ব্রেকআপ! অতঃপর একাকিত্ব? তাহলে এই লেখাটি আপনারই জন্য।

শরতের স্নিগ্ধ বিকেলে প্রকৃতি যেমন এক অপরূপ সাজ বরণ করে, বিয়ের আগেই লাল বেনারসি পরে তোমার জন্য ঠিক তেমনই অপরূপা সাজতো ডানাকাটা এক পরী। সেজেগুজে নদীর ধারে পার্কের বেঞ্চিতে ঠিক তোমার মুখোমুখি হয়ে বসতো। মুক্তোর দানার মতো দাঁত বের করে ফিক করে হেসে দিয়ে গোগ্রাসে ফুচকা গিলতো সে। তুমি মিটিমিটি হেসে উদাস হতে।
.
অতঃপর নৌকাবিলাসে ভালোবাসার রং থেকে আরও কিছু রং ধরা দিত তোমার জীবনে। পালতোলা নৌকার গতিহীন ঘুরপাকে হঠাৎ চোখ পড়তো প্রিয়তমার চোখে। পাখির নীড়ের মতোন চোখওয়ালী সেই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে তোমার কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে হতো জীবনের সবকটা বিকেল।
.
সন্ধ্যায় ফেরার পথে রিকশা না পেলে মন খারাপ হলেও অখুশি হতে না তুমি। হাতে হাত রেখে টাউনহল পর্যন্ত পাশাপাশি হেঁটে যেতে বেশ ভালোই লাগতো তোমার। মনে মনে বলতে,
‘তুমি ধরে থাকলে হাত,
বালিকা, একটা জীবন নাহয় এভাবেই কেটে যাক।’
.
সেই তুমিই একদিন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মেয়েটার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দিলে। ব্রেকআপ করলে তোমার মায়াবতীর সাথে।
.
ভালোবাসার দারুণ আকালের এই সময়ে রাজকন্যার মতো একটা মেয়েকে ছেড়ে আসা চাট্টিখানি কথা না। আল্লাহ তোমাকে দৃঢ়পদ রাখুন। যেই দিন যেই মুহুর্ত থেকে তুমি হারাম রিলেশান থেকে ফিরে এসেছ, সেইদিন সেই মুহুর্ত থেকেই তুমি এক মহাশত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছ। সেই শত্রু তার সৈন্যসামন্ত নিয়ে এখন তোমার পেছনে লেগেছে। যেকোনো উপায়ে সে তোমাকে পরাস্ত করতে চাইছে। তুমি ভয় পেয়ো না। দাঁতে দাঁত চেপে সিনা টান করে তুমি এগিয়ে যাও।
.
শয়তান মনের মাঝে খচখচানি দেবে—“দে না একটা মেসেজ! তোর বিরহে মেয়েটার মনের অবস্থা কী হতে পারে ভেবে দেখেছিস একবার! তুই তো পারতিস এভাবে ব্রেকআপ না করে মেয়েটাকেও দ্বীনের দাওয়াত দিতে। এখনও সুযোগ আছে। মেসেজ দে একটা। বুঝা মেয়েটাকে।”
.
ভাই আমার, শয়তানের চটকদার কথায় ভুলে যেয়ো না। ভুল করেও এই ভুল কাজটির পুনরাবৃত্তি কোরো না। তাহলে এই লুপ থেকে কখনোই বের হতে পারবে না। বরং মেয়েটার ফোন নাম্বার ডিলিট করে দাও। ব্ল্যাকলিস্টে ফালাও। ফেসবুকে ব্লক দাও। কমপক্ষে মেসেজ ব্লক দিয়ে আনফ্রেন্ড করে ফেল। সবগুলো দরোজা বন্ধ করে দাও। শয়তানকে দ্বিতীয়বার প্রবেশের সুযোগ দিয়ো না।
.
ফ্রেন্ডলিস্টের গাইর মাহরাম মেয়েদের আনফ্রেন্ড করো। কেননা তাদের আইডি সামনে পড়লে ‘তার’ কথা মনে পড়তে পারে। তা ছাড়া এরাও তোমার জন্য ফিতনার কারণ হতে পারে। দরোজা বন্ধ করে দাও।
.
এগুলো করার পর দেখবে এক অনিবার্য একাকিত্ব তোমার সঙ্গী হয়েছে। এই একাকিত্ব উপভোগের সেরা উপায় হতে পারে রবের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা। নিয়মিত সালাতের পাশাপাশি তরজমা-সহ কুরআন তিলাওয়াত করা। নিয়মিত তরজমাসহ কুরআন পড়লে সবরের অনেক উপাদান পাবে। নিঃসন্দেহে কুরআনি মোটিভেশান সর্বোত্তম মোটিভেশান। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার দারুণ সুযোগ এটা।
.
আর যখন আল্লাহর সাথে তোমার সম্পর্ক ভালো হবে তখন দুনিয়ার কোনো কষ্টই কষ্ট মনে হবে না। কোনো না পাওয়ার সম্ভাবনাই তোমাকে পেরেশান করতে পারবে না। হারিয়ে ফেলা প্রিয় কিছু তোমাকে ব্যথিত করবে না। শত মানুষের ভিড়ে নিজেকে আর একা মনে হবে না।
.
তুমি দেখো, আল্লাহর স্মরণে দুনিয়ার সমস্ত দুঃখ আর নীল বেদনা তুমি ভুলে যাবে। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক ভালো হলে তুমি এমন এক অপার্থিব প্রশান্তি অনুভব করবে, যা তোমার সমস্ত না পাওয়ার বেদনা ভুলিয়ে দেবে। ওয়াল্লাহি! শয়তানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তুমি শুধু আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করেই দেখো না! এক জান্নাতি আবেশে ভরে যাবে তোমার মন, মনন এবং জীবন।
.
পাশাপাশি তুমি আরও কিছু কাজ করবে—

১. উত্তম বন্ধু নির্বাচন করে নাও। এমন বন্ধু, যাদের সাথে সময় কাটালে তোমার মন ভালো হয়ে যাবে, ঈমান-আমলে অগ্রগতি আসবে।
২. ওইসব বন্ধুদের সঙ্গ ত্যাগ করো, যারা তোমার অতীত মনে করিয়ে দিয়ে মনখারাবি বাড়িয়ে দেয়।
৩. মেয়েটির সাথে দেখা হতে পারে এমন রাস্তা এড়িয়ে চলো। সম্ভব হলে ওই এলাকা ছেড়ে দূরে কোথাও বাসা/মেস নাও। কথায় আছে—‘Out of sight, out of mind.’
৪. নজরের হিফাযত করে চলো। খিয়ানত হলে নিজেই নিজের জরিমানা করো। হতে পারে তা মাত্র ৫/১০ টাকা। তাহলে পরবর্তীতে খিয়ানত হবার সম্ভাবনা কমে যাবে ইন শা আল্লাহ।
৫. অনলাইন-অফলাইন সব জায়গায় গাইর মাহরাম মেয়েদের সঙ্গ এড়িয়ে চলো। এটা খুব বেশি জরুরি।
৬. গান শোনা বা নাটক-সিনেমা দেখার অভ্যাস থাকলে ছেড়ে দাও। এগুলো তোমার মনখারাবি আর গুনাহের পাল্লা ভারী করা ছাড়া কিছুই করে না। বিপরীতে কুরআন তিলাওয়াত শোনার অভ্যাস করো। মিউজিকবিহীন নাশীদও শুনতে পারো।
৭. ভালো কাজে সময় ব্যয় করো। বন্ধুরা মিলে সমাজের অসহায়-দুস্থ মানুষদের জন্য কাজ করো। নিজেকে ব্যস্ত রাখো। জানোই তো, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।

৮. ফেসবুকে সময় কম দাও। পড়াশোনা বাড়াও। জ্ঞান অর্জন করো। দ্বীনি-দুনিয়াবি দুটোই।
৯. সকাল-বিকাল খেলাধুলা বা হালকা ব্যায়াম করতে পারো। এটা শরীর এবং মন উভয়ই ভালো রাখতে সহায়তা করে।
১০. এই সময়ে খুব বিয়ে করতে ইচ্ছে করবে। ফ্যান্টাসিতে না ভোগে বাস্তবভিত্তিক প্রস্তুতি নাও। টিউশানি করাও। বাসায় বিয়ের প্রয়োজনীয়তা বুঝাও।
১১. পরিবারের সাথে মাঝেমধ্যে খোশগল্প করো। মেসে থাকলে ফোনে কথা বলো। মন ভালো থাকবে।
১২. এবং আবারও বলছি, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক মজবুত করো।
.
ইন শা আল্লাহ, এগুলো মেনে চলতে পারলে তোমার অন্তরে আর জন্ম নেবে না ‘পেয়ে হারানোর’ কোনো বেদনা।
.
তারপরও নিয়তির ফেরে কখনো হয়তো মুখোমুখি হয়ে যাবে ‘তার’। কখনোবা মনে পড়ে যাবে সিলভার ক্যাসেলে কংক্রিটের ছাতার নিচে বসে আইসক্রিম খাওয়ার কথা অথবা নদীর ওপারে বাতাসে দোল খেতে থাকা কাশফুলের সৌন্দর্যে বিভোর হওয়া সেই বিকেলের কথা। ইচ্ছে করবে লিখতে ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতা। তুমি পাত্তা দিয়ো না। সবর করো।
.
ভাই আমার, তুমি তো আল্লাহর জন্য বড়ো একটি স্যাক্রিফাইস করেছ। এখন শুধু তাতে অবিচল থাকো আর তোমার রবের আনুগত্য করে চলো। দুনিয়ার এই বেদনাগুলো চিরস্থায়ী না। সবর করো।
.
তোমার এই সবরের প্রতিদান তুমি অবশ্যই পাবে। যেইদিন তোমার রব তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, ডাগর-নয়না হুরদের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবেন, সেইদিন তুমি দুনিয়ার এই কষ্টগুলোর কথা, মনখারাবির কথা একদম ভুলে যাবে। ভুলে যাবে তোমার একটি মায়াবতী ছিল। তোমার একটি মায়াবতী হারানোর গল্প ছিল!
.
ইন শা আল্লাহ!

 

(সংগ্রহীত)

By মেহেজাবীন শারমিন প্রিয়া

My name is Mahazabin Sharmin Priya, and I am an author who studied Mathematics at the National University. I have a deep passion for writing in various genres, including Islam, technology, and mathematics. With my knowledge and expertise, I strive to provide insightful and engaging content to readers in these areas.

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *