভার থেকে সৃষ্ট ন্যাশ (নন অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস)। আমাদের দেশেও ফ্যাটি লিভারের প্রচুর রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এর বাইরে লিভার সিরোসিসের কিছু বিরল কারণের মধ্যে আছে উইলসন ডিজিজ, হেমোক্রোমাটোসিস এবং আলফা-ওয়ান অ্যান্ট্রিপসিন ডেফিসিয়েন্সি।হেপাটাইটিস বি ও সি রক্তবাহিত রোগ। সাধারণত অনিরাপদ রক্ত গ্রহণের মাধ্যমে এগুলো ছড়িয়ে থাকে। তাই রক্ত গ্রহণের প্রয়োজন হলে রক্তদাতার রক্তে হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস আছে কি না, সেটা অবশ্যই দেখে নিতে হবে। পেশাদার রক্তদাতার কাছ থেকে রক্ত নেওয়া যাবে না। একই সুচ-সিরিঞ্জ ব্যবহার করলেও এ দুটি ভাইরাস ছড়াতে পারে। সেলুনের কাঁচি, রেজর ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহার করলেও এসব ভাইরাস ছড়াতে পারে। অনিরাপদ যৌন মিলনও হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সংক্রমণের কারণ।লিভার সিরোসিস অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। লিভার সিরোসিসের কারণগুলো প্রতিহত করা গেলেই তা সম্ভব হবে অ্যালকোহলজনিত সিরোসিস আমাদের দেশে আগে খুব একটা বেশি ছিল না। তবে আজকাল ধীরে ধীরে এর হারও বাড়ছে। ফ্যাটি লিভার ডিজিজের হারও দ্রুত বাড়ছে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চ শর্করা বিশেষ করে ট্রাইগ্লিসারাইড, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস এবং অতিরিক্ত শারীরিক ওজন ফ্যাটি লিভারের অন্যতম কারণ।

লক্ষণ
লিভার সিরোসিস নানা ধরনের উপসর্গ নিয়ে উপস্থিতি জানান দিতে পারে। ক্লান্তি ও দুর্বলতা, অরুচি, ওজন হ্রাস একেবারে প্রাথমিক লক্ষণ। জন্ডিস হতে পারে। কখনো জন্ডিস এত মৃদু হয় যে রুটিন পরীক্ষা–নিরীক্ষায় হঠাৎ লিভার ফাংশন টেস্ট করলে ধরা পড়ে।পরিস্থিতি জটিল হলে পেটে পানি জমে ফুলে যায়, পায়েও পানি আসতে পারে। সিরোসিসের রোগীর রক্তে বিপাকজনিত বর্জ্য জমে যায় বলে মস্তিষ্কে এনকেফালোপ্যাথি হয়, ফলাফলস্বরূপ রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। অনেকেরই রক্তবমি এবং পায়খানার সঙ্গে কালো রক্ত যেতে পারে।লিভার সিরোসিস থেকে ক্রমে লিভারে ক্যানসার হওয়া অস্বাভাবিক নয়। সে ক্ষেত্রে পেটে শক্ত চাকা আর পানি জমে।

চিকিৎসা কী
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা বেশ জটিল। চিকিৎসা হতাশাব্যাঞ্জকও। কারণ, এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কেবল উপসর্গভিত্তিক চিকিৎসা (যেমন পেটের পানি অপসারণ, রক্তবমি রোধ ইত্যাদি) করা হয়। কারণ, এর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা হচ্ছে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা প্রতিস্থাপন, যা কিনা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তা ছাড়া আমাদের দেশে লিভারদাতা পাওয়াও খুবই কঠিন।পেটে বেশি পানি জমলে সুইয়ের মাধ্যমে মাঝেমধ্যে বের করে দিতে হয়। এন্ডোস্কপি করে খাদ্যনালিতে ভ্যারিসেস (ফোলা রক্তনালি, যা থেকে রক্তপাতের ঝুঁকি আছে) থাকলে বিশেষ কিছু পদ্ধতিতে সেগুলো থেকে রক্তপাত বন্ধ করা হয়। সিরোসিসের রোগীদের বিশেষ ধরনের খাদ্যব্যবস্থা দরকার হয়। কোষ্ঠকাঠিন্য হলে এনকেফালোপ্যাথি হয় বলে সব সময় মল নরম রাখার চেষ্টা করতে হয়। পেটের অভ্যন্তরের রক্তনালির রক্তচাপ বেশি থাকে। একে বলে পোর্টাল হাইপারটেনশন। এই রক্তচাপ কমাতে ওষুধ দিতে হয়। তবে বেশির ভাগ ওষুধ যেমন ঘুমের ওষুধ, ব্যথানাশক ইত্যাদি সিরোসিসের রোগীর জন্য ক্ষতিকর।

প্রতিরোধই উত্তম
লিভার সিরোসিস অনেকাংশেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। লিভার সিরোসিসের কারণগুলো প্রতিহত করা গেলেই তা সম্ভব হবে।
হেপাটাইটিস বি ভাইরাস প্রতিরোধে বর্তমানে কার্যকর টিকা আছে। তা ছোট-বড় সবাইকেই নিতে হবে। দেশে সম্প্রসারিত টিকাদান কার্যক্রমে শিশুদের বিনা মূল্যে টিকাটি দেওয়া হয়। বড়দের মধ্যে যাঁরা নেননি, তাঁরা টিকা কিনে দিয়ে দিতে পারেন।নিরাপদ রক্তসঞ্চালন নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। কোনো প্রয়োজনে রক্ত নিতে হলে অবশ্যই নিরাপদ রক্তদাতার রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে। রক্ত কেনাবেচা সম্পূর্ণ বেআইনি ও বিপজ্জনক।ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ, রেজার ইত্যাদি ব্যবহার করতে হবে মাদকাসক্ত যাঁরা শিরায় মাদক গ্রহণ করেন, তাঁদের মধ্যে সিরোসিস হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। কারণ, তাঁরা প্রায়ই একই সিরিঞ্জ কয়েকজন ব্যবহার করে থাকেন। তাই মাদক ও অ্যালকোহল বর্জন করুন।

অনিরাপদ যৌন সংসর্গ এড়িয়ে চলতে হবে।
কেউ হেপাটাইটিস বি বা সি ভাইরাসে সংক্রমিত হলে দেরি না করে পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছ থেকে পরামর্শ ও চিকিৎসা নিতে হবে। বর্তমানে এসব সংক্রমণের কার্যকর চিকিৎসা আছে। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণ থেকেই সিরোসিস হয়ে থাকে।ওজন ও রক্তের শর্করা ও চর্বি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে যেন ফ্যাটি লিভার না হয়। সব ফ্যাটি লিভারই যে সিরোসিসে রূপ নেবে তা নয়, তবে ফ্যাটি লিভার হলে অবশ্যই জীবনাচরণ পরিবর্তনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে আনা উচিত।

Leave a Comment