মানসা মুসা : বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী

মানসা মুসা : বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী ! জেফ বেজোস, বিল গেটস, ওয়াল স্ট্রিট ও বিগ টেকের এই যুগে বর্তমান সময়ের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর সময়ের কথা কল্পনা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেন, আধুনিক সব বিলিয়নেয়ারদের চেয়ে মানসা মুসার সম্পদ ছিল ঢের বেশী।

কিন্তু এই মানসা মুসা কে ছিলেন?

মানসা ছিলেন মালি সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সান্দিয়াতা কেইতার ভাগ্নে। মানসা মুসা ১৪ শতাব্দীতে মালি শাসন করেন। ১৩০৭ সালে তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন।

মানসা মুসার কাছে এত পরিমাণ স্বর্ণ ছিল যে, তিনি তার রাজ্য থেকে ১০ কিলোমিটারের একটি পথ স্বর্ণ দিয়ে ঢেকে দিতে পারতেন। বিশাল পরিমাণ স্বর্ণের অ্যাকসেস থাকা তাকে নিঃসন্দেহে বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত করে।

সম্পদ অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। কিন্তু মুসার সম্পদ এবং সাম্রাজ্য দুটোই রক্ষা করার জন্য ছিল বিশাল এক বাহিনী। অনেকটা আজকের দিনের সেনাবাহিনীর মতোই। তার এই বাহিনীর সদস্য ছিল দুই লাখ! যার মধ্যে ৪০ হাজার সৈন্য ছিলেন তির চালনায় অতি দক্ষ।

মালি সাম্রাজ্যের মধ্যে ছিল এমন জমি যা এখন গিনি, সেনেগাল, মৌরিতানিয়া, গাম্বিয়া এবং আধুনিক মালি রাজ্যের অংশ। তৎকালীন মালি ছিল অত্যন্ত অগ্রসর। রাজ্যটি সোনা, লবণ, কোলা বাদাম এবং হাতির দাঁতে সমৃদ্ধ ছিল। ভূমধ্যসাগরের বাজারে এসবের চাহিদাও ছিল ব্যাপক। কিন্তু তার চেয়েও বড় ব্যাপার হচ্ছে, মালি পেয়েছিল মানসা মুসার মত প্রতিভাবান ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক।

মানসা শব্দের অর্থ সুলতান, বিজেতা বা “সম্রাট”। মানসা মুসা : বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী, পশ্চিম আফ্রিকার ইসলামি মালি সাম্রাজ্যের দশম রাজা মুসা কিতাকে এই উপাধি দেওয়া হয়। তিনি ১৩১২ সাল থেকে ১৩৩৭ সাল পর্যন্ত মালি শাসন করেন।

আমাদের দৃষ্টিকোণে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, মালি ছিল একটি মুসলিম সাম্রাজ্য। এটিই মালিকে বিশাল ইসলামি সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে তোলে।

মালি, উত্তর আফ্রিকা, স্পেন মিশর এবং আরবের মধ্যে বাণিজ্য অবাধে প্রবাহিত হয়। মুসলিম ব্যবসায়ীরা তাদের কাফেলা নিয়ে স্পেন থেকে পিতলের কাজ, মিশর থেকে ব্রোকেড, ভারত থেকে মূল্যবান পাথর নিয়ে মরুভূমিতে পাড়ি দেয়। সোনা, লবণ, কোলা বাদাম এবং আইভরি নিয়ে ফিরে তারা আসে। আফ্রিকানরা হজের জন্য মক্কায় ভ্রমণে যেত এবং বাগদাদ, কায়রো এবং কায়রোওয়ানে রচিত বই আফ্রিকায় নিয়ে আসত।

পশ্চিম আফ্রিকায়, বিশেষ করে মালি ও ঘানার সাম্রাজ্যে ইসলামের প্রসার এবং ইসলামিক শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় ইসলামি ফিকহবিদরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই ফকিহরা তাদের ইসলামি ফিকহ সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ছিলেন। তারা কাজি, আলিম ও শিক্ষক হিসাবে সমাজে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতেন।

ফকিহদের পাশাপাশি আফ্রিকান সৈন্যরাও ইসলামের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তারা মুসলিম সেনাবাহিনীর একটি অংশ ছিল। তাদেরকে স্পেন, মিশর ও ভারতের মতো নতুন অঞ্চল জয় করতে পাঠানো হয়েছিল। এসব সৈন্যদের নিয়োগ দেওয়া হতো স্থানীয় জনগণদের মধ্য থেকে। তাদের সামরিক কৌশল ও ইসলামি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করা হতো। তারা এসব এলাকায় ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠায় এবং তাদের বিজয়ের মাধ্যমে ইসলামের প্রসারে সহায়তা করে।

মানসা মুসা: সর্বকালের সেরা ধনী যে মুসলিম শাসক

মানসা মুসা: সর্বকালের সেরা ধনী যে মুসলিম শাসক, ইসলাম যদি মোজাইক হয় তাহলে মালি ছিল তার একটি অংশ। ভূমিকা রাখছিল এশিয়া ও ইউরোপের সমৃদ্ধিতে।
ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে মানসা মুসা কিন্তু তার সাম্রাজ্যের মধ্যে ইসলামের বিকাশে প্রচুর সময় ব্যয় করেছিলেন। মানসা মুসা : বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী, তিনি চেয়েছিলেন মালি যেন আফ্রিকার জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র হয়। চেয়েছিলেন সবার মনোযোগ যেন থাকে মালি সাম্রাজ্যের প্রতি।

মানসা মুসার সাম্রাজ্যে আরোহণ ছিল বেশ রহস্যজনক। তাঁর আগে মালি সাম্রাজ্য শাসন করছিলেন মানসা আবু বকর দ্বিতীয়। ১৩১৩ সালে তিনি বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে যান এবং আর কখনো ফিরে আসেননি। এভাবেই মুসা কিতা সিংহাসনে আরোহণ করেন।

এর পরপরই তিনি হজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। মালির আলিমদের সহায়তা নেন তিনি। কোন কোন শহর তিনি অতিক্রম করবেন, কীভাবে মক্কায় যাবেন সেগুলোর ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য আহরণ করেন।

ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী মানসা মুসা যা করতেন

ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী মানসা মুসা যা করতেন, মিশরের মধ্য দিয়ে তার যাত্রা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। মানসা মুসা : বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী, তৎকালীন আরব লেখকরা বর্ণনা করেছেন যে, তিনি হাজার হাজার লোকের এক বহর এবং কয়েক ডজন উট নিয়ে ভ্রমণ করছিলেন। যার প্রতিটিতে ছিল 136 কিলোগ্রাম (300 পাউন্ড) সোনা।

মানসা মুসা মিশরে পৌঁছানোর পর পিরামিডের কাছে ক্যাম্প করেন। মানসা মুসা : বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী, কায়রোতে তিন মাস থাকার আগে তিনি মিশরের সুলতানের কাছে পঞ্চাশ হাজার দিনার উপহার পাঠান। সুলতান তাঁর প্রাসাদে মানসা মুসাকে থাকতে দেন। নিশ্চিত করেন যেন মানসা মুসার বহরের সাথে সুন্দর আচরণ করা হয়।

মানসা মুসা হাজার হাজার সোনা বিলিয়ে দেন। মিশরীয় ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ গ্রহণ করে এবং তাদের পণ্যের দাম স্বাভাবিক মূল্যের তুলনায় পাঁচগুণ করে ধরে। মিশরে সোনার দাম পড়ে যায় প্রায় ২৫ শতাংশ। মানসা মুসা : বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী, মানসা মুসা এত পরিমাণ সোনা দান করেছিলেন যে তার প্রভাব কায়রোর অর্থনীতিতে কয়েক বছর পরেও দেখা যাচ্ছিল।

আরব-মিশরীয় আলিম আল উমারি মানসার ভ্রমণের ১২ বছর পর কায়রোতে যান। তিনি দেখেন তখনও মানুষ মানসা মুসার প্রশংসা করছে। এমনটাই ছিল তাঁর উদারতার প্রভাব। তিনি এত বেশী স্বর্ণ ব্যয় করেছিলেন যে কায়রোর মার্কেট সোনায় ছেয়ে গিয়েছিল।

মানসা মুসা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সাম্রাজ্যিক শক্তি ব্যাপকভাবে সম্মানিত ছিল। সমগ্র আফ্রিকাই তাঁকে ভয় করত।
অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদিতে মুসা মালিকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে ১৩৭৫ এর কাতালান অ্যাটলাস ম্যাপে দেখা গেল এক আফ্রিকান রাজাকে; যিনি সোনার সিংহাসনে বসে আছেন হাতে স্বর্ণ নিয়ে। টিম্বাটুকটু তাই আফ্রিকার এল ডোরাডো হয়ে উঠল এবং দূর দূর থেকে লোক হাজির হলো টিম্বাকটুতে।

উনিশ শতকেও কিন্তু টিম্বাকটু তার সোনালী অতীতের গল্প ছড়িয়ে যাচ্ছিল। আর তাতে আকৃষ্ট হয়ে ইউরোপের ভাগ্যান্বেষী ও অভিযাত্রীরা এসে হাজির হচ্ছিল টিম্বাটুতে।

বিখ্যাত পর্যটক ইবনু বতুতা মানসা মুসার সাম্রাজ্য ভ্রমণে যান ১৩৫৪ সালে। তিনি আফ্রিকানদের ধর্ম পালনের প্রতি নিষ্ঠা, বিশেষ করে সালাত আদায়ে সময়ানুবর্তিতা ও দৃঢ়তা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি আরও উল্লেখ করেছেন যে, মালির জনগণরা কুরআন শেখায় ও তিলাওয়াতে প্রচুর আগ্রহী ছিল।

স্যাঙ্কোর বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ জনপ্রিয় ও বিকাশমান ছিল। স্যাঙ্কোর মাদ্রাসা বা স্যাঙ্কোর বিশ্ববিদ্যালয় মালির টিমবুকতুতে অবস্থিত তিনটি প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে একটি।

স্যাঙ্কোর বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এক জ্ঞানকেন্দ্র। মানসা মুসা : বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী, যার লাইব্রেরি তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিতে পরিণত হয়। সেখানে ৪ লাখ থেকে ৭ লাখের মতো পাণ্ডুলিপি ছিল। আফ্রিকার সেরা লাইব্রেরি ছিল এটি।

আর আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির পর বিশ্বের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ লাইব্রেরি এটাই ছিল। এখানে অনেক মূল্যবান পাণ্ডুলিপি ছিল। যে পাণ্ডুলিপিগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাহিত হয়েছিল। মাদরাসা ও মসজিদে শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত হত পাণ্ডুলিপিগুলো।

হজে গিয়ে মক্কাবাসীর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন তিনি। হজ থেকে ফেরার সময় তিনি মক্কা থেকে বহু উট বোঝাই করে চিকিৎসা, জোতির্বিদ্যা, দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস, গণিত এবং আইন বিষয়ে প্রচুর বই নিয়ে আসেন।

এছাড়া আফ্রিকায় জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশের জন্য মক্কার সবচেয়ে মেধাবী ও সেরা গণিতবিদ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও স্থাপত্যবিদদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন।

পৃথিবীর সকলের ধনীদের সম্পদ মিলে মানসা মুসার সমান হবে না

পৃথিবীর সকলের ধনীদের সম্পদ মিলে মানসা মুসার সমান হবে না , মানসা মুসা কেবল তার সম্পদের আধিক্যের কারণেই বিখ্যাত ছিলেন না। তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞার সাথে সম্পদ্গুলো ব্যয় করেছিলেন। তার অসীম সম্পদ থাকলেও তিনি মানুষের মধ্যে সেগুলো বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই আনন্দ খুঁজে পেতেন।

টানা ২৫ বছর মালি শাসন করেন মানসা মুসা। বিশ্বের সর্বকালের সর্বোচ্চ ধনী এই ব্যক্তি ১৩৩২ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি প্রচুর ধনী হলেও তার সম্পদের সঠিক পরিমাণ অনির্ণেয়।

মানসার মৃত্যুর সঠিক কোনো কারণ এখনও উদ্ধার করতে পারেননি ইতিহাসবিদরা। মৃত্যুর সাল নিয়েও বিতর্ক আছে। ইতিহাসবিদ ইবনু খালদুনের মতে, কমপক্ষে ১৩৩৭ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তিনি। সুতরাং মৃত্যুর সালটি অনিশ্চিত।
আল্লাহ তাঁর ওপর রহম করুন।

Leave a Comment