রাজধানীবাসী যানজটে নাকাল

রাজধানী ঢাকায় যানবাহনের জট চরম আকার ধারণ করেছে। মহানগরীতে যানজট নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হলেও দিনদিন তা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তাতেই থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের। যান চলাচলে চরম বিশৃঙ্খলা, অব্যবস্থাপনা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও রাস্তা সরু হওয়াই যানজটের মূল কারণ। ১০ বছর আগেও ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার গতিতে চলত গাড়ি। এখন তা কমে চলে এসেছে সাত কিলোমিটারে, যা পায়ে হাঁটার গতির চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে কয়েক বছর পরে রাজধানী ঢাকায় হেঁটে চলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।

যান চলাচলে বিশৃঙ্খলার কারণ অনেক। সারা বিশ্বের রাজধানীগুলোতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩০ থেকে ৪০ জন বসবাস করে। অথচ ঢাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ৪০০ জন বসবাস করছে। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর রাজধানীতে ২৫ ভাগ রাস্তা থাকে। কিন্তু ঢাকাতে রাস্তা আছে ১০ ভাগ। বিশ্বের অন্য দেশের রাজধানীতে যানজট দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত থাকে। এরপর আর থাকে না। কিন্তু ঢাকাকে দিন-রাত প্রায় ২৪ ঘণ্টা যানজট থাকে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তারা বলেন, প্রতিদিন ঢাকার আশপাশ থেকে ৫ লাখ মানুষ রাজধানীতে আসা-যাওয়া করে। আর বছরে ৫ লাখ মানুষ থাকতে আসে। অর্থাত রাজধানীতে বছরে নতুন করে ৫ লাখ মানুষ যুক্ত হয়। রাস্তায় প্রাইভেট কারের চলাচলই বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার অফিস-আদালত বিকেন্দ্রীকরণ করা উচিত। এতে ঢাকায় মানুষের আসা-যাওয়া কমে যাবে। রাজধানীর রাস্তায় ঘন ঘন খোঁড়াখুঁড়িও যানজটের আরেকটি কারণ। শুধু লালবাগ এলাকাতেই একসঙ্গে ২৬ জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় এভাবে বছর জুড়েই খোঁড়াখুঁড়ি চলে। নির্মাণকাজের অব্যবস্থাপনায় জনগণের নাভিশ্বাস অবস্থা। অপরদিকে রাস্তায় যে গণপরিবহন চলাচল করে সেগুলো মূলত শ্রমিকরা লিজ নেন। এ কারণে ট্রিপ বেশি মারতে বাসগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা চলে। চালকরা প্রায়ই ট্রাফিক আইনকানুন লঙ্ঘন করে থাকেন। আর ট্রাফিক আইন না মানার কারণে জরিমানা করা হলে তা গুনতে হয় যানবাহনের মালিককে। কারণ গাড়ির কাগজ মালিকের নামে। চালককে সরাসরি জরিমানা করা গেলে ভালো হতো বলে মনে করেন অনেকেই। নগরীতে অবৈধ রিকশাও আছে ১০ লাখের ওপরে।

রাজধানীর বেশির ভাগ গণপরিবহনের ফিটনেস নেই। বিআরটিএ বলছে, রাজধানীতে দেড় হাজার বাসের ফিটনেস নেই। কখনো দেখা যায়—পুলিশ ১০টা বাস ধরলে ৯টারই ফিটনেস নেই। এত বাস ধরে আটকালে হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগে পড়বে। এ কারণে অনেক সময় যানবাহনের ফিটনেসের বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করতে হয় ট্রাফিক পুলিশকে।

ঢাকায় গণপরিবহনের মধ্যে ৮৭ শতাংশ বাস-মিনিবাসই ট্রাফিক আইন মানে না। প্রতিদিন নতুন করে প্রায় ৫০টি গাড়ি রাস্তায় নামছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী কয়েক বছর পরে গাড়ি রেখে হেঁটে চলতে হবে। বিআরটিএর তথ্য মতে, সারা দেশে ৩১ লাখ যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন আছে। এর মধ্যে ঢাকায় ১০ লাখ। অন্য এক গবেষণায় দেখা গেছে, এই সংখ্যা অর্ধকোটির ওপরে।

বিশ্ব ব্যাংকের এক রিপোর্টে দেখা যায়, রাজধানী ঢাকায় গড়ে প্রতি ঘণ্টায় গণপরিবহনের গতিবেগ ১০ বছর আগে ছিল ২১ কিলোমিটার। এখন ঘণ্টায় গতিবেগ ৭ কিলোমিটার। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ রাজধানী ঢাকায় প্রতি ঘণ্টায় যানবাহনের গতিবেগ ৪ কিলোমিটারে নেমে আসবে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক গবেষণায় দেখা যায়, ট্রাফিক যানজটের কারণে যাত্রীদের গুরুতর শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। মেজাজ খিটখিটে হয়, অস্থিরতা দেখা দেয়। আরেক তথ্য মতে, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় দুর্বল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় যত্রতত্র গাড়ি রেখে দেয়। যেসব গাড়ির লাইসেন্স নেই, সেগুলো রাস্তায় নামতে দেয় নির্দিষ্ট মাসোহারার বিনিময়ে। প্রতি মাসে এই মাসোহারা দিতে হয় প্রায় শত কোটি টাকা। যে টাকার ভাগ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের পকেটেও যায়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, যানজট নিরসন করতে হলে ঢাকা শহরের রাস্তা বাড়াতে হবে। ঢাকার অফিস আদালত বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এছাড়া সড়কের সংস্কার কাজ শেষ হলে যানজট অনেকাংশ কমে যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি জানালেন, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় নতুন ৩ হাজার বাস নামানো হচ্ছে।

Leave a Comment