করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে তিন বছরের বেশি সময় লাগবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপে এমন মতামত তুলে ধরেন তাঁরা। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা বলেছেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় খরচ কমাতে শ্রমিক ছাঁটাই করতে হচ্ছে তাঁদের। পাশাপাশি জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা, আগামী দুই বছরে অর্থনীতিতে বেশ কিছু ঝুঁকির কথাও বলেছেন।সিপিডি গতকাল বুধবার এ জরিপের ফলাফল তুলে ধরে। এ উপলক্ষে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডি কার্যালয়ে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘ব্যবসায় পরিবেশ ২০২১: উদ্যোক্তা মতামত’ শীর্ষক জরিপের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
জরিপে অংশ নেওয়া ৬৮ শতাংশ ব্যবসায়ী, ব্যবসার ক্ষেত্রে দুর্নীতিকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, ব্যবসার জন্য বিভিন্ন পরিষেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁদের আর্থিক লেনদেন করতে হয়েছে। দুর্নীতির পর অদক্ষ আমলাতন্ত্রকে ব্যবসার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী এ মতামত দিয়েছেন। আর ব্যবসার ক্ষেত্রে পুঁজির জোগানের সংকটের কথা বলেছেন ৫৫ শতাংশ ব্যবসায়ী। ৪২ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পরিস্থিতি এখন বেশ চাপে আছে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীরা আগামী দুই বছরে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়া, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি তৈরির হওয়ার আশঙ্কা করছেন।সিপিডি জানিয়েছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত ব্যবসার পরিবেশ নিয়ে ব্যবসায়ীদের মতামতভিত্তিক এ জরিপ করা হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও ফরিদপুর এলাকার ৭৩টি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এ জরিপে অংশ নেয়। এসব প্রতিষ্ঠান কৃষি, সেবা ও উৎপাদনমুখী শিল্পের সঙ্গে জড়িত। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মূলধন ছিল ১০ কোটি টাকার বেশি। সুনির্দিষ্ট ১০টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে জরিপটি পরিচালনা করা হয়।
দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও পুঁজির জোগানের সীমিত সুযোগ—এ তিন চ্যালেঞ্জ ব্যক্তি খাতের জন্য সুখকর নয়। অথচ দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই আসে ব্যক্তি খাত থেকে।এর আগে সর্বশেষ জরিপটি করা হয়েছিল ২০২০ সালে। সেবার ব্যবসার পরিবেশ জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের সিংহভাগই ব্যবসা করার ক্ষেত্রে অদক্ষ প্রশাসনকে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ওই জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীরা দুর্নীতিকে দ্বিতীয় ও পুঁজি বা অর্থায়নের সমস্যাকে তৃতীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেন। আর এবারের জরিপে ব্যবসার প্রধান অন্তরায় হিসেবে শীর্ষে উঠে এসেছে দুর্নীতি।সিপিডি বলছে, দুর্নীতির কারণে বড় ব্যবসায়ীদের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। জরিপে অংশ নেওয়া ৫২ শতাংশ বড় ব্যবসায়ী বলেছেন, দুর্নীতির কারণে তাঁদের ব্যবসা ব্যাহত হয়েছে। আর ১০০ ভাগ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বলেছেন, দুর্নীতির কারণে তাঁদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ীদের কাছে প্রশ্ন ছিল, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কত সময় লাগতে পারে বলে তাঁরা মনে করছেন। জবাবে ৪৫ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, তিন বছরের বেশি সময় লাগবে। তাঁদের হিসাবে, ২০২৫ সালে গিয়ে দেশের অর্থনীতি ক্ষতি কাটিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। আর ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে এক বছরের কম সময় লাগবে।ব্যবসায়ীদের মতামতভিত্তিক জরিপটি করা হয়েছিল করোনাকালে। তাই স্বাভাবিকভাবে ব্যবসায়ীদের কাছে করোনার প্রভাব ও ক্ষতি পোষাতে নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় এ জরিপে। জবাবে ২৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, করোনার প্রভাবে বাধ্য হয়ে তাঁদের খরচ কমাতে হচ্ছে। সে কারণে কমাতে হচ্ছে শ্রমিক। ২২ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, তাঁরা নতুন ক্রেতার সঙ্গে কাজ করছেন। আর ১৯ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা ব্যবসা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।
করোনার ক্ষতি পোষাতে সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, জরিপে সে বিষয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। জবাবে ৬৩ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, সরকারের প্রণোদনা বাস্তবায়নে নজরদারি ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। করোনার কারণে স্বাস্থ্য খাতকে অন্যতম সমস্যাগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া কর হার, কর ব্যবস্থাপনা এবং অদক্ষ শ্রমিককে ব্যবসার পথে নতুন বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।আগামী ১০ বছরে দেশে নতুন বেশ কিছু ব্যবসার খাত তৈরি হবে বলে জরিপে উঠে এসেছে। ৬৭ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন, ডিজিটাল আর্থিক সেবা আরও বিকশিত হবে। দক্ষ মানবসম্পদ খাতকে সম্ভাবনার দ্বিতীয় অবস্থানে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। তৃতীয় অবস্থানে আছে তথ্য-উপাত্ত (ডেটা) ব্যবস্থাপনা।
জরিপের ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দুর্নীতি, অদক্ষ আমলাতন্ত্র ও পুঁজির জোগানের সীমিত সুযোগ—এ তিন চ্যালেঞ্জ ব্যক্তি খাতের জন্য সুখকর নয়। অথচ দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই আসে ব্যক্তি খাত থেকে। উল্লেখিত প্রতিবন্ধকতার কারণে ব্যক্তি খাত সামনে এগোতে পারছে না। তাই আমরা আশা করব, সরকারের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টির দিকে নজর দেবেন।’অনুষ্ঠানে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হচ্ছে। তবে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে সেটি বৈষম্যমূলক। সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ যাদের হাতে যাওয়ার কথা তারা পাচ্ছে না। বরং দুর্নীতি, অদক্ষ প্রশাসন ও টাকা পেতে সীমাবদ্ধতা এ ত্রয়ী চ্যালেঞ্জের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বড় ধরনের চাপে রয়েছে।