লিবিয়ায় যেভাবে বাংলাদেশিদের দাস হিসেবে বেচে দেওয়া হচ্ছে

ইতালীয় শহর পালেরমোতে এক বাংলাদেশী যুবক একটি চেয়ারে অস্বস্তিকরভাবে বসে থেকে লিবিয়ায় তার ভয়ানক যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিলেন।২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ১৯ বছর বয়সে আলী (ছদ্মনাম) তার বাবা-মায়ের দোয়া নিয়ে কাজের সন্ধানে একটি ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।এক ‘দালাল’ বা ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে দেখা যোগাযোগ হওয়ার পর সে তাকে উৎসাহিত করেছিল। ওই দালাল আসলে একজন মানব পাচারকারী ছিলেন, যারা ধনী হওয়ার লোভ দেখিয়ে তরুণ বাংলাদেশীদের লিবিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দাস হিসেবে পাচার করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা মক্কেল ধরার জন্য অত্যাধুনিক ফাঁদ পেতে রাখে।

যে দালাল আলীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল সে ক্রমাগত তাকে লিবিয়ায় যেতে উৎসাহিত করেছিল, এমনকি তাকে তার বাড়িতে রাতের খাবারের জন্যও আমন্ত্রণ জানায়।আলী কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠে একটি কসমেটিক্সের দোকানে কাজ করছিলেন। শহরের বাইরে পদ্মা নদীর তীরে একটি গ্রামে থাকা তার পরিবারকে টাকা দিয়ে সহযোগীতা করার চেষ্টা করছিলেন।দালালরা সুযোগের অভাবে থাকা আলীর মতো তরুণদের দারিদ্র থেকে মুক্তির আশাকে পুঁজি করে মানব পাচার করে।
কিন্তু যারা তাদের ফাঁদে পড়ে তাদের মধ্যে খুব কমই জানে যে লিবিয়া নৃশংস গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি দেশ এবং সেখানে যাওয়ার মানে হল দুঃখ, শোষণ এবং দাসত্বের কবলে পড়া।

আলী স্বীকার করেন, ‘লিবিয়া সম্পর্কে আমার কোন ধারণা ছিল না’।ওই দালাল তার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করে তাদের বলে যে তাদের ছেলে লিবিয়ার কারখানায় কাজ করে মাসে ৪০ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারবে।আলীর বাবা-মা দালালকে বলেন যে, ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর মতো টাকা তাদের কাছে নেই। ওই দালাল তখন তাদের কাছে কী সম্পদ রয়েছে তার সন্ধান করতে থাকে। তাদের তিনটি বড় বড় গরু ছিল। দালাল তাদেরকে একটি গরু বিক্রি করে দিতে প্ররোচিত করে।

মুক্তিপণের জন্য আটক
লিবিয়ায় পৌঁছাতে আলীর এক সপ্তাহ লেগেছিল। ঢাকা থেকে বাসে করে ভারতের কলকাতা, তারপর কয়েকটি ফ্লাইটে মুম্বাই, দুবাই এবং কায়রো হয়ে লিবিয়ায়।আলী বলেন, বেনগাজি বিমানবন্দরে নেমে তিনি একটি ‘বিশৃঙ্খল’ শহর দেখতে পান, যেখানে কোনো নিরাপত্তা বা পুলিশ নেই।তাকে তার বাংলাদেশি দালালের স্থানীয় এজেন্টরা একটি কারাগারে নিয়ে যায়, যেখানে তারা তার কাছে থাকা অর্থ কেড়ে নেয় এবং তারপর তাকে মুক্তিপণের জন্য আটকে রাখে।তাকে মুক্ত করার জন্য তার বাবা-মাকে তাদের বাকী দুটি গরুও বিক্রি করতে হয়েছিল।

তার জেলখানা ছিল একটি ছোট কক্ষ, যেখানে কোনো গদি নেই, যেখানে তিনি আরও ১৫ জন বাংলাদেশীর সঙ্গে থাকতেন। যারা মুক্তিপণের টাকা দিতে অক্ষম ছিল তাদের খাবার দেওয়া হতো না এবং দূর্ব্যবহার ও মারধোর করা হত।আলী বলেন, ‘তারা আমার সামনেই একবার একজনকে মারধর করে, যার কুঁচকি থেকে রক্ত ঝরছিল। তারা তাকে সুস্থ হতে সাহায্য করেনি বা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি’।সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লিবিয়ায় পাচারকারীদের হাতে আটক বাংলাদেশীদের জন্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়েছে।২০২০ সালের মে মাসে রাজধানী ত্রিপোলির কাছে মিজদাহের একটি গুদামে ৩০ জন অভিবাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। যাদের মধ্যে ২৬ জন ছিল বাংলাদেশি।বেঁচে যাওয়া একজন বাংলাদেশি বলেছেন যে, তাদের পরিবার মুক্তিপণ দিতে না পারায় তাদের গুলি করে হত্যা হয়েছে।

বিনা বেতনে কাজ করা

অবশেষে যখন আলীকে মুক্তি দেওয়া হয় তখন তাকে একটি টাইল কারখানায় কাজ করার জন্য ত্রিপোলি যাওয়ার আগে বেনগাজিতে একটি জল-বোতলজাত করার প্ল্যান্টে তিন মাস ধরে ওই পাচারকারীদের জন্য কাজ করতে হয়।
বর্তমানে লিবিয়ায় আনুমানিক ২০ হাজার বাংলাদেশী নাগরিকদের অনেকের মতোই তার সঙ্গেও খারাপ আচরণ করা হয়েছিল, বেতন দেওয়া হয়নি এবং অসহনীয় পরিস্থিতিতে বসবাস করতে বাধ্য করা হয়েছিল।আমরা কাজ বন্ধ করলে আমাদের মারধর করা হতো, লাথি মেরে মাটিতে ফেলে দেওয়া হতো। একবার আমাদের মধ্যে একজন একটা টালি ভেঙ্গে ফেলল, তখন একজন লোক এসে লোকটিকে লাথি মারল,’ আলি বলেন।

আলী তার টাইল ফ্যাক্টরির মালিকের সঙ্গে তালাবন্দী ঘরে বসবাস করতেন।আলী বলেন, ‘মালিক আমাদের কাজে নিয়ে যেতেন এবং তারপরে আমাদের কাজ শেষ হলে ফের বাড়িতে নিয়ে যেতেন। সেখানে দুজন পাহারাদার আমাদের দেখে রাখত। আমরা কাজের জন্য বেতন পাইনি, পর্যাপ্ত খাবারও দেওয়া হত না। তাই আমরা পালিয়ে যেতে চেয়েছিলাম’।আমাদের মধ্যে একজন পালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দ্বিতীয় তলা থেকে পড়ে গেলে তার পা ভেঙে যায়’।কয়েকবার পালানোর চেষ্টা করে ব্যার্থ হওয়ার পর একজন দয়ালু লিবিয়ান আলীকে একটি মসজিদে আশ্রয় পেতে সাহায্য করে। তিনি অনুভব করেন যে তার একমাত্র উপায় হল আবার পাচারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা। এবার ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে যাওয়া।

সাগরে হাঙ্গরের কবলে

তার বাবা-মা ফের তাকে টাকা পাঠায়। বাংলাদেশ থেকে ইতালি পর্যন্ত পুরো যাত্রায় তার পরিবারের প্রায় ৪ হাজার ডলার বা সাড়ে তিন লাখ টাকা খরচ হয়। এর ফলে তারা দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ফাঁদে আটকা পড়েন।গত বছরের জুলাই মাসে ডিঙ্গি নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে আরও ৭৯ জন অভিবাসীর সঙ্গে আলী আরেকটি ভয়ঙ্কর অগ্নিপরীক্ষায় পড়েন।আলী বলেন, ‘পুরো দুই দিন ধরে আমরা শুধু সমুদ্রে ভেসে ছিলাম। কোনো ভূমির দেখা পাইনি। তারপরে আমরা দূর থেকে দুটি হাঙর দেখলাম, তখন কেউ কেউ বলল যে তারা আমাদের খেতে আসছে। আমি ভেবেছিলাম, ‘আমাদের জীবন শেষ!’

অবশেষে ইতালির কোস্টগার্ড তাদের উদ্ধার করে ইতালির ল্যাম্পেডুসা দ্বীপে নিয়ে যায়। সেখান থেকে এরপর তাদের সিসিলিতে স্থানান্তর করা হয়।আলী এখন সিসিলির রাজধানী পালেরমোর উপকণ্ঠে একটি বড় অভিবাসী শিবিরে থাকেন। নাইজেরিয়া, গাম্বিয়া এবং সেনেগালের মতো জায়গা থেকে আসা অন্যান্য তরুণ অভিবাসীরাও সেখানে আছে।আলী বলেছিলেন যে, লিবিয়ায় বাংলাদেশি এবং অন্যান্য জাতির লোকদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ করার সুযোগ ছিল না। পাচারকারীদের পরিচালিত কারাগারগুলো গোত্রীয় ভিত্তিতে বিভক্ত ছিল।

সুশি স্বপ্ন

আলী কিছু অস্থায়ী কাগজপত্র পেয়েছেন যা দিয়ে তিনি ইতালিতে কাজ করার করতে পারছেন। কিন্তু মানবিক সুরক্ষার জন্য তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, যার বিরুদ্ধে তিনি আবার আবেদন করছেন।তিনি পালেরমোর নতুন সাংস্কৃতিক পরিবেশের সঙ্গেও খাপ খাইয়ে নিচ্ছেন এবং এখন একটি সুশি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। আফ্রিকান অভিবাসীরাও সেখানে কাজ করছেন।তার কোনো দর কষাকষি করার ক্ষমতা না থাকায় তাকে একজন সিসিলিয়ান নাগরিকের চেয়ে অনেক কম বেতন দেওয়া হচ্ছে। সপ্তাহে ছয় দিন দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে মাসে প্রায় ৮৭০ ডলার উপার্জন করেন। কিন্তু তার মধ্যে তাকে ৫৭০ ডলারই দেশে ফেরত পাঠাতে হয় পরিবারের ঋণ শোধ করার জন্য।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পালেরমোতে সুশির ক্রেজ দেখা দিয়েছে। তবে শহরে জাপানিদের সংখ্যা কম থাকায় চীনা রেস্তোরাঁগুলো সুশি ব্যবসায় ঢুকে পড়েছে।আলী এখানে আসার আগে কখনও সুশির কথা শুনেননি। তবে তিনি ধীরে ধীরে কাঁচা মাছের স্বাদ উপভোগ করতে শুরু করেছেন,এবং এটি তার মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলছে।আলী বলেন, ‘আমি সুশি বানানো সম্পূর্ণরূপে শিখতে চাই এবং ইতালিয়ান ভাষাও শিখতে চাই’।

সিসিলিতে থাকা আরেক বাংলাদেশি জানান কীভাবে তিনি ১৫ বছর বয়সে ২০১৬ সালে দালালদের মাধ্যমে সেদেশে যেতে পেরেছিলেন।সিসিলিতে থাকা ওই তরুণ বলেন, ‘আমার পরিবার চেয়েছিল যে আমি বিদেশে যাই। কিন্তু নাবালক হওয়ায় আমি বিদেশ যেতে পারছিলাম না। তাই তারা আমার বয়স বাড়িয়ে জাল পাসপোর্ট বানাতে দালালকে টাকা দেয়’। দালালরা জাল ডকুমেন্টে তার বয়স ২১ বছর বলে উল্লেখ করে তাকে সিসিলিতে পাঠিয়ে দেয়।

Leave a Comment