মেসি-নেইমারকে কেন দুয়ো দেবে না পিএসজি সমর্থক

লুইস সুয়ারেজ ও সেস্ক ফ্যাব্রিগাসের কাল থেকেই মন খারাপ। মানুষ এত দ্রুত সবকিছু ভুলে যায়! গোল আর সাফল্যের কথা এক পাশে রেখে শুধু মনমাতানো ফুটবলের কথা বললে এই প্রজন্মের সেরা তো লিওনেল মেসি ও নেইমার জুনিয়রই। পায়ের ছন্দ, ড্রিবলিং আর উদ্ভাবনী ক্ষমতাই যদি মূল আকর্ষণ হয়ে থাকে, তাহলে ফুটবলকে আকর্ষণীয় করে তোলায় দুজনকে পেছনে ফেলার মতো কে আছেন এখন?

আর সাফল্য আর গোলের চিন্তাতেও মেসিকে কার পেছনে রাখা যাবে? গত পরশু পেশাদার ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড গড়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। এই রোনালদো ছাড়া গোলের সব রেকর্ডে যে মেসি ছাড়া আর কারও নাম তোলার উপায় নেই। নেইমারের গোলের রেকর্ডও বেশ ঈর্ষণীয়। এমন দুজনকে কীভাবে দুয়ো দেয় কেউ? তা–ও আবার নিজ দলের সমর্থকেরা! এটাই বিশ্বাস হচ্ছে না সুয়ারেজ ও ফ্যাব্রিগাসের।গত রাতে বোর্দোর বিপক্ষে ঘটে গেছে এমন কিছু। ঘরের মাঠ পার্ক দে প্রিন্সেস ঘটনাস্থল। লিগে সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দলের বিপক্ষে স্বাগতিক দলের সমর্থকেরা মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে নিজেদের সবচেয়ে বড় তারকার শাপশাপান্ত করেছেন। যে ম্যাচে দল ৩-০ গোলে জিতেছে, সে ম্যাচে এমন কিছু গতকাল পর্যন্ত ছিল কল্পনাতীত।

গতকালকের আগে পিএসজির সর্বশেষ ম্যাচের ফল জানা থাকলে অবশ্য পরিস্থিতি কিছুটা অনুমান করা যায়। গত বুধবার চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোতে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে খেলেছে পিএসজি। ম্যাচের প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এগিয়েছিল প্যারিসের ক্লাব। প্রথম লেগের ফল মিলিয়ে সেদিন ৬০ মিনিট পর্যন্ত ২-০ ব্যবধানে এগিয়ে ছিল নেইমার-মেসি-কিলিয়ান এমবাপ্পেদের দল। সে ম্যাচেই ১৭ মিনিটের এক ঝড়ে ৩ গোল খেয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকে ছিটকে গেছে দলটি। সেই চ্যাম্পিয়নস লিগ যে ট্রফি জেতার স্বপ্নে গত এক দশকে ইউরোপিয়ান ফুটবলকেই ভারসাম্যহীন করে ফেলেছে পিএসজি।

কাল তাই এর ঝাল মিটিয়েছেন সমর্থকেরা। গতকাল ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই ক্লাবটির চরমপন্থী সমর্থকেরা ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁদের ক্ষোভের কথা বেশ ভালোভাবে জানিয়ে দেবেন। ম্যাচের একাদশ ঘোষণার সময় যখন নেইমার মেসিদের নাম শুনে দুয়ো দেওয়া শুরু হলো, তখন পর্যন্ত মনে হয়েছিল ঠিকই আছে।এত অর্থ ব্যয় করে একটি দল বানানো হয়েছে, তাঁরা যদি বছরের পর বছর এভাবে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত টুর্নামেন্টেই ব্যর্থ হন, রাগ হতেই পারে। কিন্তু কিলিয়ান এমবাপ্পের নাম ঘোষণার পর নড়েচড়ে বসতে হয়েছে। ফ্রেঞ্চ ফরোয়ার্ডের নাম শুনে যে তালি দিচ্ছেন সবাই!

রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে দুই ম্যাচেই গোল করেছেন এমবাপ্পে। প্রথম লেগে মেসি যে পেনাল্টি মিস করেছেন, সেটা এনে দিয়েছিলেন এমবাপ্পেই। তাই তাঁর বেলায় ঠিকই পিএসজি সমর্থকেরা ভালোবাসা জানিয়েছেন। বোর্দোর বিপক্ষেও ম্যাচে প্রথমে গোল করেছেন এমবাপ্পে। যতবার বল স্পর্শ করেছেন, সমর্থকেরা তালি দিয়েছেন। কিন্তু বলটা মেসি বা নেইমারের দিকে গেলেই শুধু শোনা গেছে দুয়ো। দুজনের কেউ কোনো ভুল করলে ব্যঙ্গ করে তালিও দিয়েছেন দর্শক।এমন বৈরী পরিবেশের মধ্যেও গোল করেছেন নেইমার। কিন্তু সমর্থকদের এতে রাগ কমলে তো। গোল করেও তাই দুয়ো শুনতে হয়েছে তাঁকে। ম্যাচ শেষে তাই কোচ মরিসিও পচেত্তিনো দুঃখ জানিয়েছেন, বলেছেন এমন কষ্টের দিন খুব কম এসেছে।

মেসি-নেইমারদের শুভাকাঙ্ক্ষী, ভক্তরা খেপে উঠেছেন। আর্জেন্টিনার সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সাংবাদিক, সবাই সমালোচনায় মেতেছেন পিএসজির। তাঁদের সবার কথার সুর একটা, এক মেসি বা নেইমারের সাফল্য পিএসজির চেয়ে অনেক বেশি।যুক্তিতে ভুল নেই। ফ্রেঞ্চ লিগে এত দাপট পিএসজির, সেই লিগ পিএসজি জিতেছে মাত্র ৯ বার। কাতারের মালিকানায় যাওয়ার আগে মাত্র দুবার। ইউরোপে তো কোনো সাফল্যই নেই। ওদিকে নেইমার নিজে লিগ জিতেছেন আটটি, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন একটি। আর তুলনা যখন মেসির সঙ্গে করা হয়, তখন তো শুধু পিএসজি নয়, ইউরোপের অনেক ক্লাবই পাত্তা পাবে না। মেসি লিগ জিতেছেন ১০ বার, চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন ৪ বার।

ক্লাব ক্যারিয়ারে ৬৯০টি গোল মেসির। আন্তর্জাতিক ফুটবলে আছে আরও ৮০টি। এক বছরে ৯১টি গোলের বিশ্ব রেকর্ড আছে তাঁর। টানা চারবার ব্যালন ডি’অর জিতেছেন। গত চারটি বছর বলতে গেলে একাই বার্সেলোনাকে টেনে নিয়েছেন। নেইমার বিদায় নেওয়ার পর প্রায় একাই দুটি লিগ এনে দিয়েছেন বার্সেলোনাকে। গত মৌসুমে হতশ্রী এক বার্সেলোনাকে জিতিয়েছেন কোপা দেল রে। এবার ব্রাজিলের মাটিতে গিয়ে জিতেছেন কোপা আমেরিকা। এমন একজনকে দুয়ো কীভাবে দেয় নিজ দলের সমর্থকেরা?

কিন্তু এত সব যুক্তির উত্তরে পিএসজি সমর্থকেরা চাইলে বলতেই পারেন, ‘বেল পাকলে কাকের কী?’ মেসির ক্যারিয়ারে অনেক অর্জন, সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন। নেইমারও নিজের দিনে যেকোনো দলকে ধ্বংস করে দিতে পারেন। কিন্তু এতে পিএসজি সমর্থকদের কী আসে যায়রতাঁদের এসব ক্ষমতা আর অর্জনের ছিটেফোঁটার ভাগ তো পিএসজি পায়নি। এই মৌসুমে ক্লাবে যোগ দেওয়া মেসি ১১ ম্যাচে খেলতে পারেননি চোট ও অসুস্থতা মিলিয়ে। বাকি ২৬ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন মাত্র ৭টি। শুধু লিগে নজর আটকালে সেটি ১৮ ম্যাচে মাত্র ২!

লিগ ‘আ’ তো এখন পিএসজির ব্যক্তিগত সম্পত্তি হয়ে গেছে, ফ্রেঞ্চ কাপও তাই হয়ে গিয়েছিল। মেসি যোগ দেওয়ার পর উল্টো সেই ফ্রেঞ্চ কাপ থেকেও ছিটকে গেছে পিএসজি।এ মৌসুমে বহু অর্থ খরচ করে আনা খেলোয়াড় আশরাফ হাকিমিকে কাল সমর্থকেরা ঠিকই ভালোবাসা দিয়েছেন। কারণ, মেসি-নেইমার যা করতে পারেননি, সেটা ঠিকই করেছেন তিনি। মাঠে নিজের সর্বোচ্চ দিচ্ছেন। রিয়ালের ম্যাচে দুটি গোলে ভুল করা অধিনায়ক মারকিনিওসকেও দুয়ো দেওয়া হয়নি। কারণ, ওই যে ভুল হতেই পারে কিন্তু নিবেদনে তো খামতি নেই মারকিনিওসের। আর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছেন এমবাপ্পে। ম্যাচের আগেই খবর এসেছে, রিয়ালের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছেন এমবাপ্পে। তাঁদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অন্য ক্লাবে, তবু তাঁকে করতালিতে অভিবাদন জানিয়েছেন সমর্থকেরা। কারণ, মন অন্য কোনো ক্লাবে থাকতে পারে, মাঠে কিন্তু ক্লাবের জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়েন এমবাপ্পে।

মেসি বার্সেলোনায় যে বেতন পেতেন, পিএসজিতে সেটা পান না। তবে কমলেও বার্ষিক ৪ কোটি ইউরো তাঁর পেছনে বেতন বাবদ খরচ করছে পিএসজি। ওদিকে নেইমারের জন্য ২০১৭ সালে ২২ কোটি ২০ লাখ ইউরো খরচ করেছে পিএসজি। বছর বছর ৩ কোটি ৫০ লাখ ইউরো ব্যয় করছে। সে বিনিয়োগের ফল, সাড়ে ৪ বছরে মাত্র ৯২ গোল আর সতীর্থদের ৫৭ গোলে সহায়তা। আর দল তাঁকে চেয়েও পায়নি অর্থাৎ চোটাঘাতে খেলতে পারেননি ১০৪ ম্যাচে। টানা দুবার চ্যাম্পিয়নস লিগের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে অর্থাৎ শেষ ষোলোর ম্যাচে মাঠে নামা হয়নি।

সে সব দোষ সমর্থকেরা হয়তো ভুলে যেতেন, যদি রিয়ালের মাঠ থেকে হাসিমুখে ফিরতে পারত পিএসজি। কিন্তু এভাবে বাগে পেয়েও রিয়ালকে হারাতে না পারার ব্যর্থতা সমর্থকদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে। এ কারণেই মেসি-নেইমাররাই দুয়ো বেশি শুনেছেন, এমনকি রিয়ালের বিপক্ষে মাঠে না নামা জর্জিনিও ভাইনালদমকেও দুয়ো শুনতে হয়েছে। তাঁর অপরাধ? এ মৌসুমেই ক্লাবে যোগ দিয়েছেন, বেতন বাবদ ১ কোটি ২০ লাখ ইউরো নিচ্ছেন কিন্তু এমনই খেলা খেলছেন যে বড় ম্যাচে তাঁকে নামানোর সাহস পাচ্ছেন না কোচ!

যে দুজন বেতন বাবদ ক্লাবের কাছ থেকে প্রায় ৮ কোটি ইউরো পান, বড় মঞ্চে তাঁদের এভাবে নিষ্প্রভ থাকা মানতে পারেননি পিএসজি। মাঠে দুজনের আচরণেও দলের প্রতি নিবেদনে ঘাটতি দেখছে সমর্থকেরা। তাঁদের মনে হচ্ছে, পিএসজিতে খেলতে নয়, ক্লাবকে ব্যবহার করে অর্থবিত্ত বাড়িয়ে নিতেই এসেছেন তাঁরা। মনে হতেই পারে, অর্থ তো সমর্থকেরা দিচ্ছেন না, দিচ্ছে ক্লাব। অর্থ খরচ হলে খরচ হচ্ছে কাতারি মালিক ও সভাপতি নাসের আল খেলাইফির।

কিন্তু মাঠে যে দর্শক যান, তাঁর সঙ্গে পিএসজির সম্পর্ক ক্লাবের মালিকের চেয়েও পুরোনো। মৌসুমি টিকিট কাটা দর্শক পিএসজিকে সমর্থন দিচ্ছেন তার রমরমা দিনের জন্য নয়, তার লড়াই করা দিনগুলোর ভালোবাসা থেকেই। তাঁর কাছ তাঁর টিকিটের মূল্যটা ক্লাবের সাফল্য নয়, নিবেদনে। মাঠে যাওয়া সমর্থক দেখছেন ক্লাবের সেরা তারকা এমবাপ্পেকে ধরে রাখতে ব্যর্থ তাঁদের ক্লাব! গতকাল দুয়োর ভাগটা তাই খেলাইফি ও ক্রীড়া পরিচালক লিওনার্দোও পেয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি তোপটা সহ্য করেছেন মেসি-নেইমার।পিএসজির পাড়ভক্তের চোখে এঁরা দুজন এমন দুই খেলোয়াড়, যাঁরা বছরে ক্লাবের ৮ কোটি ইউরো খসিয়ে নিচ্ছেন মাত্র ১২ গোলের বিনিময়ে। তার কাছে মেসি-নেইমারের অতীত সাফল্য মূল্যহীন। সে যে সাফল্যের ভাগ তাঁরা পাননি, সে সাফল্যের জন্য দুয়ো দেওয়াতে তাই তাঁর কোনো বাধা নেই।

By নিজস্ব প্রতিবেদক

রংপুরের অল্প সময়ে গড়ে ওঠা পপুলার অনলাইন পর্টাল রংপুর ডেইলী যেখানে আমরা আমাদের জীবনের সাথে বাস্তবঘনিষ্ট আপডেট সংবাদ সর্বদা পাবলিশ করি। সর্বদা আপডেট পেতে আমাদের পর্টালটি নিয়মিত ভিজিট করুন।

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *