কুয়েতে সাজাপ্রাপ্ত লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলামের (পাপুল) বিরুদ্ধে মানব পাচারের মাধ্যমে ৩৮ কোটি ২২ লাখ টাকা আয়ের তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, কুয়েতি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেলে তাঁর অবৈধ অর্থের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
মানব পাচার ও অর্থ পাচারের অভিযোগে ২০২০ সালের ৬ জুন শহিদ ইসলামকে গ্রেপ্তার করে কুয়েত পুলিশ। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে দেশটির একটি আদালত তাঁকে চার বছরের কারাদণ্ড দেন। পরে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত সেই সাজা বাড়িয়ে সাত বছর করেন। এখনো কুয়েতের কারাগারে বন্দী আছেন বাংলাদেশের সাবেক এই সংসদ সদস্য।
শহিদ ইসলাম কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ২০২০ সালের ৭ জুলাই ঢাকার মতিঝিল থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা হয়। কাছাকাছি সময় পল্টন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে আরেকটি মামলা হয়। এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মেহেদী মাকসুদ বলেন, তদন্তে এখন পর্যন্ত শহিদ ইসলামের বিরুদ্ধে ৩৮ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার ৫৬৭ টাকা অপরাধলব্ধ আয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে এই অর্থ অর্জন করেন। এদের ব্যাংক হিসাবে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৩৫৫ কোটি ৮৬ লাখ ২৯ হাজার ৬৭ টাকার লেনদেন হয়েছে। এই টাকার প্রধান উৎস মানব পাচারের মাধ্যমে অর্জিত অপরাধলব্ধ আয়।
সিআইডি সূত্র জানায়, শহিদ ইসলামের ব্যক্তিগত কর্মচারী সাদিকুর রহমান (মনির) দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কুয়েতে পাঠানোর জন্য লোক সংগ্রহ করতেন। জনপ্রতি পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে নিতেন। এসব টাকা তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের রাজারবাগ শাখায় তাঁর ব্যাংক হিসাবে জমা করতেন। ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কুয়েত যেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের দেওয়া ৩৮ কোটি ২২ লাখ টাকা সাদিকুরের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। পরে ওই টাকা শহিদ ইসলাম, তাঁর মেয়ে ওয়াফা ইসলাম, শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের ব্যক্তিগত এবং তাঁদের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। পরে সেসব অর্থ তুলে নেওয়া হয়।
মানব পাচারের মামলায় শহিদ ইসলামের ভাই কাজী বদরুল আলমের (লিটন) জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জব ব্যাংক ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফাকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পরে তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে তিনি স্বীকার করেন, বদরুল আলমের নির্দেশে মানব পাচারের শিকার বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে নিতেন। ওই টাকা বদরুল আলম ও শহিদ ইসলামকে দেওয়ার কথাও তিনি জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন। এই মামলায় শহিদ ইসলাম, তাঁর কর্মচারী সাদিকুরসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে সিআইডি।
সিআইডি সূত্র জানায়, শহিদ ইসলাম ১৯৮৯ সালে একটি প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার (শ্রমিকদের তত্ত্বাবধায়ক) হিসেবে চাকরি নিয়ে কুয়েতে যান। ১৯৯০ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় কুয়েত থেকে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে শহিদ আবার কুয়েতে যান। এরপর ধীরে ধীরে তিনি বিত্তবৈভবের মালিক হতে থাকেন।
টাকার জোরেই ২০১৮ সালের নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসন (রায়পুর-লক্ষ্মীপুর সদরের আংশিক) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শহিদ ইসলাম। পরে স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও একইভাবে সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য বানান। স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচিত চার সংসদ সদস্য সংরক্ষিত নারী আসনের একটি ভাগে পেয়েছিলেন। তাতেই সেলিনা ইসলামকে মনোনীত করা হয়।
শহিদ ইসলাম, স্ত্রী সেলিনা ইসলাম, মেয়ে ওয়াফা ও শহিদ ইসলামের শ্যালিকা জেসমিন প্রধানের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর ২ কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে দুদকও মামলা করেছিল। অনুসন্ধান চলাকালে তাঁদের ৬১৭টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছিল। পরে তাঁদের বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা করেছিল দুদক।
মামলাগুলোর তদন্তের অগ্রগতি বিষয়ে ২০২১ সালের অক্টোবরে দুদকের তৎকালীন বিশেষ মহাপরিচালক সাঈদ মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, চারটি মামলারই তদন্ত প্রায় শেষ। শিগগিরই আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হবে। তবে এরপর দেড় বছরেও এসব মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন গত বুধবার বলেন, মামলাগুলো তদন্তাধীন। তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
আর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে কুয়েতে শহিদ ইসলামের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়েছে। সেখান থেকে তথ্য পাওয়া গেলে তাঁর অপরাধলব্ধ আয়ের পরিমাণ বেড়ে যাবে। তখন মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া যাবে। এরপর শহিদ ইসলামকে কুয়েত থেকে ফেরত আনার চেষ্টা করা হবে।