মাত্র দেড় ঘণ্টায় নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন পাড়ি

দ্রুতগতিতে ভ্রমণের ক্ষেত্রে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। কনকর্ড উড়োজাহাজ বন্ধ হওয়ার প্রায় দুই দশক পর থেকে সুপারসনিক গতির উড়োজাহাজ নিয়ে আলোচনা চলছে। বেশ কয়েকটি দ্রুতগামী উড়োজাহাজ তৈরির কাজও চলছে। কিন্তু এয়ারলাইনসগুলো তাতে সন্তুষ্ট নয়। তারা আরও নতুন উড়োজাহাজ নিয়ে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। তারা চাইছে হাইপারসনিক গতির উড়োজাহাজ। হাইপারসনিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে উড়োজাহাজের গতি দাঁড়ায় ম্যাক ৫। অর্থাৎ শব্দের গতির চেয়ে পাঁচ গুণ গতিতে চলতে পরে উড়োজাহাজ। এ ধরনের একটি উড়োজাহাজে নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন পাড়ি দিতে দেড় ঘণ্টা লাগতে পারে। এই দুই শহরের দূরত্ব ৩ হাজার ৪৭০ মাইল।

কনকর্ডের ক্ষেত্রে লাগত তিন ঘণ্টা। সাধারণ যাত্রীবাহী জেট বিমানে ছয় থেকে সাত ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হাইপারসনিক এই উড়োজাহাজ কি তৈরি করা করা যাবে এবং তাতে ভ্রমণ করা কি সম্ভব?

মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টাভিত্তিক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বা স্টার্টআপ হার্মিউসের লক্ষ্য হচ্ছে হাইপারসনিক উড়োজাহাজ তৈরি করা। তারা মনে করছে, শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ দ্রুতগতিতে ছুটতে পারে, এমন উড়োজাহাজ তৈরি করা সম্ভব। তারা নতুন ধরনের ইঞ্জিন নিয়ে ইতিমধ্যে পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালিয়েছে। এই ইঞ্জিনের ম্যাক ৫ (ঘণ্টায় তিন হাজার কিলোমিটারের বেশি) পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। এই ইঞ্জিনের নকশা করা হয়েছে ছোট ও মনুষ্যবিহীন উড়োজাহাজের জন্য।

হার্মিউস বর্তমানে মার্কিন বিমানবাহিনীর জন্য এ ধরনের ইঞ্জিন তৈরির কাজ করছে। তাদের দাবি, ইঞ্জিনের আকার বড় করা হলেই তা যাত্রীবাহী বিমান চালাতে সক্ষম হবে।

সিএনএন বলছে, এ ধরনের হাইপারসনিক যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের নাগাল পেতে এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। তবে হার্মিউস আশা করছে, এই দশক শেষ হওয়ার আগেই তারা হাইপারসনিক উড়োজাহাজের পরীক্ষা শুরু করতে পারবে। তার জন্য ২০২৯ সাল পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। ওই সময়ের মধ্যে প্রযুক্তি পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে। হার্মিউস বাণিজ্যিকভাবে উড়োজাহাজ তৈরির পরিকল্পনা ঠিক করে রেখেছে।

শুরুতে বর্তমান এয়ারলাইনসগুলোকে ব্যবহৃত উড়োজাহাজের চেয়ে অনেক ছোট হবে হার্মিউসের উড়োজাহাজ। এমনকি তা ১০০ যাত্রী পরিবহনে সক্ষম কনকর্ডের চেয়ে আকারে ছোট হবে। হার্মিউসের প্রধান নির্বাহী এ জে পিপলিকা বলেন, ‘উড়োজাহাজের আকার নির্ধারণ করার জন্য আমরা মূলত একটি বিমান সংস্থার জন্য ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করেছি। আমরা ব্যবসায়ী শ্রেণি এবং প্রথম শ্রেণির ভ্রমণকারীদের ওপর গুরুত্ব দিয়েছি। এরপর আমরা গতি ও পরিচালনা ব্যয়ের বিষয়গুলোর মতো কিছু পরিমিতি নির্ধারণ করেছি। তা থেকে আমরা বুঝতে পেরেছি, এমন একটি উড়োজাহাজ প্রয়োজন, যাতে ২০ যাত্রীর একটি কেবিন থাকে।’

অর্থাৎ একটি উড়োজাহাজে কেবল একটি শ্রেণি থাকবে। পিপলিকা বলেন, ‘আমরা আশা করি, এটি আজকের ব্যবসায়িক শ্রেণির দামে লাভজনক হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, পাঁচ গুণ দ্রুতগতিতে ওড়ার জন্য মানুষ কত টাকা দিতে প্রস্তুত হবে, তার হিসাব করা কঠিন।’

সিএনএন বলছে, প্লেনের পরিসীমা হবে প্রায় চার হাজার নটিক্যাল মাইল। এটি নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসের মতো ট্রান্স অ্যাটলান্টিক পথের জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে টোকিওর মতো ট্রান্স প্যাসিফিক পথের জন্য এটি যথেষ্ট নয়। এ পথে বিরতির প্রয়োজন পড়বে।

যাত্রীবাহী ম্যাক ৫ উড়োজাহাজের গতি কেমন হবে, তা বুঝতে উড়োজাহাজের গতির রেকর্ডের দিকে নজর দেওয়া যায়। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দ্রুতগতির উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের গতি উঠেছিল ম্যাক ৯ দশমিক ৬ (ঘণ্টায় প্রায় ৬ হাজার ৮০০ মাইল)। নাসার এক্স-৪৩এ নামের একটি মনুষ্যহীন উড়োজাহাজে ওই গতি ওঠে। এ উড়োজাহাজের দৈর্ঘ্য ছিল ১২ ফুট।

তবে ওই ফ্লাইটের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তবে ম্যাক ৫ গতি সবচেয়ে বেশিক্ষণ ধরে রেখেছিল বোয়িং এক্স-৫১ নামের একটি মনুষ্যবিহীন পরীক্ষামূলক উড়োজাহাজ। ২০১৩ সালে ওই উড়োজাহাজটি ম্যাক ৫ দশমিক ১ (ঘণ্টায় প্রায় ৩ হাজার ৪০০ মাইল) গতিতে তিন মিনিট উড়েছিল। দুটি উড়োজাহাজকেই বি-৫২ বোম্বার নামের একটি উড়োজাহাজ থেকে নির্দিষ্ট উচ্চতা থেকে ছাড়া হয়েছিল।

যাত্রীবাহী উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে গতির রেকর্ড হচ্ছে ম্যাক ৬ দশমিক ৭ (ঘণ্টায় ৪ হাজার ৫২০ মাইল)। এক্স-১৫ নামের একটি উড়োজাহাজ এই গতি তুলতে সক্ষম হয়। এটি ছিল মূলত একট রকেট, যার সঙ্গে আসন বসানো ছিল। রকেট ছাড়া জেট ইঞ্জিনচালিত উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে গতির রেকর্ড সর্বোচ্চ ম্যাক ৩ দশমিক ৩, যা ১৯৭৬ সালে একটি সামরিক গোয়েন্দা বিমান এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড তুলতে সক্ষম হয়েছিল।

কনকর্ডের ক্ষেত্রে দুটি যাত্রীবাহী সুপারসনিক উড়োজাহাজের একটি বাণিজ্যিকভাবে ওড়ার সময় ম্যাক ২ দশমিক ০৪ (ঘণ্টায় ১ হাজার ৩৫০ মাইল) গতি তুলতে সক্ষম হয়।
হার্মিউসের প্রস্তাবিত উড়োজাহাজ প্রকল্প সফল হলে তা কনকর্ডের গতি সহজেই পেরিয়ে যাবে। এটি শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি গতিতে উড়তে সক্ষম হবে।

তাই হার্মিউসের নির্মাতারা এখন ইঞ্জিনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। নতুন ধরনের ইঞ্জিন নিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়েছে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে। জেনারেল ইলেকট্রিকের তৈরি ফাইটার উড়োজাহাজের মডেলের ওপর ভিত্তি করে এ ইঞ্জিন তৈরির কাজ চলছে। এটি হবে প্রচলিত দুই ধরনের প্রযুক্তির হাইব্রিড মডেল। একটি হচ্ছে প্রচলিত এয়ারলাইনসগুলোর ব্যবহৃত টার্বোজেট ও সুপারসনিক গতির জন্য ব্যবহৃত র‌্যামজেট প্রযুক্তি। শুরুতে মার্কিন বিমানবাহিনীর সঙ্গে যৌথভাবে ছয় কোটি মার্কিন ডলারের হাইপারসনিক ড্রোন কোয়ার্টারহাউসে এটি ব্যবহৃত হবে।

Leave a Comment