ব্যাকগ্রাউন্ডে সারি সারি বই সাজানো দেখাতে পারলে বিজ্ঞ

টেলিভিশনে টক’শো দেখছিলাম। দুই জন অতিথি এসছেন কথা বলতে। একজন বিশিষ্ট সাংবাদিক। আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট শিক্ষক। এরা দুজনেই ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছেন।


হঠাৎ আবিষ্কার করলাম এদের দুজনের পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডে সারি সারি বই সাজানো। আমি ভাবছিলাম- দুই পেশার দুই জনের মাঝে এতো মিল!


এর খানিক বাদে আরেকজন যুক্ত হলেন। ইনি অবশ্য পুলিশ অফিসার। অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম- উনার পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডেও সারি সারি বই সাজানো! আমার চোখ তো কপালের উঠার জোগাড়।


তিনজন অতিথির সবার পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ড একই রকম। পেছনে বইয়ের শেলফ এবং সেখানে সারি সারি বই সাজানো।
এরপর নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছি- সম্পূর্ণ ভিন্ন তিন পেশার ভিন্ন তিনজন মানুষের কেন মনে হলো পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডে সারি সারি বই থাকা ভালো হবে?


উনারা তো চাইলে বইয়ের শেলফের সামনে না বসে অন্য কোথাও বসতে পারতেন! কেন এনারা সবাই পেছনে সারি সারি বই আছে; এই দৃশ্য দেখাতে চাইলেন?


এরপর মনে হলো- বই দেখাতে পারলে হয়ত নিজেকে বিজ্ঞ হিসেবে প্রমাণ করা সম্ভব।
ভাবলাম- যাক, বেশ বিজ্ঞ একটা আলোচনা হবে। তো, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক আলোচনা করছেন- করোনাকালীন বাস ভাড়া নিয়ে।
তিনি একটা হিসাব করে দেখালেন- বাসে অর্ধেক মানুষ থাকলেও নাকি বাস মালিকরা বেশি আয় করছেন। আমার নিজেরও তাই ধারণা। তবে আমার ধারণা বাস গুলো অর্ধেক মানুষ না নিয়ে পুরো বাস ভর্তি করেই নিচ্ছেন! এই জন্য বেশি লাভ করছেন।
কিন্তু এই অধ্যাপক রীতিমত একটা সমীকরণ হাতে করে নিয়েই এসছেন এই টক’শোতে। সেখানে তিনি যোগ-বিয়োগ করে দেখিয়েছেন- অর্ধেক মানুষ নিলেও নাকি মালিকদের লাভ বেশি হচ্ছে। তিনি কি কি যেন বলছিলেন; এই যেমন আগে ভাড়া ছিল এক হাজার টাকা। এখন হয়েছে ১৬০০ টাকা। আগে যদি ২৮ সিটে মানুষ নিত; এখন নেয় ১৪ সিটে। তাহলে তো হিসাব করলে দেখা যায় এখনই বেশি লাভ হচ্ছে ইত্যাদি বলে তিনি রীতিমত বিপ্লব করে ফেলছেন টকশো’তে।
এর মাঝে আমি হিসাব করে দেখি- কই, নাতো! আমার তো হিসাব মিলছে না। টেলিভিশনে চ্যানেলে এই নিয়ে মেসেজ পাঠাবো ভাবছি; ঠিক তখনই দেখি অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বলছেন- আমাদের সহকর্মীরা হিসাব করে দেখেছে এটি আসলে ভুল হিসাব!
এই নিয়ে তুমুল আলোচনার মাঝেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন বাস মালিক সমিতির প্রধান। আমার চোখ আবার কপালে উঠার জোগাড়! উনার ব্যাকগ্রাউন্ডেও সারি সারি বই সাজানো!
ভাবছিলাম এরপর শ্রমিক নেতা আসবে না? অপেক্ষায় ছিলাম আসে কিনা। খুব দেখার ইচ্ছা ছিল- শ্রমিক নেতার ব্যাকগ্রাউন্ডেও সারি সারি বই সাজানো থাকে কিনা
অনুষ্ঠান শেষ হবার পর বার বার মনে হচ্ছিলো- সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গা থেকে যুক্ত হওয়া, সম্পূর্ণ ভিন্ন পেশার চার জন মানুষের পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডে সারি সারি বই সাজানো থাকবে কেন?
এটি কী কাকতালীয়? কিংবা এরা সবাই কী ভেবেছে পেছনে বই থাকলে সুন্দর দেখাবে? নাকি এরা ভেবেছে বই দেখলে মানুষ তাদের জ্ঞানী মনে করবে?
এইসব ভাবতে ভাবতে মনে হলো- কয়দিন আগে আমী আমেরিকার একজন নামকরা পদার্থ বিজ্ঞানীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি অন-লাইনে। তার পেছনে তো সারি সারি বই ছিল না। উল্টো পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডে খুব জীর্ণ একটা দেয়ালই দেখতে পেয়েছিলাম।
এইতো গতকাল’ই প্রায় বছর দেড়েক পর সরাসরি একটা কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করেছি। বর্তমান পরিস্থিতির কারনে এতদিন সরাসরি সেমিনার-কনফারেন্স প্রায় বন্ধ’ই ছিল। সেখানে তো নামি-দামী অনেক প্রফেসররা এসছেন। কেউ হাফ প্যান্ট পড়ে চলে এসছেন। কেউ একটা সাধারণ টি-শার্ট পড়ে চলে এসছেন।
অথচ যখন কথা বলছিল- মনে হচ্ছিলো কতো কি জানার আছে এদের কাছ থেকে। কতো ইনফরমেশন আছে এদের কাছে। কতো রকম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
আর আমাদের টক’শোতে অংশগ্রহণ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাধারণ যোগ-বিয়োগটা তো করতেই পারলেন না; শুদ্ধ করে বাংলাটাও বলতে পারেন না! কিন্তু গায়ের জোরে নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেন এই বলে- আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক!
যা ইনফরমেশন দিচ্ছে; তার বেশিরভাগ ভুল কিংবা স্বার্থ সংশ্লিষ্ট! এরপরও এরা নাকি জ্ঞানী-গুণী মানুষ!
কারন এই দেশে জ্ঞানী হবার জন্য জ্ঞান অর্জনের দরকার হয় না। চর্চারও দরকার হয় না। সারি সারি বই পেছনে সাজিয়ে রাখলে; কিংবা চশমা পড়ে একটি রাশ ভারি ভাব নিলেই জ্ঞানী হয়ে যাওয়া যায়!
আমার বাসায় কোন বুক শেলফ নেই। সারি সারি বইও নেই। কিন্তু আমার জ্ঞানী হবার বড্ড ইচ্ছা হচ্ছে। ভাবছি পরের বার দোকানে গিয়ে একটা বুক শেলফ আর অনেক গুলো বই কিনে নিয়ে আসব।

Leave a Comment