বেড-আইসিইউ না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা

ঢাকায় করোনা হাসপাতালে সাধারণ বেড ও আইসিইউর জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। ঈদের পর থেকেই এসব হাসপাতালে শয্যা ও আইসিইউ সংকট দেখা দেয়। গত দু-তিন দিনে তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, গতকাল বুধবারও বিভিন্ন হাসপাতালে শয্যা না পেয়ে অসংখ্য রোগীকে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে দেখা গেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে হাসপাতাল

কর্র্তৃপক্ষ হাসপাতালের সামনে ‘সিট খালি’ নেই জানিয়ে বিজ্ঞপ্তি টানাতে বাধ্য হয়েছে।

বিভিন্ন হাসপাতালের পরিচালকরা দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছেন, সাধারণ বেডে ভর্তি রোগীর ছুটি হলে নতুন রোগী ভর্তি করাতে হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে অপেক্ষমাণ রোগীদের চাপ এত বেশি যে বেশিরভাগ রোগীকেই ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।

সবচেয়ে করুণ দশা আইসিইউর। পরিচালকরা জানিয়েছেন, আইসিইউর রোগী মারা গেলে নতুন রোগী ভর্তি করাতে পারছেন। অন্যথায় রোগী ভর্তি করানো যাচ্ছে না। এমনকি যেসব সরকারি হাসপাতালে করোনা ইউনিট খোলা হয়েছে, সেখানে নতুন করে শয্যা বাড়িয়েও রোগীদের শয্যা সংকুলান করা যাচ্ছে না। হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষ বলছে, ঈদের আগে যেখানে ঘণ্টায় রোগী আসত দুয়েকজনের মতো; এখন সেখানে ঘণ্টায় রোগী আসছেন তিনজনেরও বেশি। ফলে কেবিন ও সাধারণ বেডে ভর্তি হতে অপেক্ষমাণ রোগীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এসব হাসপাতালে আইসিইউ খালি নেই।

এমন অবস্থায় গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জন রোগী শনাক্তের নতুন রেকর্ড হয়েছে। এই প্রথম ১৬ হাজার অতিক্রম করল দৈনিক রোগীর সংখ্যা। এ সময় মৃত্যু হয়েছে আরও ২৩৭ জনের। নতুন আক্রান্তদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ১০ হাজার ৯৮২ জনে। আর আক্রান্তদের মধ্যে ২০ হাজার ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সরকারি-বেসরকারি মিলে ঢাকায় আইসিইউ খালি মাত্র ১০ শতাংশ : ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি ৪৩টি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ও করোনা ইউনিটে ঈদের আগের তুলনায় ঈদের পর ২২ শতাংশ রোগী বেড়েছে। এ সময় বেশি রোগী বেড়েছে আইসিইউতে, ২৭ শতাংশ। ঈদের আগে এসব হাসপাতালের ৬০ শতাংশ বেডে রোগী ভর্তি ছিল, এখন রোগী ভর্তি ৭৩ শতাংশ বেডে এবং ঈদের আগে ৪০ শতাংশ বেড খালি ছিল, এখন খালি আছে মাত্র ২৭ শতাংশ বেড।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীতে সরকারি ও বেসরকারি করোনা হাসপাতালের সংখ্যা ৪৩টি। এসব হাসপাতালের ৫ হাজার ৭৯৯টি বেড আছে। এসব বেডের মধ্যে গতকাল খালি ছিল ১ হাজার ৫৬১ বেড, যা মোট বেডের ২৭ শতাংশ। বাকি ৪ হাজার ২৩৮টি অর্থাৎ ৭৩ শতাংশ বেডে রোগী ভর্তি ছিল।

অন্যদিকে এসব হাসপাতালে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ৮৮৬টি। এর মধ্যে গতকাল খালি ছিল মাত্র ৯৩টি আইসিইউ, যা মোট আইসিইউয়ের মাত্র ১০ শতাংশ। বাকি ৭৯৩টি, অর্থাৎ ৯০ শতাংশ আইসিইউতে রোগী ভর্তি ছিল। অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমন তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, হাসপাতালগুলো থেকে সময়মতো ও সঠিক তথ্য সরবরাহ করা হয় না।

সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ খালি মাত্র ৯টি : রাজধানীতে সরকারি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালের সংখ্যা ১৬টি। এসব হাসপাতালে বেড ৩ হাজার ৮১২টি ও আইসিইউ ৩৭৫টি। এর মধ্যে গতকাল খালি ছিল ১ হাজার ৭৮ বেড ও আইসিইউ মাত্র ৯টি। এই ১৬ হাসপাতালের মধ্যে ১২টিতে কোনো আইসিইউ বেড খালি ছিল না। মাত্র চার হাসপাতালে ৯টি আইসিইউ বেড খালি বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঈদের আগের সপ্তাহের তুলনায় ঈদের পর হাসপাতালের সাধারণ বেডে ভর্তি রোগী ২২ ও আইসিইউতে ৩১ শতাংশ রোগী বেড়েছে।

বেসরকারি ২৭ হাসপাতালের মাত্র ২৪ শতাংশ বেড ও ১৬ শতাংশ আইসিইউ খালি : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজধানীতে বেসরকারি করোনা হাসপাতালের সংখ্যা ২৭টি। বেড ১ হাজার ৯৮৭ ও আইসিইউ ৫১১টি। এর মধ্যে গতকাল সাধারণ বেড খালি ছিল ৪৮৩ ও আইসিইউ ৮৪টি। সে হিসাবে খালি বেডের পরিমাণ মোট বেডের মাত্র ২৪ শতাংশ ও আইসিইউ খালি ১৬ শতাংশ। এসব হাসপাতালের সাধারণ বেডে ঈদের আগের সপ্তাহের তুলনায় ঈদের পরে রোগী বেড়েছে ১২ ও আইসিইউতে রোগী বেড়েছে ২৪ শতাংশ।

বেশিরভাগই গ্রাম থেকে আসা রোগী : শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘গতকাল পর্যন্ত ১০০ সিট বাড়ানো হয়েছে। সেটাও অর্ধেকের বেশি ভরে গেছে। আগামীকালের (আজ) মধ্যে সেটাও ভরে যাবে মনে হচ্ছে। আমরা আরও ১০০ সিট বাড়াব।’ তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগই গ্রামের রোগী। অর্ধেকেরও বেশি মফস্বল থেকে আসা। হিসাব করলে দেখা যাবে ৮০ শতাংশেরও বেশি গ্রামের রোগী। যত রোগী আসছে, ঢাকার নয়, সব বিভিন্ন জায়গায় থেকে। যেমন লক্ষ্মীপুর, রাজশাহীসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রোগী আসছে। আরেকটা দিক হচ্ছে নারী রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ফিমেল ওয়ার্ডে জায়গা দিতে পারছি না।’

ঘণ্টায় ভর্তি হচ্ছে তিনজন করে : শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. খলিলুর রহমান বলেন, ‘এ হাসপাতালে করোনার ৩০০ বেড ছিল। আরও ১০০ বাড়ালাম। সেটাও আজকের (গতকাল) মধ্যেই ভরে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৬২ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় তিনজন করে রোগী ভর্তি হচ্ছে। আজ পর্যন্ত জায়গা দিতে পেরেছি। আগামীকাল (আজ) হয়তো আর পারব না। আইসিইউ বেড ১০টি। সবগুলোতে রোগী। আমরা কভিড এইচডিইউ (হাই-ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট) বেড ১০-১৫টা বাড়াচ্ছি। তিন-চার দিন ধরে রোগী বাড়ছে। ঈদের আগে ২৪ ঘণ্টায় ৩০-৪০ জন ভর্তি হতো।’

ছুটি না হলে নতুন রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এখানেও রোগীর অনেক চাপ বেড়ে গেছে। এখন আইসিইউতে সিট দেওয়া খুবই কষ্টকর। কেবিনও প্রায় পরিপূর্ণ। সেখানেও সিট পাওয়া মুশকিল। ভর্তি রোগীর ছুটি না হলে নতুন রোগী ভর্তি করাতে পারছি না। আর আইসিইউর রোগী মারা না গেলে নতুন রোগীকে আইসিইউ দেওয়া যাচ্ছে না।’

ফিল্ড হাসপাতাল আগামী সপ্তাহের মধ্যেই : বিএসএমএমইউ উপাচার্য বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালে এক হাজার শয্যার করোনা ফিল্ড হাসপাতাল এক সপ্তাহের মধ্যেই চালু করার চেষ্টা করব। আর কোনো কারণে সেটা না পারলে সর্বোচ্চ ১০-১২ দিনের মধ্যেই চালু করা হবে। কিছু জিনিসপত্র কিনতে হবে। আমি মনে করছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিল্ড হাসপাতাল চালু করতে পারব। এখানে হাই-ফ্লো অক্সিজেন, আইসিইউ ও এইচডিইউ থাকবে। জেনারেল বেডও থাকবে।’

রোগী বেড়ে যাওয়ার পেছনে এ উপাচার্য দুটি কারণের কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘আগে গ্রামে আক্রান্ত ছিল না, এখন আক্রান্ত হচ্ছে। গ্রামে যারা আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের বেশিরভাগই টিকা নেয়নি। দ্বিতীয় কারণ হলো গ্রামের মানুষ আক্রান্ত হলেও তা প্রকাশ ও টেস্ট করে না। আক্রান্ত অবস্থায় তারা ঘোরাফেরা করে। তারা উপজেলা হাসপাতালে তখনই যায়, যখন অতিরিক্ত শ্বাসকষ্ট হয়, ফুসফুস সংক্রমিত হয়ে পড়ে। এ কারণে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু হারও বেড়ে গেছে। গ্রাম থেকে আসতে আসতে এত দেরি করে ফেলে যে চিকিৎসা দিয়েও সুস্থ করে তোলা যায় না।’ উপাচার্য বলেন, ‘ঢাকায় এখন গ্রামের রোগীতেই ভরা। বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালেও ৭০ শতাংশ রোগীই ঢাকার বাইরের।’

ডেডিকেটেড হাসপাতালে বেড ফাঁকা নেই : ৫০০ শয্যা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, ‘বেড ফাঁকা নেই। রোগী ছুটি হলে নতুন রোগী ভর্তি করতে পারব। এখানে বেড ৩২০টি। গত দুদিন ধরে বেড না পেয়ে রোগীরা ফিরে যাচ্ছে। আইসিইউ অনেক আগেই ভরে গেছে। সেখানেও কোনো বেড ফাঁকা নেই।’

এমন অবস্থা ঢাকার প্রায় সব কভিড হাসপাতালের উল্লেখ করে এ পরিচালক বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ৫০০ শয্যা কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল, ২৫০ শয্যা শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল প্রায় সব কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের একই অবস্থা। এখন বিশেষায়িত হাসপাতালে কভিড ইউনিটগুলোতে কিছু সিট খালি আছে। যেমন জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতাল, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালে। এসব হাসপাতালে মানুষ করোনার চিকিৎসার জন্য অতটা যেতে চায় না। করোনার চিকিৎসার জন্য যেসব হাসপাতাল জনপ্রিয় হয়েছে, সেসব হাসপাতালে কোনো সিট খালি নেই। মানুষ এসব হাসপাতালেই প্রথমে আসে। সে কারণে এসব হাসপাতালের সিট পূর্ণ হয়ে গেছে। সমস্যা হচ্ছে বাইরের রোগী ঢাকায় আসছে। বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মোট রোগীর ৭০ শতাংশেরও বেশি গ্রাম ও মফস্বল থেকে আসা।’

তিনি বলেন, ‘এসব রোগী সংক্রমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা করে যদি চিকিৎসার আওতায় আসত, তাহলে অবস্থা এতটা খারাপ হতো না। রোগীর সংখ্যাও কমত। কিন্তু সেটা করেনি। জ¦র-সর্দি-কাশি হচ্ছে, ফার্মেসি থেকে ওষুধ এনে খাচ্ছে। তারপর যখন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, তখন হাসপাতালে যাচ্ছে।’

সিট ফাঁকা শুনলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে রোগীরা : ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নাজমুল হক বলেন, ‘এখানে ৭৮০ বেড। এসব বেডে রোগী ভরা। অবস্থা এমন হয়েছে, সকালে যেসব রোগী ছুটি দিই, সেসব বেডে নতুন রোগী ভর্তি করি। দৈনিক ৪০-৫০ জন রোগী ভর্তি করাতে পারছি। ঈদের আগে যত রোগী আসত, সব ভর্তি করাতে পারতাম। বিছানা খালি থাকত। এখন একজন রোগীর ছুটি হলে সে বেডে নতুন রোগী ভর্তি করতে হচ্ছে। এখন বেড না পেয়ে রোগীদের চলে যেতে হচ্ছে। কারণ সকালে যেসব বেড খালি হয়, সেগুলো বিকেলের মধ্যেই ভরে যায়। বাকি রোগীদের ভর্তি করানো যায় না। করোনা রোগীর অক্সিজেন দরকার হয়। সে কারণে অক্সিজেন ছাড়া রোগী ভর্তি করানোর সুযোগ নেই। আইসিইউ বেড খালি নেই।’

তিনি বলেন, ‘সব হাসপাতালে বেড ভর্তি। রোগীরা যেখানে ফাঁকা বেডের কথা শুনছে, সেখানেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। ফাঁকা বেডের তুলনায় রোগী বেশি। ফলে সবাই ভর্তি হতে পারছে না।’

Leave a Comment