বিব্রত হওয়া ছাড়া কি আর কিছু করতে পারে হুদা কমিশন

ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা, প্রাণহানির ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য হুমকি–ধমকি দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বক্তব্য দিচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা। সেসব বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। কিন্তু তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি তাঁদের প্রতি কঠোর কোনো সতর্কবার্তাও দিতে পারেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, ইউপি নির্বাচনে সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা বিব্রত। সিইসি বিব্রতবোধ করার এক দিন পরই নরসিংদীর আলোকবালিতে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় তিনজন নিহত হন। আগামী বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৮৪৮টি ইউপিতে ভোট হবে। এখন পর্যন্ত এই নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় ফরিদপুর, সিলেট, মাগুরা, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। কিশোরগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও শরীয়তপুরের বিভিন্ন ইউপিতে প্রতিপক্ষ প্রার্থীদের প্রকাশ্যে হুমকি–ধমকি দেওয়া হচ্ছে।

৫ নভেম্বর কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার হুমাইপুর ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর এক জনসভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন একে-৪৭ ব্যবহারের হুমকি দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘নৌকার ভোট কাইত্যার (বুথ) তলে হবে না। হবে টেবিলের ওপর এবং ওপেন। যারা কথা শুনবে না তাদের জন্য আছে হয়রানি।’ সংঘাত-সংঘর্ষ, হুমকি–ধমকি চলছে প্রার্থীদের পক্ষে–বিপক্ষে। যাঁরা এসব করছেন, তাঁদের বা প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কি কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে? ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, নির্বাচনী প্রচারে ব্যক্তিগত চরিত্র হনন করে বক্তৃতা করা বা কোনো ধরনের তিক্ত বা কোনো উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ নেই। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে ভোটারদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে কোনো প্রকার বল প্রয়োগ বা অর্থ ব্যয়েরও সুযোগ নেই। কোনো প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচনের আগে এটি অমান্য করলে ছয় মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান আছে।

অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে বা ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকতে বা প্রার্থী হতে বা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে প্ররোচিত বা বাধ্য করার উদ্দেশ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো প্রকার ভীতি প্রদর্শন একটি অপরাধ। এই অপরাধের শাস্তি ছয় মাস থেকে দুই বছরের কারাদণ্ড। মাঠপর্যায়ে নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। মাঠে হুদা কমিশনের প্রতিনিধি রিটার্নিং কর্মকর্তা বা নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এসব অপরাধের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। কিন্তু সে ক্ষমতার প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না। তাহলে ঢাকায় বসে হুদা কমিশনের কি আর কিছুই করার সুযোগ নেই? আইন বিধিবিধান বলছে, আছে। কমিশনের তত্ত্বাবধান, নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে নির্বাচন পরিচালনা করেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। তাহলে কি রিটার্নিং কর্মকর্তা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসির নিয়ন্ত্রণে নেই? যদি সে রকমও হয়, তারপরও অনেক কিছু করার আছে কমিশনের। সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়াও কমিশন যেকোনো সময় নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

কমিশনকে বিশেষ এই ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় বলা আছে, যদি নির্বাচন কমিশনের কাছে সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন অপকর্মের কারণে বা অন্য যেকোনো কারণে ন্যায়সংগত ও নিরপেক্ষভাবে এবং আইন অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করতে পারবে না, তাহলে নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে সামগ্রিক নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারবে। নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম রংপুর ডেইলীকে বলেন, ইসির ক্ষমতা রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে ন্যস্ত, তাঁদের আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নির্বাচন বন্ধ করার বিষয়টি আসে। আজ বুধবার তাঁরা পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বসবেন। এর আগে সর্বশেষ পৌরসভা নির্বাচনেও (২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গত ফেব্রুয়ারিতে চার ধাপে অনুষ্ঠিত) কার্যত দর্শকের ভূমিকায় ছিল ইসি।

ভোটের আগে প্রকাশ্যে হুমকি-ধমকি, প্রকাশ্যে নৌকায় ভোট দিতে বাধ্য করা, সংঘাত, প্রাণহানি, ভোটকেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট ঢুকতে না দেওয়া, পছন্দমতো ভোট দিতে না পারা এবং গোপন বুথে নৌকা প্রতীকের সমর্থকদের অবস্থান নেওয়াসহ নানা অনিয়ম দেখা গেছে সে নির্বাচনে। কিন্তু কোনো ঘটনায় ইসিকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এবারের ইউপি নির্বাচনে বিএনপি নেই। বিএনপিবিহীন এই নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতা ও প্রাণহানি বেড়ে গেছে। সামনে আরও হাজারের বেশি ইউপিতে ভোট বাকি আছে। ইসি যদি এখন দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা না নেয় তাহলে তৃতীয় ধাপের ভোটে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার রংপুর ডেইলীকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব ছিল যারা সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুততার সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া; যেসব প্রার্থীর পক্ষে মানুষ সহিংসতায় জড়িয়েছে বা হুমকি–ধমকি দিয়ে অন্যায় আচরণ করছে, তাদের প্রার্থিতা বাতিল করা এবং যেখানে পরিস্থিতি খারাপ, সেখানে নির্বাচন বাতিল করা। এই পদক্ষেপগুলো নেওয়া হলে একটি কঠোর বার্তা দেওয়া যেত। কিন্তু এখন ইসি আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Leave a Comment