রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,পবিত্র রমজান মাস তাকওয়ার মাস। তাকওয়া অর্জনই রমজানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। হাদিসে উল্লেখ আছে যে, রমজানের এক সময়ের জন্য ৭০ বা তার বেশি নেকী পাওয়া যায়।রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , রমজান মাস আল্লাহর এক বিশেষ নেয়ামত। পুরস্কার উপার্জনের মৌসুম। রহমত, বরকত ও নাজাতের মাস- রমজান মাস এ মাসেই কুরআন নাজিল হয়েছে। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,কোরআনে বলা হয়েছে: “রমজান মাস, যাতে কোরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক এবং হেদায়েতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী” [সূরা আল-বাকারা:১৮৫]
রমজানে কোন আমল বেশি করবেন, রমজান মাসের ফযিলাত
রমজান মাসের ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “রমজান – বরকতময় মাস তোমার দরজায় এসেছে।” আল্লাহ তোমাদের জন্য পুরো মাস রোজা ফরজ করেছেন।রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , এ মাসে জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ মাসে শয়তানদের শৃঙ্খলিত করা হয়। এ মাসে আল্লাহ একটি রাত দান করেছেন, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন,যে ব্যক্তি এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত, সে (মহান কল্যাণ থেকে) বঞ্চিত হয়।” [সুনান আত-তিরমিযী:৬৮৩]
পবিত্র রমজানের সর্বোত্তম আমল
রমজানের রোজা ফরজ এবং ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসে আসবে সে যেন রোজা রাখে। (সূরা বাকারা:১৮৫)। রমজানের রোজা এতটাই ফজিলতপূর্ণ যে,সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে এর প্রতিদান ঘোষণা করেছেন। (সহীহ মুসলিম:১১৫১/১৬৪; মুসনাদে আহমদ: ৯৭১৪; ইবনে মাজা: ১৬৩৮)
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে রমজান মাসে একটি রোজা ভঙ্গ করবে, সে সারাজীবনের জন্য সেই রোজা পূরণ করতে পারবে না।” (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা: ৯৮৭৮) শুধু তাই নয়, রোজার মাধ্যমে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের তাদের পাপ থেকে মুক্তি দেন।
রমজানের রোজা ফরজ এবং ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি।
হাদিসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে কল্যাণের আশায় রমজানের রোজা রাখে, তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। (সহীহ বুখারীঃ ৩৮)
পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখা ছাড়াও এমন কিছু আমল রয়েছে যার অনেক ফজিলত রয়েছে। নিচে রমজান মাসের শ্রেষ্ঠ আমল বা নেক আমল সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
নামাজ
আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম উপায় হল সময়মত নামাজ আদায় করা। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে জিজ্ঞেস করা হল- কোন আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়? তিনি বললেন, সময়মত নামাজ আদায় কর। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,আবার জিজ্ঞেস করলেন, তারপর কোনটা? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তাহলে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর পথে জিহাদ)। (বুখারি: ৫২৭)
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরও বলেছেন, “যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নফল আমল করল, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরজ পূরণ করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল, সে যেন অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করল।’ (মেশকাতুল মাসাবিহ: ১৯৬৫)
তাই পবিত্র রমজান মাসে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়তে হবে। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,এ মাসে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা সহজ। তাহাজ্জুদ মহান আল্লাহর কাছে প্রিয় একটি আমল। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পাঠ করা হবে। এটি আপনার অতিরিক্ত দায়িত্ব (নফল)। অচিরেই তোমার পালনকর্তা তোমাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭৯)
অন্যত্র এসেছে,'(এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারাই)যারা তাদের পালনকর্তার সামনে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে রাত কাটায়।’ (সূরা ফুরকান : ৬৪)
তাই পবিত্র রমজান মাসে রাত্রি জাগরণ ও নফল নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আমরা মহান আল্লাহর কাছে প্রিয় হতে পারি।
কোরআন তেলাওয়াত
পবিত্র রমজান মাস কুরআন নাযিলের মাস। যেহেতু এটি কোরআনের মাস,তাই এ মাসে বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করা আমাদের জন্য একটি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পবিত্র রমজান মাসে কুরআন তিলাওয়াতের প্রতি মহানবী (সা.) অধিক গুরুত্ব দিতেন।
বিভিন্ন হাদিস অনুসারে,জিব্রাইল (আ.)রমজানের প্রতি রাতে তার সাথে দেখা করতেন এবং তাকে কোরআন শিক্ষা দিতেন। (নাসাঈঃ ২০৯৫)
তাছাড়া যারা বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াত করবে তাদের পবিত্র কোরআন কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, কুরআন তিলাওয়াত কর। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,কেননা তিনি কিয়ামতের দিন তার পাঠকদের জন্য সুপারিশকারী হিসেবে আসবেন। সূরা আল বাকারা এবং সূরা আল ইমরান দুটি উজ্জ্বল সূরা পাঠ করুন। কিয়ামতের দিন এই দুটি সূরা এমনভাবে আসবে যেন তারা দুটি মেঘ বা দুটি ছায়া অথবা উড়ন্ত পাখির দুটি ঝাঁক যা তাদের পাঠকারীর পক্ষে কথা বলবে। এবং সূরা বাকারা পাঠ করুন। এই সূরা গ্রহণ করা একটি বরকতময় কাজ এবং এটি পরিত্যাগ করা একটি অনুশোচনার কাজ…'(মুসলিম:১৭৫৯)।
তাছাড়া যারা পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন তাদের জন্য মহান আল্লাহ জান্নাতে বিশেষ সম্মান রেখেছেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, (আখেরাতে) যারা কুরআন অধ্যয়ন করে তাদের বলা হবে, কুরআন তেলাওয়াত করতে করতে উপরে উঠতে থাকো। দুনিয়াতে যেমন পড়ুন ধীরে ধীরে পড়ুন। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,কেননা তোমার তিলাওয়াতের শেষ আয়াতে (জান্নাতে) তোমার আবাস হবে। (আবু দাউদ: ১৪৬৪)। তাই আমাদের সকলের উচিত এই পবিত্র মাসে যথাসম্ভব কুরআন তিলাওয়াত করা।
জিকির
জিকির মানে আল্লাহকে স্মরণ করা। জিকির শব্দের উদ্দেশ্য হল যে কোন ইবাদতের মাধ্যমে মহান আল্লাহকে স্মরণ করা। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই, সুতরাং আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে সালাত কায়েম কর”। (সুরা তাহা: ১৪)
যিকিরকারীদের ফজিলত সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে, আল্লাহ তাদের জন্য ক্ষমা ও মহা পুরস্কার প্রস্তুত রেখেছেন। (সূরা আহযাব : ৩৫)
আবু দারদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের সর্বোত্তম আমল সম্পর্কে অবহিত করব না, যা তোমাদের পালনকর্তার কাছে সবচেয়ে পবিত্র, সম্মানের দিক থেকে সর্বোচ্চ, স্বর্ণ ও রৌপ্য দেওয়ার চেয়েও বেশি? দানশীলতা? রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,আপনার শত্রুদের বিরুদ্ধে নেমে তাদের আপনাকে ধ্বংস করতে দেওয়া এবং আপনি তাদের ধ্বংস করা কি ভাল? তারা হ্যাঁ বলল। তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালার জিকির।
মুআয ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, আল্লাহর আযাব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর স্মরণের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। (তিরমিযীঃ ৩৩৭৭)
দোয়া
দোয়া হল পবিত্র রমজানে একটি বিশেষ প্রার্থনা। যে কোন প্রয়োজনে,জরুরী অবস্থায় দুয়ার বিকল্প নেই। প্রার্থনা ঈশ্বরের রহমত ও আশীর্বাদ লাভের একটি হাতিয়ারও বটে। তাছাড়া নামায না পড়া আল্লাহর রাগের কারণ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের রব (আল্লাহ) বলেন, তোমরা আমার কাছে প্রার্থনা কর, আমি তোমাদের দোয়া কবুল করব। যারা অহংকারবশত আমার ইবাদত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সূরা আল মুমিন : ৬০)
তাই পবিত্র রমজান মাসে আমাদের উচিত সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে বেশি বেশি প্রার্থনা করা। বিশেষ করে ইফতারের সময়। কারণ মহান আল্লাহ ইফতারের সময় বান্দার দোয়া কবুল করেন।
আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “তিন প্রকারের মানুষের দোয়া কখনই প্রত্যাখ্যাত হয় না। ১. রোজাদার যখন ইফতার করে, ২. ন্যায়পরায়ণ শাসকের প্রার্থনা, ৩. নির্যাতিতদের প্রার্থনা। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,আল্লাহ নির্যাতিতদের দোয়া মেঘের উপর তুলে দেন এবং তার জন্য বেহেশতের সকল দরজা খুলে দেওয়া হয়। আল্লাহ বলেন, আমার ইজ্জতের শপথ! আমি অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করব, যদিও এটি কিছু সময়ের পরে হয়।’ (তিরমিযীঃ ৩৫৯৮)
যাকাত
যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। যেহেতু রমজান মাসে প্রতিটি নেক কাজের সওয়াব বহুগুণ বেড়ে যায়, তাই অধিকাংশ মানুষ এ মাসে যাকাত দেন। রাসুল (সাঃ) এ মাসে বেশি বেশি যাকাত দিতেন। তিনি শুধু যাকাতই দেননি, আরও বেশি দান-খয়রাত করতেন।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জিবরাইল (আঃ) রমজানের প্রতি রাতে তাঁর (রাসূল)-এর সাথে দেখা করতেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে কুরআন শোনাতেন। জিবরাঈল (আঃ) যখন রসূল (সাঃ) এর সাথে সাক্ষাত করতেন, তখন তিনি মানুষের কল্যাণে প্রেরিত বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে উঠতেন।’ (বুখারীঃ ৩২২০)
সুতরাং যাদের উপর যাকাত ফরয, তারা এ মাসে তাদের যাকাত সঠিকভাবে আদায় করতে পারবে। সর্বশক্তিমান আল্লাহ অবশ্যই এর উত্তম প্রতিদান দেবেন।
সদকা
যাদের উপর যাকাত ফরয নয়, তারা এ মাসে বেশি বেশি দান করতে পারেন। যাদের উপর যাকাত ফরয, তারাও যাকাত আদায়ের পর অতিরিক্ত সদকা দিতে পারেন। ঈশ্বর রিজিকে দানের মাধ্যমে আশীর্বাদ করেছেন। বিপদ দূর করে। মানুষের জীবন ধন্য হয়, মৃত্যু হ্রাস পায় এবং অহংকার ও অহংকার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। (আত্তারগীব ওয়াত তারহীবঃ ২/৬৫)
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঈদুল আযহা বা ঈদুল ফিতরের সালাত আদায় করতে ঈদগাহে যাচ্ছিলেন। তিনি নারীদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, হে নারী সমাজ! আপনি দাতব্য কাজ চালিয়ে যান। কারণ আমি দেখেছি জাহান্নামের অধিবাসীদের মধ্যে তুমিই বেশি। তারা জিজ্ঞেস করলেন, কেন হে আল্লাহর রাসূল? তিনি বললেন, তুমি খুব বেশি অভিশাপ দাও এবং তোমার স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞ। (বুখারি : ৩০৪)
যারা গোপনে দান করবে, আল্লাহতায়ালা তাদের কেয়ামতের দিন আরশের ছায়াতলে রাখবেন। (বুখারি : ৬৬০)
তদুপরি, দান রিজিতে আশীর্বাদ নিয়ে আসে। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করে, নামাজ কায়েম করে এবং আল্লাহ যে রিজিক দিয়েছেন তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারা এমন ব্যবসার আশা করতে পারে যা কখনো ধ্বংস হবে না। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,যাতে আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেন এবং তিনি তাঁর অনুগ্রহে তাদের আরও বেশি দেন। নিশ্চয় তিনি পরম ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা ফাতির : ২৯-৩০) তাই আমরা পবিত্র রমজানে বেশি বেশি দান-খয়রাত করে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করি।
রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা
ইসলামে আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আত্মীয়স্বজনের হক সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন,’তোমরা রক্তের আত্মীয়দের ব্যাপারে সতর্ক হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের রক্ষক।’ (সূরা নিসা :১)
মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় পবিত্র রমজান মাসে আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। তাদের কোনো ঘাটতি আছে কি না তা খুঁজে বের করতে।রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ান। মহান আল্লাহ আমাদের জীবনের সকল গুনাহ মাফ করে দিন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে,সে যেন রক্তের সম্পর্ক বজায় রাখে। (বুখারীঃ ৬১৩৮)। যারা তাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে না, মহান আল্লাহ তাদের সাথে সম্পর্ক রাখবেন না। হাদিসে উল্লেখ আছে,’বন্ধুত্বের বন্ধন সিংহাসনে ঝুলে আছে এবং সে বলে, যে আমাকে অটুট রাখবে, আল্লাহ তার সাথে তার সম্পর্ক অটুট রাখবেন।’ আর যে আমাকে আলাদা করবে আল্লাহ তার সাথে তার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেবেন।’ (রিয়াদুস সালেহীন: ৩২৮)
আত্মীয়-স্বজনের সাথে সুসম্পর্কের প্রতিদান সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক দুনিয়াতে দিয়ে থাকেন। এটাই রিযকের প্রশস্ততা। আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি চায় তার জীবিকা বৃদ্ধি হোক বা মৃত্যুর পর তার সুনাম হোক, সে যেন তার আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করে। (বুখারীঃ ২০৬৭)
লাইলাতুল কদরের ইবাদত
লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রাত। এটি একটি মহান তাৎপর্যপূর্ণ রাত। পবিত্র কুরআনে এর উল্লেখ আছে। নিশ্চয়ই আমি এ কোরআন নাজিল করেছি মহিমান্বিত রাতে। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,আর আপনি কি জানেন মহিমান্বিত রাত কি? মহিমান্বিত রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সেই রাতে ফেরেশতা ও রূহ তাদের পালনকর্তার নির্দেশে প্রতিটি কাজের জন্য অবতরণ করে। শান্তি সেই রাতে, ভোর পর্যন্ত শান্তি। (সূরা আল-কদর: ১-৫)
রাসুল (সাঃ) রমজান মাসে এই রাতের সন্ধান করতেন। তবে তিনি রমজানের শেষ দশকে ইবাদতের মাত্রা বাড়িয়ে দিতেন। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, যখন রমজানের শেষ দশ দিন আসত, তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) কোমর শক্ত করে বেঁধে রাখতেন। আর রাত জেগে থাকতেন পরিবারকে জাগাতে। (বুখারি:২০২৪)
অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। (বুখারি: ২০১৭)
উল্লেখিত হাদিসগুলো থেকে জানা যায় যে, পবিত্র রমজান মাসে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো লাইলাতুল কদরের সন্ধান করা। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে সওয়াবের আশায় ঈমানের সাথে সালাত আদায় করবে, তার অতীতের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমজানে রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। (বুখারি: ১৯০১)
ইতেকাফ
রমজানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল ইতিকাফ। শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী (রহ.) ইতিকাফের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘মসজিদে ইতিকাফ হলো অন্তরের প্রশান্তি, আত্মার পবিত্রতা এবং মনের পবিত্রতা; পরিচ্ছন্নতা ও চিন্তার বিশুদ্ধতা। ফেরেশতাদের গুণাবলী অর্জন এবং লাইলাতুল কদরের সৌভাগ্য ও কল্যাণসহ সকল প্রকার ইবাদতের সুযোগ লাভের সর্বোত্তম উপায়। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,এ কারণে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে মৃত্যু পর্যন্ত ইতিকাফ করেছেন এবং তাঁর বিবিরাসহ তাঁর অনেক সাহাবী মৃত্যু পর্যন্ত এই সুন্নাত অনুসরণ করেছেন।(হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা: ২/৪২)
ইতিকাফ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে। ইবনু উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। (বুখারি: ২০২৫)
তিনি রমজান মাসে ইতিকাফকে এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইতিকাফ ত্যাগ করেননি। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত এই নিয়ম ছিল। অতঃপর তাঁর স্ত্রীগণও ইতিকাফ করতেন। (বুখারি: ২০২৬)
রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , রমজানে ওমরা
রমজান মাসের অন্যতম ফজিলত হল রমজান মাসে ওমরাহ করা। কেননা হজ ওমরাহ মানুষের দারিদ্র্য ও গুনাহ দূর করে। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমরা ক্রমাগত হজ ও ওমরা করতে থাক। এই দুটি আমল দারিদ্র্য ও পাপ দূর করে। যেমন, জোয়ারের আগুনে লোহা, সোনা, রূপার ময়লা ও মরিচা দূর হয়।’ (তিরমিযীঃ ৮১০)
তাই সামর্থ্য ও সুযোগ থাকলে পবিত্র রমজান মাসে ওমরাহ পালন করতে পারি। এটি করার মাধ্যমে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাদের গুনাহ মাফ করবেন এবং বিনিময়ে হজের জন্য আমাদের সওয়াব দান করবেন। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এক আনসারী মহিলাকে বললেন, ‘আমাদের সাথে হজ করতে তোমাকে কিসে বাধা দেয়?’ ইবনে আব্বাস (রা.) মহিলার নাম বলেছেন; কিন্তু আমি ভুলে গেছি। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,মহিলাটি বলল, ‘আমাদের একটি জল বহনকারী উট ছিল; কিন্তু তাতে অমুকের বাবা ও তার ছেলে (অর্থাৎ মহিলার স্বামী ও ছেলে) উপরে উঠে চলে গেল। আর তিনি আমাদের জন্য আরেকটি পানিবাহী উট রেখে গেলেন, যা দিয়ে আমরা পানি বহন করি। রাসুল (সাঃ) বললেন, ঠিক আছে, যখন রমজান আসে, তখন ওমরা কর। কারণ রমজানে একটি ওমরাহ একটি হজের সমতুল্য।’ (বুখারি: ১৭৮২)
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে পবিত্র রমজানে উল্লেখিত আমলগুলোর প্রতি সতর্ক থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , রমজান মাসের ৩০ আমল
এ মাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল রয়েছে যেগুলো করে আমরা জান্নাতে যেতে পারি এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারি। নিচে রমজান মাস সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।
কিন্তু এই আমলগুলো করার শর্তগুলো হলঃ
এক:- ইখলাস মানে “শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আন্তরিকতার সাথে কাজ করা”। সুতরাং অর্থ উপার্জনের জন্য, নেতৃত্ব লাভের জন্য এবং সুনাম অর্জনের জন্য যে কাজ করা হয় সে কাজে আন্তরিকতা থাকবে না, অর্থাৎ এসব ইবাদত বা নেক আমল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করবে না, বরং তা ছোট শিরকে রূপান্তরিত হতে পারে। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,আল-কোরআনে বলা হয়েছে: “এবং তাদের কেবলমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তাঁর জন্য দ্বীনকে উৎসর্গ করতে আদেশ করা হয়েছিল” [সূরা আল-বাইয়্যেনাহ : ৫]
দুই: ইবাদতে আল্লাহর রাসূলের অনুসরণ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহীহ হাদীসে বর্ণিত সকল ইবাদত অবশ্যই পূর্ণরূপে অনুসরণ করতে হবে। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,এক্ষেত্রে বাড়ানো বা কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা ইবাদত হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা শিখিয়েছেন। কোরানে বলা হয়েছে, ‘রাসূল তোমাদের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর এবং যা থেকে নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।’ [সূরা হাশর : ৭]
এ বিষয়ে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে এমন ইবাদত করল যাতে আমাদের কোন নির্দেশনা নেই তা পরিত্যাজ্য হিসাবে গণ্য হবে’’। [সহীহ মুসলিম : ৪৫৯০]
রমজান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো হলো:-
[১] সিয়াম : সিয়াম ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। আর রমজান মাসে সিয়াম রাখা ফরজ। তাই রমজান মাসের প্রধান কাজ হলো সুন্নাহ মোতাবেক সিয়াম রাখা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন: “অতএব তোমাদের মধ্যে যে মাসটি আসে, সে যেন এতে সিয়াম রাখে” [সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৫]
রোজার ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে অর্থাৎ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য রমজানে রোজা রাখবে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে” [সহীহ বুখারি: ২০১৪]
“যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় (অর্থাৎ শুধুমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য) একদিন রোজা রাখবে, আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে রাখবেন।” [সহীহ মুসলিম:২৭৬৭]
[২] সময় মত সালাত আদায় করা: সিয়াম পালনের সাথে সাথে সময় মত নামায আদায় করার মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম হয়। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে: ‘নিশ্চয় সালাত মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরয।’ [সূরা নিসা : ১০৩]
এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে:আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! কোন আমল জান্নাতের অতি নিকটবর্তী? তিনি বললেন, সময় মত নামায আদায় করা। [সহীহ মুসলিম : ২৬৩]
[৩] অপরকে কুরআন পড়া শেখানো: রমজান মাস অপরকে কুরআন শেখানোর উত্তম সময়। এ মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাহাবীদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন।রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই, যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়’’ [সহীহ আল-বুখারী : ৫০২৭]
‘যে আল্লাহর কিতাব থেকে একটি আয়াত শিক্ষা দিবে, যত তিলাওয়াত হবে তার সাওয়াব সে পাবে’ [সহীহ কুনুযুস সুন্নাহ আন-নবুবিয়্যাহ : ০৭]
[৪] সহীহভাবে কুরআন শেখা:রমজান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। এ মাসের অন্যতম আমল হলো সহীহভাবে কুরআন শেখা। আর কুরআন শিক্ষা করা ফরয করা হয়েছে। কেননা কুরআনে বলা হয়েছে:‘‘পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’’ [সূরা আলাক : ১]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন শেখার নির্দেশ দিয়ে বলেন:‘‘তোমরা কুরআন শিক্ষা কর এবং তিলাওয়াত কর’’ [মুসনাদ আলজামি : ৯৮৯০]
[৫] বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা: এটি কুরআনের মাস। তাই এ মাসে অন্যতম কাজ হলো বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ’’ [সুনান আত-তিরমিযী: ২৯১০, সহীহ]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান ব্যতীত কোন মাসে এত বেশি তিলাওয়াত করতেন না। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: ‘‘রমজান ব্যতীত অন্য কোনো রাত্রিতে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করতে, কিংবা ভোর অবধি সালাতে কাটিয়ে দিতে অথবা পূর্ণ মাস রোযা পালন করে কাটিয়ে দিতে দেখি নি’’ [সহীহ মুসলিম : ১৭৭৩]
[৬] সালাতুত তারাবীহ পড়া: সালাতুত তারাবীহ পড়া এ মাসের অন্যতম আমল। তারাবীহ পড়ার সময় তার হক আদায় করতে হবে। হাদীসে এসেছে: ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব হাসিলের আশায় রমজানে কিয়ামু রমজান (সালাতুত তারাবীহ) আদায় করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’ [সহীহ আল-বুখারী : ২০০৯]
তারাবীহ এর সালাত তার হক আদায় করে অর্থাৎ ধীরস্থীরভাবে আদায় করতে হবে। তারাবীহ জামায়াতের সাথে আদায় করা সুন্নাহ এর অন্তর্ভুক্ত। হাদীসে আছে: ‘‘যে ব্যক্তি ইমামের সাথে প্রস্থান করা অবধি সালাত আদায় করবে (সালাতুত তারাবীহ) তাকে পুরো রাত কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব দান করা হবে’’ [সুনান আবূ দাউদ : ১৩৭৭, সহীহ]
[৭] সাহরী খাওয়া: সাহরী খাওয়ার মধ্যে বরকত রয়েছে এবং সিয়াম পালনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হাদীসে এসেছে: ‘‘সাহরী হল বরকতময় খাবার। তাই কখনো সাহরী খাওয়া বাদ দিয়ো না। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,এক ঢোক পানি পান করে হলেও সাহরী খেয়ে নাও। কেননা সাহরীর খাবার গ্রহণকারীকে আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর ফেরেশতারা স্মরণ করে থাকেন’’ [মুসনাদ আহমাদ : ১১১০১, সহীহ]
[৮] কল্যাণকর কাজ বেশি বেশি করা: এ মাসটিতে একটি ভাল কাজ অন্য মাসের চেয়ে অনেক বেশি উত্তম। সেজন্য যথাসম্ভব বেশি বেশি ভাল কাজ করতে হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘এ মাসের প্রত্যেক রাতে একজন ঘোষণাকারী এ বলে আহবান করতে থাকে যে, হে কল্যাণের অনুসন্ধানকারী তুমি আরো অগ্রসর হও! হে অসৎ কাজের পথিক, তোমরা অন্যায় পথে চলা বন্ধ কর। (তুমি কি জান?) এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তায়ালা কত লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন’’ [সুনান আত-তিরমিযী : ৬৮৪]
[৯] শুকরিয়া আদায় করা: রমজান মাস পাওয়া এক বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। সেজন্য আল্লাহ তা‘আলার বেশি বেশি শুকরিয়া আদায় করা এবং আগামী রমজান পাওয়ার জন্য তাওফীক কামনা করা।রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , রমজানসম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে: ‘‘আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তিনি তোমাদেরকে যে হিদায়াত দিয়েছেন, তার জন্য আল্লাহর বড়ত্ব ঘোষণা কর এবং যাতে তোমরা শোকর কর।’’ [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৫]
‘‘আর যখন তোমাদের রব ঘোষণা দিলেন, ‘যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের বাড়িয়ে দেব, আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আজাব বড় কঠিন’।’’ [সূরা ইবরাহীম : ৭]
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ামাতের শুকরিয়া আদায় করে বলতেন অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য [সুনান আত-তিরমিযী : ২৭৩৮]
[১০] বেশি বেশি দান-সদাকাহ করা: এ মাসে বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করার জন্য চেষ্টা করতে হবে। ইয়াতীম, বিধবা ও গরীব মিসকীনদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া ও বেশি বেশি দান খয়রাত করা।রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , হিসাব করে এ মাসে যাকাত দেয়া উত্তম। কেননা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে বেশি বেশি দান খয়রাত করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দানশীল আর রমজান তাঁর এ দানশীলতা আরো বেড়ে যেত’’ [সহীহ আল-বুখারী : ১৯০২]
[১১] সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়া: রমজান মাস ছাড়াও সালাতুত তাহাজ্জুদ পড়ার মধ্যে বিরাট সাওয়াব এবং মর্যাদা রয়েছে। রমজানের কারণে আরো বেশি ফজিলত রয়েছে। যেহেতু সাহরী খাওয়ার জন্য উঠতে হয় সেজন্য রমজানমাসে সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায় করার বিশেষ সুযোগও রয়েছে। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত’’ [সহীহ মুসলিম : ২৮১২]
[১২] ই‘তিকাফ করা: ই‘তিকাফ অর্থ অবস্থান করা। অর্থাৎ মানুষদের থেকে পৃথক হয়ে সালাত, সিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া, ইসতিগফার ও অন্যান্য ইবাদাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে একাকী কিছু সময় যাপন করা। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,এ ইবাদাতের এত মর্যাদা যে, প্রত্যেক রমজানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশ দিন নিজে এবং তাঁর সাহাবীগণ ই‘তিকাফ করতেন। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: ‘‘প্রত্যেক রমজানেই তিনি শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু জীবনের শেষ রমযানে তিনি ইতিকাফ করেছিলেন বিশ দিন’’ । দশ দিন ই‘তেকাফ করা সুন্নাত। [সহীহ আলবুখারী : ২০৪৪]
[১৩] উত্তম চরিত্র গঠনের অনুশীলন করা: রমজান মাস নিজকে গঠনের মাস। এ মাসে এমন প্রশিক্ষণ নিতে হবে যার মাধ্যমে বাকি মাসগুলো এভাবেই পরিচালিত হয়। কাজেই এ সময় আমাদেরকে সুন্দর চরিত্র গঠনের অনুশীলন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রোযা রাখে, সে যেন তখন অশস্নীল কাজ ও শোরগোল থেকে বিরত থাকে। রোযা রাখা অবস্থায় কেউ যদি তার সাথে গালাগালি ও মারামারি করতে আসে সে যেন বলে, আমি রোযাদার’’ [সহীহ মুসলিম : ১১৫১]
[১৪] লাইলাতুল কদর তালাশ করা:রমজানমাসে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল-কুরআনের ঘোষণা: ‘‘কদরের রাত হাজার মাসের চেয়েও উত্তম’’ [সূরা কদর : ৪]
হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াব পাওয়ার আশায় ইবাদাত করবে তাকে পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে’’ [সহীহ আল-বুখারী : ৩৫]
এ রাত পাওয়াটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। এক হাদীসে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: ‘‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য সময়ের তুলনায় রমদানের শেষ দশ দিনে অধিক হারে পরিশ্রম করতেন’’ [সহীহ মুসলিম : ১১৭৫]
লাইলাতুল কদরের দো‘আ: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, হে আল্লাহর নবী ! যদি আমি লাইলাতুল কদর পেয়ে যাই তবে কি বলব ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, বলবেঃ ‘‘হে আল্লাহ আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমাকে ভালবাসেন, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন।’’ [সুনান আত-তিরমিযী : ৩৫১৩]
[১৫] দাওয়াতে দ্বীনের কাজ করা: রমজান মাস হচ্ছে দ্বীনের দাওয়াতের সর্বোত্তম মাস। আর মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকাও উত্তম কাজ। এজন্য এ মাসে মানুষকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসার জন্য আলোচনা করা, কুরআন ও হাদীসের দারস প্রদান, বই বিতরণ, কুরআন বিতরণ ইত্যাদি কাজ বেশি বেশি করা। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,আলকুরআনের ঘোষণা : ‘‘ঐ ব্যক্তির চাইতে উত্তম কথা আর কার হতে পারে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করলো এবং ঘোষণা করলো, আমি একজন মুসলিম’’ [সূরা হা-মীম সাজদাহ : ৩৩]
হাদীসে এসেছে:‘‘ভাল কাজের পথ প্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারী অনুরূপ সাওয়াব পাবে’’ [সুনান আত-তিরমীযি : ২৬৭০]
[১৬] সামর্থ্য থাকলে উমরা পালন করা: এ মাসে একটি উমরা করলে একটি হাজ্জ আদায়ের সমান সাওয়াব হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘রমজান মাসে উমরা করা আমার সাথে হাজ্জ আদায় করার সমতুল্য’’ [সহীহ আলবুখারী : ১৮৬৩]
[১৭] ইফতার করা: সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করা বিরাট ফজিলাতপূর্ণ আমল। কোন বিলম্ব না করা । কেননা হাদীসে এসেছে: ‘‘যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করবে, সে যেন খেজুর দিয়ে ইফতার করে, খেজুর না পেলে পানি দিয়ে ইফতার করবে। কেননা পানি হলো অধিক পবিত্র ’’ [সুনান আবু দাউদ : ২৩৫৭, সহীহ]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইফতার করতেন তখন বলতেন : “পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সিক্ত হল এবং আল্লাহর ইচ্ছায় পুরস্কারও নির্ধারিত হল।” [সুনান আবূ-দাউদ: ২৩৫৯, সহীহ]
অপর বর্ণনায় যে এসেছে- “হে আল্লাহ! তোমার জন্য রোযা রেখেছি, আর তোমারই রিযিক দ্বারা ইফতার করছি।” এর সনদ দুর্বল। আমাদের উচিত সহীহ হাদীসের উপর আমল করা। [সুনান আবু দাউদ :২৩৫৮]
[১৮] বেশি বেশি দো‘আ ও কান্নাকাটি করা: দো‘আ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। এজন্য এ মাসে বেশি বেশি দো‘আ করা ও আল্লাহর নিকট বেশি বেশি কান্নাকাটি করা। হাদীসে এসেছে: ‘‘ইফতারের মূহূর্তে আল্লাহ রাববুল আলামীন বহু লোককে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন। মুক্তির এ প্রক্রিয়াটি রমজানের প্রতি রাতেই চলতে থাকে’’ [আল জামিউস সাগীর : ৩৯৩৩]
অন্য হাদীসে এসেছে: ‘‘রমযানের প্রতি দিবসে ও রাতে আল্লাহ তা‘আলা অনেককে মুক্ত করে দেন। প্রতি রাতে ও দিবসে প্রতি মুসলিমের দো‘আ কবূল করা হয়’’ [সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব : ১০০২]
[১৯] ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা:ফজরের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করা। এটি একটি বিরাট সাওয়াবের কাজ। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি ফজর জামাআত আদায় করার পর সূর্য উদয় পর্যন্ত মাসজিদে অবস্থান করবে, অতঃপর দুই রাকাআত সালাত আদায় করবে, সে পরিপূর্ণ হাজ্জ ও উমারাহ করার প্রতিদান পাবে। [সুনান আত-তিরমিযী : ৫৮৬]
[২০] তাওবাহ ও ইস্তেগফার করা: তাওবাহ শব্দের আভিধানিক অর্থ ফিরে আসা, গুনাহের কাজ আর না করার সিদ্ধান্ত নেয়া। এ মাস তাওবাহ করার উত্তম সময়। আর তাওবাহ করলে আল্লাহ খুশী হন। আল-কুরআনে এসেছে: ‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবা কর, খাটি তাওবা; আশা করা যায়, তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত’’ [সূরা আত-তাহরীম : ৮]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘হে মানবসকল! তোমরা আল্লাহর নিকট তাওবাহ এবং ক্ষমা প্রার্থনা কর, আর আমি দিনে তাঁর নিকট একশত বারের বেশি তাওবাহ করে থাকি’’ [সহীহ মুসলিম : ৭০৩৪]
তবে তাওবাহ ও ইস্তেগফারের জন্য উত্তম হচ্ছে, মন থেকে সাইয়্যেদুল ইস্তেগফার পড়া, আর তা হচ্ছে ‘‘হে আল্লাহ, তুমি আমার প্রতিপালক, তুমি ছাড়া প্রকৃত এবাদতের যোগ্য কেউ নাই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ, আর আমি তোমার গোলাম আর আমি সাধ্যমত তোমার সাথে কৃত অঙ্গীকারের উপর অবিচল রয়েছি। আমার কৃত-কর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমাকে যত নেয়ামত দিয়েছে সেগুলোর স্বীকৃতি প্রদান করছি। যত অপরাধ করেছি সেগুলোও স্বীকার করছি। অত:এব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। কারণ, তুমি ছাড়া ক্ষমা করার কেউ নেই।’’
ফযিলাত: ‘‘যে কেউ দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে দিনের বেলা এই দু‘আটি (সাইয়েদুল ইসতিগফার) পাঠ করবে ঐ দিন সন্ধ্যা হওয়ার আগে মৃত্যু বরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে এবং যে কেউ ইয়াকিনের সাথে রাত্রিতে পাঠ করবে ঐ রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করলে সে জান্নাতবাসী হবে।’’ [সহীহ আল-বুখারী : ৬৩০৬]
[২১] ইফতার করানো: অপরকে ইফতার করানো একটি বিরাট সাওয়াবের কাজ। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,প্রতিদিন কমপক্ষে একজনকে ইফতার করানোর চেষ্টা করা দরকার। কেননা হাদীসে এসেছে: ‘‘যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করাবে, সে তার সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে, তাদের উভয়ের সাওয়াব হতে বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবে না’’ [সুনান ইবন মাজাহ : ১৭৪৬, সহীহ]
[২২] তাকওয়া অর্জন করা: তাকওয়া এমন একটি গুণ, যা বান্দাহকে আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় পাপকাজ থেকে বিরত রাখে এবং তাঁর আদেশ মানতে বাধ্য করে।রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , আর রমজান মাস তাকওয়া নামক গুণটি অর্জন করার এক বিশেষ মৌসুম। কুরআনে এসেছে: ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে করে তোমরা এর মাধ্যমে তাকওয়া অবলম্বন করতে পারো’’ [সূরা আলবাকারাহ : ১৮৩]
যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য উত্তরণের পথ তৈরী করে দেন। [সূরা তালাক : ০২]
[২৩] কুরআন মুখস্থ বা হিফয করা: কুরআন হিফয করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা নিজেই কুরআন হিফযের দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি এ দায়িত্ব মূলত বান্দাদেরকে কুরআন হিফয করানোর মাধ্যমেই সম্পাদন করেন। কুরআনে এসেছে:‘‘নিশ্চয় আমি কুরআন নাযিল করেছি, আর আমিই তার হিফাযতকারী’’ [সূরা আল-হিজর: ৯]
যে যত বেশি অংশ হিফয করতে পারবে তা তার জন্য ততই উত্তম।আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: ‘‘কুরআনের ধারক-বাহককে বলা হবে কুরআন পড়ে যাও, আর উপরে উঠতে থাক, ধীর-স্থিরভাবে তারতীলের সাথে পাঠ কর, যেমন দুনিয়াতে তারতীলের সাথে পাঠ করতে। কেননা জান্নাতে তোমার অবস্থান সেখানেই হবে, যেখানে তোমার আয়াত পড়া শেষ হবে” [সুনান আত-তিরমিযী : ২৯১৪]
[২৪] অপরকে খাদ্য খাওয়ানো: রমজান মাসে লোকদের খাওয়ানো, বিশেষ করে সিয়াম পালনকারী গরীব, অসহায়কে খাদ্য খাওয়ানো বিরাট সাওয়াবের কাজ । কুরআনে এসেছে: তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে। [সূরা আদ-দাহর: ৮]
এ বিষয়ে হাদীসে বলা হয়েছে: ‘‘আবদুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, একজন লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলামে উত্তম কাজ কোনটি? তিনি বললেন, অন্যদেরকে খাবার খাওয়ানো এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দেয়া’’ [সহীহ আল-বুখারী : ১২]
অপর বর্ণনায় বর্ণিত আছে যে :‘‘যে কোনো মুমিন কোনো ক্ষুধার্ত মুমিনকে খাওয়াবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। [বাইহাকী, শু‘আবুল ইমান : ৩০৯৮, হাসান]
[২৫] ফিতরাহ দেয়া: এ মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে ফিতরাহ দেয়া আবশ্যক। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের সালাত আদায়ের পুর্বে ফিতরাহ আদায় করার আদেশ দিলেন। [সহীহ আল-বুখারী :১৫০৩]
[২৬] আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নীত করা: আত্মীয়তার সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,আর তা রক্ষা করাও একটি ইবাদাত। এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘‘আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আরও তাকওয়া অবলম্বন কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। [সূরা আন-নিসা: ১]
আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:“সালাম বিমিয়ের মাধ্যমে হলেও আত্নীয়তার সম্পর্ক তরতাজা রাখ।” [সহীহ কুনুযুস সুন্নাহ আন-নবওয়িয়্যাহ : ১৩]
[২৭] আল্লাহর যিকর করা: এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘‘আল্লাহ তা’আলা চারটি বাক্যকে বিশেষভাবে নির্বাচিত করেছেন, তাহলো যে ব্যক্তি পড়বে, তার জন্য দশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়।রমজানে কোন আমল বেশি করবেন , যে ব্যক্তি পড়বে, তার জন্য বিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর বিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবে পড়বে, তার জন্য ত্রিশটি সাওয়াব লেখা হয়, আর ত্রিশটি গুনাহ মিটিয়ে দেয়া হয়’’। [মুসনাদ আহমাদ : ১১৩৪৫]
[২৮] একজন অপরজনকে কুরআন শুনানো: রমজান মাসে একজন অপরজনকে কুরআন শুনানো একটি উত্তম আমল। এটিকে দাওর বলা হয়। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে: জিবরাইল আলাইহিস সালাম রমজানের প্রতি রাতে রমজানের শেষ পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং রাসূল তাকে কুরআন শোনাতেন। [সহীহ আল-বুখারী : ১৯০২]
ইবনে হাজার রাহেমাহুল্লাহ্ বলেন : জিবরাইল প্রতি বছর রাসূলের সাথে সাক্ষাৎ করে এক রমযান হতে অন্য রমযান অবধি যা নাযিল হয়েছে, তা শোনাতেন এবং শুনতেন। যে বছর রাসূলের অন্তর্ধান হয়, সে বছর তিনি দু বার শোনান ও শোনেন ।
[২৯] কুরআন বুঝা ও আমল করা: কুরআনের এ মাসে কুরআন বুঝা ও আমল করা গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত। কুরআন অনুযায়ী নিজের জীবনকে গড়ে তোলা। এ বিষয়ে কুরআনে নির্দেশ দেয়া হয়েছে: ‘তোমাদের প্রতি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা অনুসরণ কর এবং তাকে ছাড়া অন্য অভিভাবকের অনুসরণ করো না। তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ কর’। [সূরা আল-আ‘রাফ : ৩]
[৩০] মিসওয়াক করা: মেসওয়াকের প্রতি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,হাদীসে এসেছে: অর্থাৎ মেসওয়াক মুখের জন্য পবিত্রকারী, এবং রবের সন্তুষ্টি আনয়নকারী। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা রেখেও মেসওয়াক করতেন বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। [সহীহ ইবন খুযাইমাহ : ১৩৫]
রমজানে যেসব দোয়া বেশি বেশি করবেন
তাসবীহ, ইস্তেগফার ও দোয়ার মাধ্যমে রমজান মাস অতিবাহিত করার জন্য প্রিয় নবী (সা.) ছিলেন উম্মাহর জন্য বিশেষ উপদেশ। যাতে মানুষ এই বিশেষ তাসবিহ, ইস্তেগফার ও দোয়ার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের জন্য নিজেদেরকে পুরোপুরি প্রস্তুত করতে পারে। হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে-
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, এ মাসে চারটি কাজ করতে হবে। দুটি আমল যার দ্বারা তোমার প্রভু সন্তুষ্ট হন। বাকি দুইটি হল যা ছাড়া আপনার কোন উপায় নেই।
এই চারটির একটি হল কালেমা শাহাদাত পাঠ, দ্বিতীয়টি অধিক পরিমাণে ইস্তেগফার বা ক্ষমা প্রার্থনা করা। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন ,এ দুটি কাজ আল্লাহর দরবারে খুবই কাম্য। তৃতীয় এবং চতুর্থটি জান্নাতের আশা করছে এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করছে। এই দুটি জিনিস আপনার জন্য একেবারে প্রয়োজনীয়। (ইবনে খুজাইমাহ)
হাদিসে ঘোষিত বিশেষ দোয়া:
১. তাসবিহ পড়া অর্থাৎ সাক্ষ্য দেওয়া-
“لا اله الا الله”
উচ্চারণ: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’
অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই।
২.ইসতেগফার করা অর্থাৎ ক্ষমা চাওয়া। হাদিসে অনেক ইসতেগফার এসেছে। এর যেকোনোটি পড়লেই হবে-
أستغفر الله عظيم إن الله غفور رحيم
উচ্চারণ: আসতাগফিরুল্লাহাল আজিম ইন্নাল্লাহা গাফুরুর রাহিম।
অর্থ: মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল, দয়ালু।
أستغفر الله عظيم اللاجي لا إلههاإلا هوال هايول كايومو وأتوبو إليهي
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহাল আজিম আল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুমু ওয়া আতুবু ইলাইহি।
অর্থ: মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, যিনি এক ব্যতিত কোনো ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী এবং তার দিকেই আমরা ফিরে যাব।
رب بكفرلي وحوض علياإيناكا أنتات طواب رحيم
উচ্চারণ: রাব্বিগফিরলী ওয়া তুব আলাইয়্যা ইন্নাকা আনতাত তাওয়াবুর রাহিম।
অর্থ: হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করে দিন, আমার তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি অতিশয় তাওবা কবুলকারী, দয়াবান।’
الله أنت ربي لا إله إلا أنت خلقتاني ؛ وآنا أبادوكا وآنا ماستاتوايتو ، أوجوبيكا من شاري ما سانايتو أبو الله بيني ماتيكا عليا ؛
وأبو بيزامبي فاجفرلي فا إناهو لا ياغفيروز جونوبا من أنتا.
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্বতানি; ওয়া আনা আ’বদুকা ওয়া আনা আ’লা আ’হদিকা ওয়া’দিকা মাসতাত্বা’তু, আউজুবিকা মিন শাররি মা সানা’তু আবুউলাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়া; ওয়া আবুউ বিজামবি ফাগফিরলি ফা ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।
অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি আমার প্রতিপালক, তুমি ছাড়া ইবাদতের যোগ্য কোনো উপাস্য নেই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমার বান্দা। আমি আমার সাধ্যমত তোমার প্রতিশ্রুতিতে অঙ্গীকারবদ্ধ রয়েছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্টতা থেকে তোমার নিকট আশ্রয় চাই। আমার ওপর তোমার অনুগ্রহকে স্বীকার করছি এবং আমার পাপও স্বীকার করছি। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। নিশ্চয়ই তুমি ব্যতিত কোনো ক্ষমাকারী নেই।
যা করণীয় নয়:
রমজান মাসের ফজিলত হাসিল করার জন্য এমন কিছু কাজ রয়েছে যা থেকে বিরত থাকা দরকার,সেগুলো নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :
১. সাহরী না খাওয়া,
২. বিলম্বে ইফতার করা,
৩. মিথ্যা বলা ও অন্যান্য পাপ কাজ করা,
৪. বেশি বেশি ঘুমানো,
৫. তিলাওয়াতের হক আদায় না করে কুরআন খতম করা,
৬. জামা‘আতের সাথে ফরয সালাত আদায়ে অলসতা করা,
৭. শেষের দশ দিন কেনা কাটায় ব্যস্ত থাকা,
৮. অশ্লীল ছবি,নাটক দেখা,
৯. বিদ‘আত করা,
১০.দুনিয়াবী ব্যস্ততায় মগ্ন থাকা,
১১.বেহুদা কাজে রাত জাগরণ করা,
১২.রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদাত করা,
১৩.জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধির জন্য সংকট তৈরি করা,
১৪.অপচয় ও অপব্যয় করা।
রমজান মাস পাওয়ার চেয়ে সৌভাগ্যের আর কী হতে পারে! আমরা যদি এ মাসের প্রতিটি কাজ সুন্নত পদ্ধতিতে করতে পারি তাহলে আমাদের রমজান সার্থক হবে। রমজানে কোন আমল বেশি করবেন,কেননা হাদিসে বলা হয়েছে: “যে ব্যক্তি রমজান মাসে পৌঁছায় কিন্তু তার গুনাহ মাফ হয়নি, সে ধ্বংস হোক।” [সূরা সুন্নাহ-৬৮৯] আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে রমজান মাসের ফজিলত অর্জন করার তাওফিক দান করুন।